ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অনুবাদ গল্প: গুরুত্ব

জি এইচ হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৪, ৩০ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনুবাদ গল্প: গুরুত্ব

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো বিধবা এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নারী। এত বড় শহরে, যেখানে এত শত গুরুত্বপূর্ণ নারীর বাস, সেখানে মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনোর মতো গুরুত্বপূর্ণ নারী আর কেউ নেই। চাকরবাকর ও গুরুত্বপূর্ণ আসবাবে ভরভরন্ত এবং তার গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই এক বিশাল বাড়িতে তিনি বাস করেন ও গুরুত্বপূর্ণ সব দান-দক্ষিণা চালান, যে কাজে আবার গুরুত্বপূর্ণ সব আমোদ-উৎসবের দরকার পড়ে।

ভাগ্যের এক কৌতূহলজনক পাকে পড়ে একমাত্র যে জিনিসটি গুরুত্ববিহীন রয়ে গেছে তা হলো, তার পরিবার বা বংশ। ভদ্রমহিলার কুলুজি সন্দেহজনক, আর এই সন্দেহজনকতার ব্যাপারে আবার কারোরই লেশমাত্র সন্দেহ নেই, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নারীদের তো একেবারেই না। এই মূল বা উৎসের সাক্ষী হচ্ছে (যা তার বিয়ের দীপ্তিও খুব একটা উন্নতি ঘটাতে পারেনি) অপরিসীম নিরীহ কিছু লতায়-পাতায় আত্মীয় যাদের সঙ্গে মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনোর কখনো দেখা হয় না বললেই চলে। লোকজনের সঙ্গে তাদের যদি তার পরিচয় করিয়েই দিতে হয় কখনো  যে-কাজটা তিনি খুব চাতুর্যের সঙ্গে এড়িয়ে যান, তখন তিনি তাদের নাম আর সম্পর্কটা একটা আধো হাসি আর দূরাগত দৃষ্টি দিয়ে মুড়ে দেন, আর ওদিকে তার অহং তার বুকের মধ্যে থুতু ছেটায় আর শিকারের গায়ে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করা বাঘের মতো গজরাতে থাকে।

মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো ঈশ্বর এবং নরকে বিশ্বাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে (কারণ তার সমস্ত তত্ত্বাবধায়ক এবং দান-দক্ষিণার সাহায্যকারী তাকে নিশ্চিত করে বলেছে) স্বর্গে তিনি দিব্যি একটা জায়গার মালিক হয়ে গেছেন। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই, তিনি দুনিয়াতে থাকাই পছন্দ করতেন, যে-জগৎ তার জন্য বড্ড মানানসই। উল্লিখিত সেই আত্মীয়স্বজনের উদ্ভট ব্যতিক্রমী ব্যাপারটি ছাড়া; কিন্তু এক সকালে হঠাৎ তার সেই গুরুত্বপূর্ণ বিছানায় ঘুম থেকে উঠে বা না উঠেই, মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো তার গুরুত্বপূর্ণ চাকরবাকরের কান্নাকাটি আর আহাজারির কারণে বুঝতে পারলেন, যে তিনি আর ইহজগতে নেই। খানিকটা ভয় পেয়ে গেলেন তিনি, অবাকও হলেন খানিকটা, কারণ তার মনের গভীর কন্দরে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি অমর, যদিও সে কথা তিনি কখনো স্বীকার করেননি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, এবং মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো বৃথাই স্বর্গীয় গৃহকর্তাদের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করেন, যাদের কিনা তাকে স্বর্গীয় প্রাসাদের কোথাও একটা বাছাই-করা কামরায় নিয়ে গিয়ে রাখার কথা। তার বদলে এসে হাজির হয় তার জ্ঞাতি ভাই-বোন আর ভাইপোরা (আর সেই জঘন্য সৎ বোনটা), আর তাদের অস্তিত্ব শেষ অবধি সেই অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নারীর কাছে পরিষ্কার করা হয়, যারা তখন মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনোকে তাদের জপমালা হাতে ঘিরে ধরেছে।

মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো কথা বলতে চান, কিন্তু একটা শব্দও যদি তিনি উচ্চারণ করতে পারতেন। তিনি সবাইকে ব্যাখ্যা করে বলতে চান যে, এসব আত্মীয়স্বজন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়, তারা আসলে আত্মীয়স্বজনই নয় আদৌ, যারা কিনা সবকিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে, যাদের সঙ্গে করমর্দন করার, বা বুক মেলানোর, বা যাদের আন্তরিক সান্ত্বনা জানানোর, অথবা যাদের নিয়ে এত আদিখ্যেতা দেখানোর, বা এত নির্বোধের মতো প্রশ্ন করার; কারণ সেসব প্রশ্ন এসব আত্মীয়স্বজনকে নিয়েই যাদের আসলে কোনো গুরুত্বই নেই, কোনো মানেই হয় না। আর এদিকে কেউই তাকে নিয়ে যেতে আসে না। মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো যেহেতু হুকুম করার ত্বরিত ও উদ্ধত ছন্দের সঙ্গে পরিচিত, তিনি ক্রমেই অধৈর্য হতে শুরু করেন।

ছয় ছয়টি অসহনীয় দিন পার হয়ে যায়, এবং শেষ অবধি মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো অসহায় আতঙ্ক আর ক্রোধন্মত্ততার সঙ্গে বুঝতে পারেন যে, যে উকিলের কাছে তিনি তার মূল্যবান ইচ্ছাপত্রখানি গচ্ছিত রেখেছেন (যে-ইচ্ছাপত্রে তিনি বলেছেন যে, তিনি তার সমস্ত ধনসম্পদ বড় বড় সব চ্যারিটিতে দান করে দিয়েছেন যারা তার গুরুত্বপূর্ণ নামখানা ছড়িয়ে দেবে এবং সেটাকে দীর্ঘস্থায়ী করবে), সেই উকিল বলেছে যে এমন কোনো ইচ্ছাপত্রের অস্তিত্ব নেই, এবং মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, ঈশ্বর জানেন কেন, হয় লজ্জা না হয় কুসংস্কারবশত, বা তার চরিত্রশক্তির কারণে, এমন একটা ইচ্ছাপত্রের কথা ডিটেক্ট করতে এবং তাতে সই করতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন!

‘কে ভেবেছিল যে এমন হবে’, দানছত্রগুলোর প্রশাসকদের মুখে কেবল ওই এক কথা। কাজেই একটা আইনানুগ দলিলের অভাবে এটা অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, তার সহায়-সম্পত্তি সব তার সেই শোকগ্রস্ত আত্মীয়স্বজনের হাতেই যাবে। মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো কথা বলে উঠতে চান, এই দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে উঁচু গলায় প্রতিবাদ জানাতে চান, কিন্তু এখন তিনিই এক নতুন ভুতুড়ে স্থানে বন্দি, যেখানে তার কণ্ঠ তাকে পরিত্যাগ করেছে। স্বর্গের পানে দুই হাত উঁচু করতে চাইলেন তিনি, সেই স্বর্গের পানে যা এত কৌতূহলজনকভাবে মুলতবি করা হয়েছে, এবং সবাইকে জানাতে চাইলেন যে তার মহৎ ইচ্ছা উকিলের জন্য ভণ্ডুল হয়ে গেছে, যে-উকিল কিনা সম্ভবত তার জঘন্য, ঘৃণ্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু তিনি তা করতে পারলেন না। তিনি কিছুই করতে পারলেন না।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেখানে শুয়ে থাকলেন তিনি, তার দুর্দান্ত বাড়িতে তার ভাইপোদের আর জ্ঞাতি ভাইবোনদের (আর সেই ঘৃণ্য সৎ বোনের) আসা-যাওয়ার সাক্ষী হয়ে। তিনি দেখেন তারা দেরাজগুলো খুলছে, তার চিঠিপত্র পড়ছে, তার অলংকার, তার ফারের পোশাক-আশাক পরে দেখছে, তার চাকর-বাকরদের হুকুম দিচ্ছে, তার মদের ভাড়ার ফতুর করে দিচ্ছে, শহরের যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিধবা তাদেরকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দানছত্রের বোর্ডে যোগ দেবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে তাদের আদর-আপ্যায়ন করছে। তিনি শুনতে পান বিধবারা কাকুতি-মিনতি করছে, তিনি শুনতে পান তার আত্মীয়স্বজনেরা শেষ অবধি সম্মতি দিচ্ছে; তিনি দেখতে পান তারা চেকে সই করছে। তিনি খেয়াল করেন তিনি যেভাবে হাসতেন তারাও কীভাবে সে-রকম করে হাসতে শিখে গেছে, এবং কীভাবে, তার নাম উল্লেখমাত্র তারা একটা নিস্পৃহ, প্রায় উদাসীন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

এবং তারপরেও কেউ-ই তাকে নিয়ে যেতে আসে না। নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকেন তিনি নিজের বিছানায় অদৃশ্য হয়ে, ওদিকে অন্য লোকে সেখানে শুচ্ছে, সেই লোকজন যারা তার সেই বিছানায় তার বিখ্যাত ভৌতিক শরীরের ওপর ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অনুপুঙ্খ সব কাজ করে যাচ্ছে, সেই লোকজন যারা তার স্মৃতি স্থূল, রূঢ় কৌতুকের সাহায্যে কলংকিত করছে, যারা তার অহংকার নিয়ে অক্লেশে কথা বলছে, যেন এত শত মানুষের মধ্যে তিনি সব সময় সেই পাপের ভাগীদার ছিলেন। যারা অসুখী কেবল তারাই ফাঁপা; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই, তিনি কখনো অসুখী ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্রেফ গুরুত্বপূর্ণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যতক্ষণ পর্যন্ত না, ধীরে ধীরে মিসেস হারমোসিলা দেল ফ্রেসনো (যিনি এমনকি পাগলামির পোতাশ্রয়ে পালাতেও পারেন না) অবাক ও হতাশ হয়ে বুঝতে পারেন যে, তাকে কখনোই কেউ নিয়ে যাবে না, এমনকি এক অপ্রত্যাশিত নরকেও কেউ তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে না। কারণ, এটাকে যতই অদ্ভুত, উদ্ভট, অগতানুগতিক আর অ-ঈশ্বরতাত্ত্বিক বলেই মনে হোক, এটাই নরক।

লেখক পরিচিতি:
মানুয়েল মুতিকা লাইনের (১৯১০-১৯৮৪) এই গল্পটি নেয়া হয়েছে, ১৯৮৩ সালে পিকাডর প্রকাশিত এবং আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল সম্পাদিত ব্ল্যাক ওয়াটার: দ্য অ্যান্থলজি অভ ফ্যান্টাস্টিক লিটারেচার থেকে। একবার এই বইয়ের সম্পাদককে এক সন্ধ্যায়, বুয়েন্স আইরিসের বৃক্ষশোভিত রাস্তাগুলো ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি চত্বর দেখিয়ে মুতিকা লাইনে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নামে চত্বরটির নামকরণ করা হবে। ‘দিব্যদৃষ্টির’ অধিকারী ছিলেন তিনি। তাস, করতল, এবং স্বপ্নের ভেতর তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন; এছাড়াও তিনি ভূতে বিশ্বাস করতেন। আর্জেটিনার কর্দোবার শৈলোপরি বিশাল একটি হিস্পানি প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতেন তিনি, চতুর্দিকে নানান চিত্রকর্ম, বই-পত্র এবং বিভিন্ন জিনিসপত্র পরিবেষ্টিত হয়ে, যেসব জিনিসপত্র তাঁর দীর্ঘ ভ্রামণিক জীবনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। শেক্সপীয়রের সনেট হিস্পানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি; রাসিন এবং মলিয়ের-এর নাটকও অনুবাদ করেছেন।
মুতিকা লাইনে’র সাহিত্যিক ভাগ্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। হিস্পানিভাষী দেশগুলোতে তিনি বইবিক্রির হিসাবে প্রথম সারির লেখক হলেও তাঁর বইগুলো ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে বেশ দেরিতেই পৌঁছেছে; ফ্রান্সে তো এখনো যায়ই নি। তাঁর রচনাগুলোর মধ্যে Bomarzo (এক অমর ডিউকের দৃষ্টিতে দেখা, রেনেসাঁর পটভূমিতে চিত্রিত একটি বড় ফ্রেসকো বলা যেতে পারে সেটিকে) এবং The Wandering Unicorn (ক্রুসেড এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের পটভূমিতে একটি কাল্পনিক প্রাণি মেলুসিনের কাহিনি)-ই কেবল ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। গল্পটি আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েলকৃত ইংরেজি তরজমা থেকে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়