ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

কবি পোষা পাখি হলে বুঝতে হবে সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে: হেলাল হাফিজ

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবি পোষা পাখি হলে বুঝতে হবে সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে: হেলাল হাফিজ

সমকালীন বাংলা কবিতায় হেলাল হাফিজ এক রাজকুমারের নাম। প্রতিবাদ ও প্রেম, দ্রোহ আর বিরহের এই কবি অকল্পনীয় নৈপুণ্য ও মমতায় শব্দের মালা গেঁথে কবিতাপ্রেমী মানুষকে অনির্বচনীয় আমোদ দিয়ে চলেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি পাইয়ে দেয়। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'- এই অমর পঙ্‌ক্তিযুগল তাঁর পাণ্ডুলিপি থেকে উঠে আসে মিছিলে, স্লোগানে আর দেয়ালে দেয়ালে। বিস্ময়ের বিষয় হেলাল হাফিজের কবিতা ব্যতীত প্রেম যেন অসম্পূর্ণ। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় এই কবির প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রীত এই কাব্যগ্রন্থ তাঁকে এনে দেয় তুঙ্গস্পর্শী কবিখ্যাতি আর ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা। অল্প লিখেও হেলাল হাফিজ গল্প হয়েছেন। নিজের কবিতার মতোই রহস্যাবৃত তার যাপিত জীবন। কবির রচিত মমতা জড়ানো মর্মস্পর্শী পঙ্‌ক্তিমালা, রূপকথার এই মানুষটিকে আজ কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। এই কবির মুখোমুখি হয়েছেন আরেক তরুণ কবি জব্বার আল নাঈম। পড়ুন দুই প্রজন্মের দুই কবির কথোপকথনের শেষ পর্ব।

জব্বার আল নাঈম: জীবনে শুধুই প্রেম ছিল? প্রেমের বাইরে অন্য কিছু মানে…
হেলাল হাফিজ: সব প্রেম যে দৈহিক ছিল তেমন নয়। ঐ সময় দুই-একজনের সাথে এক্সট্রিম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বাকিগুলো একটা জায়গায় ছিল। তো কবিতার জন্য এটা জরুরি হয়ে পড়ে অনেক সময়। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। আমিও করেছি। জীবন উপভোগ করেছি।

জব্বার আল নাঈম: ষাটের দশকে আপনারা কে কে কবিতা চর্চা শুরু করেছিলেন?
হেলাল হাফিজ: ধরো, আমার কয়েক বছরের বড় ঐ সময় শুরু করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। যদিও তিনি আমার আগের থেকেই পরিচিত নেত্রকোনার মানুষ হওয়ার কারণে। আবুল হাসান, তারপরে আমার একটু ছোট শিহাব সরকারের বন্ধু... মনে আসছে না। তার একটি বইয়ের দোকানও ছিল- শিল্পতরু। ও মনে পড়েছে। আবিদ আজাদ, শিহাব শাহরিয়ার, হাসান হাফিজ। এরা আবার আমার থেকে ৫-৬ বছরের জুনিয়র। এরা সবই মিলে শুরু করেছিলাম।

জব্বার আল নাঈম: ছফা ভাই আপনাদের সিনিয়র ছিলেন?
হেলাল হাফিজ: ছফা ভাই অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের বড়। তিনি শুরু করেছিলেন আমাদের আগে। ছফা ভাই, হুমায়ুন কবীর, হুমায়ুন আজাদ, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রশান্ত ঘোষাল। এদের মধ্যে মনে হয় আসাদ চৌধুরী বড় হবে। প্রত্যেকেই আমাদের থেকে তিন থেকে সাত বছরের বড়। ফরহাদ মজহারও আমার থেকে বড়। সবাই একসাথে শুরু করেছিলাম। আমাদের শুরুটা একঝাঁক প্রতিভার সাথে ছিল।

জব্বার আল নাঈম: এদের মধ্যে অনেকেই প্রয়াত। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী এবং সৈয়দ শামসুল হক। এদের সাথে সম্পর্ক...
হেলাল হাফিজ: রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক এদের প্রত্যেকের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। এর ৭-৮ বছর আগে শামসুর রাহমান। তার সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। রফিক আজাদ, আবদল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক এদের সবার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি সৈয়দ হক ভাইকে নিয়ে চারটি টিভি অনুষ্ঠানও করেছি। শহীদ কাদরীকে নিয়েও দুটি অনুষ্ঠান করেছি।

জব্বার আল নাঈম: হঠাৎ করে টিভি অনুষ্ঠানের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণ?
হেলাল হাফিজ: টিভিতে পার্টিকুলার একটা টাইমে অনুষ্ঠানটি শুরু হলো আবার শেষ হয়ে গেল। প্রিন্ট মিডিয়াতেও আলাদা একটা মজা আছে। প্রিন্ট মিডিয়াতে একটা জিনিস বেরুনো মানে ইউ ক্যান প্রিজারভড ইট। এ জন্য প্রিন্ট মিডিয়া থেকে একটু দূরে চলে গেছি। এখন টিভিতেও প্রিজারভড করা যায় ক্যাসেট করে, সিডি করে অথবা মোবাইলেও রাখা যায়। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ারটা মনে হয় যেন জীবন্ত দলিল। রাখা যায়, বারবার দেখা যায়। সমালোচনা করা যায়। যদিও আমার কাছে সমালোচনা খুব ভালো লাগে। শিল্প সাহিত্যের সমালোচনা আরো হওয়া দরকার। আমার সাহিত্যে দুর্বলতা থাকতে পারে। সেটা একজন বলবে না? অবশ্যই বলা উচিত। সমালোচনা খারাপ না। তুমি আমার ত্রুটি দেখাচ্ছো তার মানে তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু।

জব্বার আল নাঈম: সমালোচনার কথা বললে তো আপনার কবিতার প্রসঙ্গে আসতে হয়। আপনার সমসাময়িক কবিদের কেউ কেউ আপনার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ ছাড়া অন্য কবিতাগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে নানান প্রশ্ন তোলেন।
হেলাল হাফিজ: হতে পারে। একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। আমার নিজেরও সন্দেহ আছে। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যে, সমকালে খুবই নন্দিত কিন্তু কালের প্রবাহে সে হারিয়ে যায়। ধোপে টেকে না। আবার সমকালে অনুপস্থিত কিন্তু ১০০ বা ১৫০ বছর পরে অত্যন্ত মহিমান্বিতভাবে আবির্ভূত হয়। এরকম নজিরও আছে। কেউ যদি আমার সমালোচনা করে, হেলালের কবিতা কলের হাতে টিকবে না, জলজ বা হালকা। আমি মোটেও কষ্ট পাই না। আমি আরো সচেতন হই। আমি জানলাম যাই হোক সমাজে এটাও তাহলে মত আছে। তোমার উপর রাগ করা নয়, আমার দায়িত্ব হলো নিজেকে তৈরি করা। কেন এটা বলছে, তার কারণ বের করতে হবে। তার কথার প্রতিবাদ করার জন্য আমাকে আরো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবেই না এটা বন্ধ হবে। তাই না? এজন্য আমি এসব নিয়ে ভাবি না। আমি সমকালে যতটা আদর পেলাম ততটা আদর ভালোবাসা তো আমার পাওয়ার কথা ছিল না। এটা সমকালের কয়জনের ভাগ্যে জোটে? এর জন্য আমি যে খুব গর্ববোধ করি তাও না। আমার ভালো লাগে কারণ আমিও তো রক্ত মাংসের মানুষ। কিন্তু খুব উৎফুল্ল বোধ করি না। এটা সাহিত্য। বীজগণিত না। সাহিত্যের মজাটা এখানেই।

অনেকের ধারণা, আমার লেখা খুবই সহজ সরল। এটা বোধ হয় টিকবে না। না-ই টিকতে পারে। এ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। তুমি ‘গীতবিতান’ নিয়ে বসো। সেখানে আড়াই থেকে তিন হাজার গান। সেখানে পঞ্চাশটি শব্দ পাবে না তোমার অপরিচিত। সেখানে এত সহজ শব্দ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। সেটা বাতিল করা যাবে? এত সোজা!

জব্বার আল নাঈম: মধুসূদনের কবিতা?
হেলাল হাফিজ: মাইকেল অনেক বড় কবি।একটা সময় মাইকেলের সাথে রবীন্দ্রনাথের দ্বন্দ্ব ছিল। তাদের বেশ গরম (সাহিত্য) তর্কও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সব সময় নরম ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে মানুষ কত সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেছে। ‘শনিবারের চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অনেক লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পেলেন তখন তারা বলতে শুরু করলেন, পৃথিবীতে একটি পুরস্কার ছিল যেটার এতদিন সম্মান ছিল, এখন আর থাকল না। তখন রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন ‘এই মণিহার আমার নাহি সাজে’। বুঝতে পারছ রবীন্দ্রনাথকে অনেক আক্রমণ করা হয়েছিল সে সময়। এর মূল কারণ, তিনি হিন্দু ছিলেন না। ব্রাক্ষ্ম ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথই রয়ে গেলেন। অন্যরা কোথায়?

এই প্রসঙ্গে আমি তোমাকে বলি, তুমি চাইলে টুকে রাখতে পারো: ‘সমকালীন বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ রাজকুমারের মতো। জন্ম ১৯৪৮ সনের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনা’-এই ধরনের একটি কথা। আসলে মহাকালের প্রশ্নে আমরা যাচ্ছি না। আমরা সমকালেই থাকছি। আরেকটা হলো যে, আমি আমার কবিতা নিয়ে এত ভাবি না।

জব্বার আল নাঈম: আপনার বয়স বাড়ছে। আপনি চাইলে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন।
হেলাল হাফিজ: আমি তো সেটা চাই না। আর আমার পক্ষে তা সম্ভবও না। কোনো সুযোগ আমি নেব না। আমি চাইলে অনেক সুযোগ নিতে পারতাম। একবার চাকরির সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করিনি। রফিক আজাদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। আরো অনেকে অনেক সুযোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। আমি বাংলা একাডেমি পদক পেয়েছি তদবির ছাড়া। এগুলো আমাকে দিয়ে হবে না। আমি এত বড় অসুখ নিয়ে চলছি আমি তো কারো কাছে হাত পাতিনি।

জব্বার আল নাঈম: শুনেছি প্রধানমন্ত্রী আপনার বন্ধু। চাইলে অগ্রাধিকার সূত্রে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারেন।
হেলাল হাফিজ: এই আরেক মুশকিল। তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, আমি অপেক্ষায় আছি তুমি কখন আমাকে ডাকবে। আমি কেন যাব? আমি মনে করি কবি হলো, একটা স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম সত্তা। একটি সমাজে যখন কবি পোষা পাখি হয়ে যায়, বুঝতে হবে সেই সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে। কেননা কবি  সমাজের ব্যারোমিটার। আরেকটি কথা, রাষ্ট্রে আমার চেয়ে দুঃখে-কষ্টে কোটি কোটি মানুষ আছে। আমি এই সমাজে অসাধারণ একটা আদর নিয়ে বেঁচে আছি। আমি কি করেছি এই সমাজের জন্য? ৫৬টি কবিতার একটা বই আছে। যার জন্য মানুষ আমাকে দেখলেই ডাক দিয়ে আদর করে। ভালোবাসা দেয়। এদেশের মানুষ খুব উদার। একটু প্রতিভার ঝলক দেখলে তোমাকে আকাশে তুলে ধরবে। বুকে জড়িয়ে ধরবে। তার বাস্তব প্রমাণ হেলাল হাফিজ। আমি কিন্তু এত প্রতিভাবান লোক নই। সত্যি করে বলছি। এটা আমার বিনয় নয়। এই যে বললাম নিয়তি। সাহিত্যের সঙ্গে নিয়তিরও একটা ব্যপার আছে। যে কারণেই হোক আমারটা সংযোগ হয়ে গেছে। ঘটে গেছে।

জব্বার আল নাঈম: কবির আত্মসংযম কতটা দরকার বলে মনে করেন?
হেলাল হাফিজ: বইয়ের সংখ্যা দিয়ে এজন কবিকে চিন্তা করাটা বোকামি। একশ বা হাজার বই করার পরও সেখানে আমরা লেখককে পেলাম না। তাহলে তো হবে না। তাই তাকে সংযমী হতেই হবে। বয়স বাড়লে হিসেব করে লিখতে হবে। আবার উল্টোটাও ঘটতে পারে। অনেক বেশি লিখতে হবে। যদি কেউ পারে তাতে আপত্তি থাকার কথা না। আমি যদি অনেক লিখতে পারতাম তাহলে এখন হোটেল ভাড়ার জন্য কষ্ট পেতে হতো না। এই যে এখনও হোটেল ভাড়া দিতে পারিনি। অল্প কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি তার লভ্যাংশ দিয়ে কোনো রকম টেনেটুনে চলি। খুব কষ্ট হয়। চাকরিজীবনের কিছু টাকা জমানো আছে। একখণ্ড জমি ছিল মিরপুরে, সেটা বিক্রি করে সঞ্চয় করেছি। চাটুকারিতা করলে আমার ঘুম হয় না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চেয়ে কোনো পুরস্কারও আমার নেয়ার ইচ্ছে নেই। টেনশনে থাকতে হয়। আমি আরামে ঘুমাতে চাই।

জব্বার আল নাঈম: আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী ছিল তখন?
হেলাল হাফিজ: মানুষ রাজনীতির বাইরে না। আমি ছাত্রবেলায় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না। তবে আমি বাম রাজনীতির গোপন সমর্থক ছিলাম বা এখনও আছি। এখানে আমার একটা পক্ষপাত আছে।

জব্বার আল নাঈম: সমাজতন্ত্রের প্রতি আপনার পক্ষপাতটা কেন?
হেলাল হাফিজ: সাম্যবস্থা যদি তুমি করতে চাও সেক্ষেত্রে খুব দরকার। তুমি বলতে পারো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। বিশ্বে আজ সমাজতন্ত্র ভালো অবস্থানে নেই। আমাদের পাশের দেশ পশ্চিমবঙ্গে পতন হলো, এটা আদর্শের জন্য হয়নি। এটা ভুল মানুষের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার কারণে হয়েছে। যোগ্য নেতৃত্বের কারণে পতন হয়েছে। তারপরও আমি সমাজতন্ত্রের কথা বলব। কারণ, সমাজতন্ত্র একটা ব্যালেন্সের কথা বলে। গণতন্ত্র বলি বা অন্য তন্ত্র বলি সেখানে এক ধরনের পুঁজিবাদতন্ত্র। এই পুঁজিবাদতন্ত্রের কারণে আমাদের দাসত্ব বরণ করতে হচ্ছে। এখন আবার আমরাও সেসব মেনে নিচ্ছি। এটাকে অতিক্রম করা দরকার। সমাজতন্ত্রের হাতে আমাদের শান্তি হবে।

জব্বার আল নাঈম: জীবনের এই প্রান্তে এসে কখনও কি মনে হয়, বিয়ে করলে ভালো হতো?
হেলাল হাফিজ: সে কথা বলে লাভ নেই। সময় বসে নেই। শরীরও আগের মতো নেই। এভাবে থাকা ছাড়া বিকল্প আর কিছু দেখছি না। আমি অনেক ভুল করেছি জীবনে। সেসব ভুলের মাশুল গুণছি। বিয়ে করলে হয়ত আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেত। এখন আমার একটাই প্রার্থনা। আমি যখন বিছানায় পড়ে যাব তখন যেন একটানে পৃথিবী থেকে যাই। উপরওয়ালা যেন সেটা করেন।

জব্বার আল নাঈম: আপনার নতুন কাব্যগ্রন্থে কোন ধরনের কবিতা থাকবে?
হেলাল হাফিজ: আমি চেষ্টা করব এমন কিছু পঙ্‌ক্তি এই বইটিতে সংযোজন করতে যেন তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সবার অন্তরে নাড়া দেয়। যেমন ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’। এটা ফেসবুকে আছে। বা ধরো, আমার আরেকটি এক লাইনের কবিতা আছে। নাম ‘থুতু’। থুতু তুচ্ছার্থে ব্যবহার করি আমরা। এই থুতু দিয়ে যখন প্রেমিকাকে চুমু খাবে তখন এটি অমৃত। কিংবা তোমার স্ত্রীকে তুমি বা স্বামীকে স্ত্রী যখন চুমু খাবে তখনও থুতু অমৃত। কবিতাটি হলো- ‘থুতুও অমৃত হয় চুম্বকীয় চিকন চুম্বনে।’ এই ধরনের থট। অধিকাংশ কবিতা এ রকম। কবিতা একাত্তরের ১৫টি কবিতাও এই বইয়ে দেব। সেখানের ১৩টি কবিতা আবার সিরিজ কবিতা। অচল প্রেমের গদ্য নামে। তবে, আলাদা আলাদা শিরোনামের কবিতা। এই কবিতাগুলোও ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। তাহলে নতুন কবিতা লাগবে ৪১টি। হয়ে যাবে বই।

জব্বার আল নাঈম: কবিতার ছন্দ নিয়ে বলুন। কবিতায় কোনটি বেশি দরকার- ছন্দবিমুখতা না ছন্দের প্রয়োজনীয়তা?
হেলাল হাফিজ: বাংলা কবিতা চর্চা করবে আর ছন্দ জানবে না- তা হয়। কবি ছন্দে লিখবে না গদ্যে লিখবে তার ব্যাপার। কিন্তু তাকে ছন্দ জানতে হবে। কোনো কিছুর নিয়ম জানলেই সে নতুন নিয়ম দাঁড় করাতে বা ভাবতে পারে। না হয় নতুন চিন্তা করা সম্ভব না।

দ্বিতীয়ত গদ্যেরও অন্তরগত একটা ছন্দ আছে, যে জন্য রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্প আমাদের মুখস্ত হয়ে যেত। আগে হলো বেসিক। বেসিক জানার পর তোমাকে নতুন চিন্তা করতে হবে।

জব্বার আল নাঈম: বর্তমান কবিতা ছন্দবিমুখ। মুক্তছন্দের চর্চা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ পাঠকের কাছে ছন্দবদ্ধ কবিতা এখনো বেশি পঠিত। এ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
হেলাল হাফিজ: কবিতা আর অ-কবিতার মূল পার্থক্য ছন্দ নয়। ছন্দ হলো ফরমেট। গল্প বা কবিতার আলাদা ফর্মেট থাকে। ছন্দ থাকলে সাধারণ মানুষ সহজে মনে রাখতে পারে। মানুষ ছন্দের ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। সেখানে ছন্দ প্রবণতায় বেশি আক্রান্ত হয় মানুষ। ছন্দের প্রতি তাই সহজাত দুর্বলতা থাকবেই।

জব্বার আল নাঈম: চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা দিয়ে কবিতা সাজালে কেমন হয়? একজন চিত্রকর তার যে চিত্রকর্মটি উপস্থাপন করেন সেটাও কী কবিতা?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। কবিতায় কেবল শব্দের খেলা থাকবে এমন নয়। বর্তমানে যে নিরীক্ষা হচ্ছে তাতে মাঠের ফসলও কবিতা। নৃত্যের তালে যে রিদম সেটিও কবিতা। মানুষের সুখী মুখ শ্রেষ্ঠ কবিতা। মানুষ অসুখী সেটিও কবিতা। আমি বলতে চেয়েছি পৃথিবীর সুন্দর ও অসুন্দর সব কিছুই কবিতা। কবিতা না এমন কিছু কি আছে? নেই। আমরা চাইলেই এই গ্লাসটি নিয়ে কবিতা লিখতে পারি। প্রেসক্লাব নিয়ে কবিতা লিখতে পারি। রাস্তা নিয়ে লিখতে পারি। দুঃখের দিন কবিতা লিখতে যেমন পারি, সুখের দিনে আমরা লিখি রোমান্টিক কবিতা। রাস্তায় অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়িযে যখন কথা বলে কেউ তখন সেটিও কবিতা। তুমি যে চিত্রকলা দেখছ সেসবও কবিতা, স্থাপত্যে কিংবা যে কোনো সুন্দর আকর্ষণীয় সৃষ্টি তা-ই কবিতা। এটি আসলে রহস্যময়ী নারীর মতো। বুঝে ওঠা কঠিন।

জব্বার আল নাঈম: সাহিত্যচর্চা শুরুর আগে আপনি কার লেখা দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন?
হেলাল হাফিজ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ। আর আমার সমকালে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছি আবুল হাসান দ্বারা। তাকে ঈর্ষা করতাম। আবুল হাসানকে বলেছিও সে কথা। সে যদিও আমার দুই বছরের বড় কিন্তু আমাদের মধ্যে তুমি তুমি সম্পর্ক ছিল। আমাদের সময়ে সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি ছিল সে। যে কারণে আমি তার কবিতার স্বর থেকে ইচ্ছেকৃতভাবে শব্দ প্রয়োগে ও চয়নে সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতাম। আমি কখনও চাইতাম না তার মতো আমার কবিতা হোক। আবার দেখা গেছে, তার কান্না আমার কান্না এক। তার প্রেম আমার প্রেমও এক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়