ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যেভাবে লেখা হলো ‘হাজার বছর ধরে’

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১৯ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে লেখা হলো ‘হাজার বছর ধরে’

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: বাংলা সাহিত্যের আদিতম শাখা কবিতার সূচনা দেড়হাজার বছরের বেশি সময় হলেও, সে হিসেবে উপন্যাসের উদ্ভব অনেক দেরিতে। ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স-এর লেখা বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৫৮ সালে প্যারিচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পেরিয়ে প্রথম সার্থক উপন্যাস বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। নবীনতম শাখা হলেও উপন্যাসের বিকাশ ও সমৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়েছে। বিগত দেড়শ বছরে ঔপন্যাসিকদের ধারাবাহিক চর্চায় আমরা ‘পথের পাঁচালী’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কবি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘লালসালু’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘সংশপ্তক’-এর মতো অনেক কালজয়ী উপন্যাস পেয়েছি। বাংলা সাহিত্য ভুবনে জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ সেরকমই একটি বিশেষ উপন্যাস। উপন্যাসে লেখক বাঙালির ঐতিহ্য, যাপন, সংস্কার, দ্বন্দ্ব ও প্রেম তুলে ধরেছেন বিশেষ পারঙ্গমতায়। ঐতিহ্যের উপস্থাপন ও শিল্পশৈলীর গুরুত্বের কারণে ‘হাজার বছর ধরে’ বাংলা ভাষার বহুল পঠিত ও সমাদৃত উপন্যাস।

সাহিত্য সমালোচকগণ বলে থাকেন, কোনো সফল সৃষ্টিকর্মের পেছনে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, শ্রম-ঘাম, চিন্তা-ভাবনার সম্মিলন ঘটে। এমন উক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য। তবে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটির কথা একটু আলাদা। ক্লাসিকি এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল স্বল্প সময়ে এবং হঠাৎ করেই ! অনেকে জেনে অবাক হবেন, ফরমায়েশী লেখা লিখতে গিয়ে জহির রায়হান এ উপন্যাসটি লিখেছিলেন!

১৯৬৪ সাল। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেয়া জহির রায়হানের বয়স তখন ২৯। সে-বয়সেই তিনি উপন্যাসটি লেখেন। একই বছর উপন্যাসটির জন্যে লেখক ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। অথচ তিনি লিখেছিলেন তখন বাধ্য হয়ে। ‘সচিত্র সন্ধানী’ সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ জহির রায়হানের বন্ধু ছিলেন। বয়স অল্প হলেও সে-সময়ে জহির রায়হানের খ্যাতি কম ছিলো না। গাজী শাহাবুদ্দিন তাঁর কাছে অনেকদিন ধরে ‘সচিত্র সন্ধানী’র ঈদসংখ্যার জন্যে একটি উপন্যাস চেয়েছিলেন। জহির রায়হান তাকে নিরাশ করেননি। বলেছিলেন, তিনি উপন্যাস দেবেন।

জহির রায়হান যেন তরুণ নজরুলের প্রতিচ্ছবি। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন যেমন নজরুলকে খেলার মাঠ থেকে ধরে এনে, তাড়া দিয়ে লেখাতেন-তরুণ জহির রায়হানের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছিল। ‘সচিত্র সন্ধানী’ সম্পাদক জহির রায়হানকে বারবার লেখা দিতে বললেও তিনি লেখা দিচ্ছিলেন না। এদিকে ঈদ ঘনিয়ে আসছে। জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু জহির রায়হান সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর অবসর মেলে না। ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছিলেন। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি লেখার পেছনের গল্পটি তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক :

‘‘উপন্যাসটি লেখার সময় তিনি ‘সঙ্গম’ নামে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবিটি করছিলেন। তিনি তখন খুব ব্যস্ত। তার পরও আমাকে কথা দিয়েছিলেন, উপন্যাস দেবেন। তবু তিনি আস্তে আস্তে আরো বেশি ছবিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন, লিখবেন কখন, এই ভয় আমার ছিল। যখনই তাঁর কাছে যাই, দেখি, একগাদা লোক নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাঁদের পরামর্শ চলছে। আমার দিকে তাকানোর সময়টিও তাঁর নেই। পরে আবার খুব আফসোস করেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলারও সময় পাই না। তবে ভাববেন না, আমি আপনাকে উপন্যাস দেব।’ বললাম, কখন দেবেন? আমার তো কম্পোজের সময় চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘পরশু থেকে আমার শুটিং শুরু হবে। সেদিন আপনি আসেন।’’

অন্য কোনো সম্পাদক হলে এতদিনে নিশ্চয়ই হাল ছেড়ে দিতেন। কিন্তু গাজী শাহাবুদ্দিন ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। তিনি এতোবার আসা-যাওয়া করেও বিরক্ত হলেন না। জহির রায়হানের কথামতো নির্ধারিত দিনে ঠিকই গিয়ে হাজির হয়েছিলেন শুটিং স্পটে। তাঁর ভাষ্যে : ‘‘এফডিসিতে গিয়ে দেখি, প্রচুর লোকের ভিড়, জহিরকে খুঁজেও পাচ্ছি না। হঠাৎ আমাদের চোখাচোখি হলো। আমাকে বসতে বললেন। তিনি তখন ভয়ংকর ব্যস্ত। আমি বসে আছি। লাঞ্চ ব্রেকের সময় তিনি দৌড়ে এসে বললেন, ‘চলেন।’ এই বলে আমাকে মেকআপ রুমে নিয়ে বসালেন। সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে আমাকে বসিয়ে রেখে কোনো কথা না বলে একটি বড় প্যাডে একটানা লিখতে লাগলেন। ভেবেছিলাম, হয়তো শুটিংয়ের কোনো কিছু লিখে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ লেখার পর আমাকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, ‘আজকে এতটুকু দিলাম। কালকে আবার আসবেন।’ বললাম, এটা কী? তিনি বললেন, ‘হাজার বছর ধরে’ শুরু করে দিলাম।’’

এভাবে যে মেকআপ রুমে বসে হুট করে উপন্যাস শুরু করে দেবেন, স্বাভাবিকভাবেই গাজী শাহাবুদ্দিন ভাবতে পারেননি। ভাবার কথাও নয়। কিন্তু উপন্যাসের সূচনাংশ পড়ে তিনি ঠিকই অবাক হয়েছিলেন: ‘খসড়া পড়ে তো আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম, একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে লেখা এই উপন্যাসের জন্য যে পরিমাণ চিন্তা করতে হয়, সেই সময় তিনি কখন পেলেন? এভাবে তিনি আমাকে উপন্যাসটি লিখে দিলেন!’ হাজার বছর ধরে লেখা হলে এটি ‘সচিত্র সন্ধানী’তে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর থেকেই এটি পাঠক ও বোদ্ধা মহলের ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এভাবে কি জোর করে উপন্যাস লিখিয়ে নেয়া সম্ভব? বহু ব্যস্ততার মধ্যে থেকে লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি পাঠ করলে এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মেলে। জহির রায়হান ব্যক্তিগত জীবনে সিনেমা নিয়ে তাড়াহুড়োর ভেতরে থাকলেও উপন্যাসে সেই ব্যস্ততার ছাপ পড়েনি। সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের অবিরাম তাগিদে জহির রায়হান যেমন লিখেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘হাজার বছর ধরে’; তেমনি সেই সুবাদে বাংলা সাহিত্যও পেয়েছে কালজয়ী এক উপন্যাস।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়