ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাবা দিবস

বাবার লেখালেখি ও জমিদারি : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৭ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাবার লেখালেখি ও জমিদারি : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শিলাইদহের বছরগুলোতে বাবা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন। কবিতা, গান, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বক্তৃতা নানাদিক সমান তালে তাঁর কলম চলেছে। সারাদিন ধরে তো লিখেছেনই, কখনও কখনও লেখা চলেছে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি যখন পরিশ্রম করতেন তখন খুব কম খেতেন। মা বিরক্ত হতেন, তবে এটাও জানতেন যে বাবা কোনো বিষয়ে মনস্থির করলে অন্যদের কারও কিছু করার ছিল না। পিশতুতো বোন সরলা দেবী তখন ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পত্রিকাটি বড় জ্যাঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন। পরেও সম্পাদনার ভার আমাদের পরিবারেই থেকে যায়। একসময় বাবাও এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘ভারতী’র জন্য ছোট নাটক লিখে দিতে সরলা দেবী বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন। নাটক লেখার তাড়না পাচ্ছিলেন না বলে তিনি এতে গা করেননি। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরলা দেবী পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, পরবর্তী সংখ্যায় রবি ঠাকুরের নাটক ছাপা হবে। কয়েকদিন পর তিনি বাবাকে চিঠি দিয়ে জানালেন যে, পত্রিকার কাটতি বাড়াতে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন, এখন বাবা যেন পাঠকদের হতাশ না করেন। বাবা প্রথমে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। পরদিন মাকে ডেকে বলেন যে, তিনি একটা লেখা ধরবেন, তাঁকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। এমনকি খাবারের জন্যও নয়। মাঝে মাঝে দুধ জাতীয় কিছু দিলেই খাওয়ার কাজ চলে যাবে। এ কথা বলে তিনি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। লেখা চলল টানা তিনদিন, কোনো রকম বিরতি ছাড়া। এ তিনদিন বাবা কিছু খানওনি। তৃতীয় দিনের শেষ নাগাদ লেখা শেষ হলো হাসির নাটক ‘চিরকুমার সভা’। পাণ্ডুলিপি ডাকে পাঠাতে তিনি ভরসা পেলেন না, নিজেই কোলকাতা নিয়ে গেলেন। মা জানতেন যে ‘ভারতী’তে সময়মত পাঠানোই বাবার তাড়াহুড়ার একমাত্র কারণ ছিল না। তিনি যখনই কোনো লেখা শেষ করতেন, বন্ধু-বান্ধবকে তা পড়ে শোনাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। সে সময় বন্ধুদের কেউই শিলাইদহে ছিলেন না। তাই তিনি নিজেই কোলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ কয়দিনের অনাহারে ও লেখার চাপে এতই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, জোড়াসাঁকোর বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অজ্ঞান হয়ে যান। মা তখন বাবাকে স্বাভাবিক খাবার খেতে রাজি করাতে পেরেছিলেন।

লেখালেখির চাপ যতই থাক না কেন, বাবা জমিদারির কাজ নিয়মিত তদারক করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে হিসেবপত্তর দেখতেন, কর্মচারীদের কাছ থেকে খবরাখবর নিতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্তর লিখতেন। সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। তিনি তাদের অভাব অভিযোগ শুনতেন এবং বিবাদ মিমাংসা করে দিতেন। জমিদাররা প্রজাদের সঙ্গে সাধারণত যেরকম ব্যবহার করেন তিনি সেরকম করতেন না। খুব সহজভাবে তাদের সঙ্গে মিশতেন। তারাও তাঁকে এতটাই আপন ভাবত যে নিজেদের জমি, সংসার এমনকি ব্যক্তিগত কথাও তাঁকে জানাতে ইতস্তত করত না। বাবা প্রচার করে দিয়েছিলেন যে, কোনো প্রজা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে যেন সরাসরি তাঁর কাছে চলে আসে। এতে কোনো কর্মচারীর বাগড়া দেয়ার ক্ষমতা ছিল না। এভাবে জমিদার ও প্রজার মধ্যে ভালোবাসা ও সম্মানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আমাদের জমিদারির শেষদিন পর্যন্ত এ প্রথা অক্ষুণ্ন ছিল।

কাজ আদায়ের ব্যাপারে বাবা ছিলেন খুব কড়া। কর্মচারীরা জানত, কোনোরকম গাফিলতি হলেই তাঁর নজরে পড়বে। তাদের সিদ্ধান্ত বা সুপারিশও কোনো রকম যাচাই বাছাই না করে গ্রহণ করতেন না। প্রত্যেকটা নথি দেখতেন। প্রত্যেকটা বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন এবং নিজের মতামত বা আদেশ দিতেন। কিছুদিনের মধ্যেই সরকার বুঝতে পারে যে, আমাদের জমিদারিতে কোনো অবিচার হবে না। ফলে তারা বাবার কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করত না। আর কোনো জমিদার এমন সম্মান পাননি। তিনি প্রজাদের আদালতে মামলা করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত শুধু যে দেওয়ানি বিষয়ে মিমাংসা করত তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অভিযোগের সালিশও করত। তাদের রায়ে কেউ সন্তুষ্ট না হলে পরগনার পাঁচ প্রধান মিলে আরেক দফা বিচার করতেন। সবার ওপরে ছিল বাবার কাছে আপিল করার সুযোগ। ব্যবস্থাটি বহু বছর চলেছে। এর মধ্যে একজন প্রজাও ম্যাজিস্ট্রেট বা মুন্সেফ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেনি। সরকারও আমাদের বিচার ব্যবস্থায় আপত্তি করেনি। জমিদারির এক তালুকে বাবা সম্পূর্ণ স্বশাসন পদ্ধতি চালু করেন এবং তা চমৎকার কাজ করে। তিনি কবি ও স্বাপ্নিক হলেও, তাঁর ওপরে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মহর্ষি ঠিক কাজটিই করেছিলেন, এতে কোনো ভুল নেই।

আমাদের জমিদারি ছিল সারা বাংলাতেই। নদীয়া, রাজশাহী, বগুড়া এমনকি উড়িষ্যার কটকেও আমাদের তালুক ছিল। সেগুলো তদারকি করতে বাবাকে প্রায় সবসময়ই ভ্রমণের ওপর থাকতে হতো। বাংলা নদীমাতৃক দেশ। প্রদেশজুড়ে জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদীপথে ঘুরতে বাবা পছন্দ করতেন। অন্য কোনোভাবে ভ্রমণ করে গ্রামবাংলাকে এতটা কাছ থেকে, এতটা নিবিড়ভাবে দেখা বা জানা সম্ভব নয়। নদীগুলো যেন গরু গাড়ির চাকার দাগের মতো, কল্পনার পথ বেয়ে চলে গেছে যতদূর যাওয়া সম্ভব। পথে কোথাও বাঁক নিয়েছে, কোথাও মোচড় দিয়েছে, আবার কোথাও বা ভাঁজ খেয়ে জনপদের ভিতর দিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেছে। নদী বুকে করে বয়ে আনে পলি, ছড়িয়ে দেয় দুপাড়ে। তারই ফলে বিস্তীর্ণ মাঠে প্রচুর পরিমাণে ধান, পাট, আখ, সরিষা আর অন্যান্য ফসল জন্মে। বজরার জানালা দিয়ে পল্লী বাংলার এ প্রাণপ্রাচুর্য দেখে কখনও ক্লান্তি আসার কথা নয়। ঘাটে ঘাটে কলসি কাঁখে গাঁয়ের বধূরা স্নান করতে নেমে দুরন্ত ছেলেদের এ ওর গায়ে জল ছিটানোর খেলা, নিত্যনতুন অভিনব কৌশলে জেলেদের মাছ ধরা নৌকা কানায় কানায় বোঝাই করে চাষিদের ফসল নিয়ে ফেরা, লম্বা বাঁশের ডগায় বসা ধ্যানী ঋষির মতো বাহারি মাছরাঙা, এই তো আমাদের পরিশ্রম, প্রশান্তি আর সুখে ভরপুর গ্রামবাংলার চিরকালীন চেহারা।

কুষ্টিয়া শহরটি শিলাইদহ থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে। যোগাযোগ মাধ্যম ছিল একটি কাঁচা রাস্তা। মাঝখানে গড়াই নদীর উপর ফেরি পার হতে হতো। দ্রুত বেড়ে ওঠা এ শহরটি ছিল নদীয়া জেলার উত্তরাংশে বাণিজ্যকেন্দ্র। কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশনের খুব কাছেই আমাদের কিছু জমি ছিল। বলেন্দ্র এবং সুরেন্দ্র সেখানে ব্যবসা করতে চাইলেন। তাঁরা বাবাকেও রাজি করিয়ে ফেললেন। শীঘ্রই এ তিনজনের অংশীদারিত্বে ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হলো। একটি ঘর ও কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করে তাঁরা শস্য মজুদ ও পাটের আড়তদারি শুরু করলেন। মুনাফা লাগলে ব্যবসা আরো বড় করলেন। যতই সৃজনশীল, শিল্প ও সাহিত্যমনা হোন না কেন, ঠাকুর পরিবারের লোকজন সব সময়ই টাকা উপার্জনের  জন্য উৎসুক থাকতেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের রক্ত বলে কথা!

আখচাষ লাভজনক হয়ে দাঁড়ালে এর আবাদ বেড়ে যায়। কিন্তু আখ মাড়াই করা কঠিন ছিল। তখনও আখচাষ হতো বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফলে আখ মাড়াইয়ের কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আবার পুরনো পদ্ধতিতে মাড়াই লাভজনক ছিল না। কেউ একজন একটি বহনযোগ্য মেশিন তৈরি করে। এর সিলিন্ডারগুলো বলদ দিয়ে ঘুরানো হতো। রেনউইক নামের এক ইংরেজ কুষ্টিয়ায় এ মেশিনের ব্যবসা খোলেন। তিনি অনেক মেশিন তৈরি করে মাড়াইয়ের মৌসুমে চাষিদের নিকট ভাড়া দিতে শুরু করেন। ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানিও এ ব্যবসায় ঢুকলে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ম্যানেজার অসৎ হবার ফলে ব্যবসাটি ভালো চলেনি। কয়েক বছর পর ব্যবসাটি গুটিয়ে যায়। বাবা পুরো দায়-দায়িত্ব নিজের ঘারে নিলেন। ফলে তাঁর কাঁধে মোটা অঙ্কের ঋণের দায় বর্তায়। তাঁর ব্যবসা করার সাধ এখানেই চিরতরে মিটে যায়।

বি.দ্র.: লেখাটি কবির চান্দ অনূদিত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’ বই থেকে সংগৃহীত। আজ বিশ্ব বাবা দিবস। দিবসটি স্মরণে বাবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লেখা প্রকাশিত হলো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়