ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লেখক ছাড়া আমি অন্য কিছু হতে চাইনি: সেলিনা হোসেন

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৮, ১৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেখক ছাড়া আমি অন্য কিছু হতে চাইনি: সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা- বাংলা সাহিত্যের সব শাখাতেই তাঁর রয়েছে সাবলীল বিচরণ। ছোটদের জন্যও লিখেছেন অজস্র। এই কথাসাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্কটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। দীর্ঘদিন তিনি কাজ করছেন নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান নিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের অবস্থান, বৈষম্য, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়েও তিনি সরব। 

সেলিনা হোসেনের লেখা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি বহুভাবে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। আজ সেলিনা হোসেনের জন্মদিন। তাঁর জন্য রইল আমাদের অনিঃশেষ শুভ কামনা এবং ফুলেল শুভেচ্ছা। এমন উজ্জ্বল এক দিন উপলক্ষে তাঁর লেখালিখি, বিষয়-ভাবনা, ব্যক্তিগত ভালো বা মন্দ লাগা ইত্যাদি নানা বিষয় জানতে চেয়ে কথা বলেছেন তরুণ কবি ও গল্পকার  অঞ্জন আচার্য

অঞ্জন আচার্য : বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীরা অনেক এগিয়েছে। ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারীদের এ অগ্রযাত্রা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সেলিনা হোসেন: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তো আছেই, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ক্ষমতায় নারীরা অগ্রগামী ভূমিকার রাখছে। বাংলাদেশের সরকার প্রধান নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী, একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী, স্পিকার নারী এবং এমনকি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে উন্নীত হয়েছেন নারী। এর বাইরেও আমি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের অবস্থান দেখতে পাই। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশাতেও নারীরা অনেক এগিয়ে এসেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে নারীদের যে অবস্থান, দেশের অর্থনীতিতে তারা যে প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে এটাও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীদের এ অর্জনের পাশাপাশি নারীর প্রতি নির্যাতন-সহিংসতা, সমতার জায়গা তৈরির ক্ষেত্রে নারীদের অবরোধ করে রাখার পুরুষদের যে আচরণ প্রবল হয়ে আছে তা বলতেই হবে।

অঞ্জন আচার্য: তার পরেও তো আগের তুলনায় অবস্থা অনেকখানি বদলেছে বলা যায়...

সেলিনা হোসেন: আমরা পাঁচজন, দশজন, একশ জন, পাঁচশ জন নিয়ে তো বিচার করতে পারি না যে নারীর অবস্থান অনেক বড়ভাবে বদলে গেছে। ষোলো কোটি মানুষের যদি অর্ধেকও নারী হয়, নারীর অবস্থান এখনো সেভাবে আসেনি। পারিবারিক নির্যাতন একটা বড় পর্যায়ে আছে। যৌতুকের নামে এখনো বাল্যবিয়ে হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যে তারা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে- বলা যাবে না।

অঞ্জন আচার্য: শিক্ষার ক্ষেত্রে?

সেলিনা হোসেন: নারীদের শিক্ষার যে হার তাও সন্তোষজনক নয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেরা ৫০ শতাংশ, মেয়েরা ৫০ শতাংশ নয়।

অঞ্জন আচার্য: কেন এমন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

সেলিনা হোসেন: সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও বেশ কয়েকটি মৌলবাদী-রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল আছে যারা নারীদের পিছিয়ে দিতে চায়। তারা নারী-নীতির কেবল বিরোধিতা করে ক্ষান্ত হয় না, বরং নারীবিরোধী ফতোয়া জারি করে নারীদের পেছনে ঠেলে দিতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। তারা এখনও নারীদের আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে। সেসময় নারীদের জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। এখন শারীরিকভাবে না হোক, মানসিকভাবে নারীদের স্বাধীনতাকে কবর দিতে চায় মৌলবাদী চক্র।

অঞ্জন আচার্য: তা কি সম্ভব, কী বলেন?

সেলিনা হোসেন: না, তা আর সম্ভব নয়। আমাদের নারীরা যে পর্যায়ে উঠে এসেছে সেখান থেকে তাদের আর পিছিয়ে ফেলা সম্ভব হবে না। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়েই নারীরা এগিয়ে যাবে। নারীরাই তাদের নিজের অবস্থান নিজেরা গড়ে তুলবে।

অঞ্জন আচার্য: নারীর অগ্রযাত্রা তরান্বিত করতে আরো কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?

সেলিনা হোসেন: মানুষের অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে শিক্ষা। শিক্ষা ক্ষেত্রকেই আমি বেশি জোর দেবো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়।

অঞ্জন আচার্য: নারী-পুরুষের সমতা কীভাবে আসতে পারে?

সেলিনা হোসেন: সমতার জায়গা? সেক্ষেত্রে পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে, নারীদের মূল্যায়ন করার পরিসর বাড়াতে হবে। পুরুষেরা যদি দমন-পীড়নের মানসিকতা থেকে না বেরিয়ে আসে তাহলে নারী-পুরুষের সমতা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, নারীদের নিজের উন্নতির জন্য তো বটেই, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

অঞ্জন আচার্য:  এবার কিছু ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই আপনার কাছে। মানে, আপনার ভালো লাগা, মন্দ লাগা এমন কিছু বিষয় জানতে আগ্রহী।

সেলিনা হোসেন: বিষয়গুলো কেমন?

অঞ্জন আচার্য:  যে বই বার বার পড়েন।

সেলিনা হোসেন: এভাবে কোনো একটি বইয়ের নাম বলতে পারব না, বলা সঙ্গত বলেও আমি মনে করি না। কারণ অনেক বই বিভিন্ন কারণে ঘুরে ফিরে বার বারই সামনে আসে।

অঞ্জন আচার্য:  যে বই এখনও পড়া হয়নি।

সেলিনা হোসেন: পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শত শত বই আছে, যা আমার পড়া হয়নি।

অঞ্জন আচার্য:  যে চলচ্চিত্র মনে দাগ কেটে আছে।

সেলিনা হোসেন: দুটো চলচ্চিত্র খুব মনে পড়ে। একটি ভিক্টরিও দে সিকা পরিচালিত এবং সোফিয়া লরেন অভিনীত ইটালিয়ান চলচ্চিত্র ‘টু উইম্যান’, আরেকটি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’।

অঞ্জন আচার্য:  সিনেমার যে নায়ক আপনার চোখে নায়ক।

সেলিনা হোসেন: চার্লি চ্যাপলিন।

অঞ্জন আচার্য:  যে গান গুনগুন করে গান।

সেলিনা হোসেন: ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন/আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’।

অঞ্জন আচার্য:  প্রিয় যে কবিতার পঙক্তি মনে পড়ে মাঝে মাঝে।

সেলিনা হোসেন: আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে।

অঞ্জন আচার্য:  খ্যাতিমান যে মানুষটি আপনার বড়ো প্রিয়।

সেলিনা হোসেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অঞ্জন আচার্য:  যে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না।

সেলিনা হোসেন: আমার শৈশবের প্রিয় ফুল কামিনী।

অঞ্জন আচার্য:  কী খেতে খুব ভালোবাসেন?

সেলিনা হোসেন: তেমন করে কিছু না।

অঞ্জন আচার্য:  যা সহ্য করতে পারেন না একেবারেই।

সেলিনা হোসেন: ভণ্ডামি, দুর্নীতি এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া।

অঞ্জন আচার্য:  জীবনে কার কাছে আপনি সবচেয়ে বেশি ঋণী?

সেলিনা হোসেন: অনেকের কাছে; একজনের নাম বললে কম বলা হবে।

অঞ্জন আচার্য:  কেমন পুরুষ আপনার পছন্দ?

সেলিনা হোসেন: মানবিকবোধসম্পন্ন পুরুষ।

অঞ্জন আচার্য:  কোথায় যেতে ইচ্ছে করে?

সেলিনা হোসেন: মনে হয় পৃথিবীর সবটুকু জায়গা ছুঁয়ে দেখি।

অঞ্জন আচার্য:  কীভাবে সময় কাটাতে সবচেয়ে ভালো লাগে?

সেলিনা হোসেন: লেখালেখির সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে।

অঞ্জন আচার্য:  যে স্বপ্নটি দেখে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে...

সেলিনা হোসেন: এমন কোনো স্বপ্ন আমার নাই।

অঞ্জন আচার্য:  যে কারণে আপনি লিখেন?

সেলিনা হোসেন: নিজেকে প্রকাশের সঙ্গে মানুষের প্রতি অঙ্গীকার থেকে লিখি।

অঞ্জন আচার্য :  নিজের যে বইটির প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে।

সেলিনা হোসেন: গায়ত্রী সন্ধ্যা।

অঞ্জন আচার্য:  ভালোবাসা মানে আপনার কাছে...

সেলিনা হোসেন: ব্যক্তিপ্রেম থেকে দেশপ্রেম, সবটুকুই আমার ভালোবাসা।

অঞ্জন আচার্য:  আপনার চোখে আপনার ভুল।

সেলিনা হোসেন: অজস্র ভুল আছে, যার ক্ষমা নাই।

অঞ্জন আচার্য:  জীবনে যা এখনও হয়নি পাওয়া।

সেলিনা হোসেন: এমন ভাবনা আমার মধ্যে নেই।

অঞ্জন আচার্য:  যে স্মৃতি এখনও চোখে ভাসে।

সেলিনা হোসেন: কফিনে আমার মেয়ে লারা।

অঞ্জন আচার্য:  যা হতে চেয়েছিলেন- পারেননি।

সেলিনা হোসেন: লেখক ছাড়া আমি অন্য কিছুই হতে চাইনি।

অঞ্জন আচার্য:  জীবনের এ প্রান্তে এসে নিজেকে কতটা সফল মনে হয়?

সেলিনা হোসেন: একদমই মনে হয় না।

অঞ্জন আচার্য:  কোনটা বেশি টানে- পাহাড় নাকি সমুদ্র?

সেলিনা হোসেন: দুটোই।  পাহাড় যেমন প্রিয়, সমুদ্রও তেমন।

অঞ্জন আচার্য:  কোনটা বেশি উপভোগ করেন- বর্ষার বৃষ্টি নাকি শরতের নীলাকাশ?

সেলিনা হোসেন: বর্ষার বৃষ্টির তুলনা নেই, শরতের নীলাকাশ অপরূপ!





 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়