ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নিমধ্যমা

নাহিদা নাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ১৯ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিমধ্যমা

হুমায়ূন আহমেদের ব্যবহৃত আলোকচিত্র : নাসির আলী মামুন

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে দেখলাম কিছু চরিত্র, কিছু ঘটনা, উদ্ভট কিছু চিত্রকল্প মাথার ভেতর জট পাকিয়ে বসে আছে। হুমায়ূনের গল্পে প্রেম মৃত্যু বিচ্ছেদ আর অবারিত রহস্যময়তা রঙিন আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একটা আমি ছুঁই তো আরেকটা ছুঁয়ে দেয় আমায়। এ এক প্রবল আত্মিক বিপর্যয়! তিনি হুমায়ূন; এক শক্তিধর মহান যাদুকর! ভালোবাসা অথবা আকর্ষণ দুটোতেই টেনে রাখে পাঠক। এ মহান জাদুকরের জাদু শেষে আমরা নিঃস্ব হই এবং নিঃস্ব হয়ে সুখী হই।

কোন মহৎ সাহিত্যের মহত্তর উপকরণ একদিনে প্রমাণিত হয়নি, জনপ্রিয়তা শব্দটি কালপ্রবাহ সাপেক্ষ নয়, পাঠক সমাদর সাপেক্ষ। তিনি জনপ্রিয়, কালজয়ী কিনা সে উত্তরের দায় ইতিহাসের সমালোচকের নয়। কথা কইবার অসীম ক্ষমতা সকলের নেই বলেই কোন কোন কথাকার সব কালেই ঘুরে ঘুরে পাঠক হৃদয়ে কথা কয়ে যাবেন আপন মনে এটাই সত্যি, তার সাথে পাঠক যদি মিলিয়ে নেয় আপনার সুর, তবেই লেখক বেঁচে রয় পাঠকের সত্তাদ্রষ্টা হয়ে, এমনটা অতীতে হয়েছে, হবে ভবিষ্যতেও। এমনি করে করেই ইতিহাসে আজ কত যে প্রাণের মানুষ, প্রবাদ পুরুষ; যেমনটা হুমায়ূন। অন্ধকার প্যাঁচা, শিশির দিয়ে আমাদের প্রাণের কাছে এসেছিলেন কোন এক কবি হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে হেঁটে দিয়ে গেছেন ‘বনলতা সেন’ নামক এক মায়াহরিণ৷ আমরা চিনেছি সেই জীবনানন্দ দাশকে৷ চিনেছিলাম শতাধিক বর্ষেরও অধিককালে৷ তেমনি হুমায়ূনকে চিনতে আমাদের কতকাল লাগবে সে প্রশ্ন থেকে গেলেও সমস্যা নেই। ভালোবাসার রক্তরঞ্জণ যার ললাটে তিনিতো চিরঞ্জীব। সোহাগীনদী, নীলগঞ্জ হাইস্কুল, গৌরীপুর জংশন বা গ্রীন ফার্মেসির পাড়া মহল্লার মানুষজন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন আমাদের নিকটে, তিনি সেই বৃষ্টির জল নোনাকাদা— যিনি ডাউনট্রেনে ভিজিয়েছেন গ্রাম ও শহর। আপাত নিঃসঙ্গ সেই চন্দ্রকারিগর কুহক আলোয় আমাদের ডেকেছেন-

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়

এসো ঝরঝর বৃষ্টিতে

জল ভরা দৃষ্টিতে

এসো শ্যামল কোমল ছায়।’


কী ছিল সে আমন্ত্রণে প্রেম নাকি বিপন্ন বিচ্ছেদ!

হুমায়ূন আহমেদ রঙিন কোলাহলে ঘুরে ফিরে শুনেছেন কত কার অচেনা ডাক৷ অনেকটা সেই বিখ্যাত গানের সুরের মতো-

"what a beautiful noise coming out from the street

got a beautiful beat

its a beautiful noise"

আমরা শুধু তার সুরে সুর মিলিয়ে ভালোবেসে গেছি পৃথিবী। মুখস্ত করে রেখেছি অদ্ভুত সব তথ্য । পদ্মদিঘি  (crystal clear water) বিষয়: লাল রং। (নসিমন বিবি)


গুহায় ঘুমন্ত আসহাবে কাহাফের আট সদস্যের নামতালিকা: মাকসেলাইনিয়া, মাসলিনিয়া, ইয়ামলিখা, মারনুশ, দাবারুশ, শযনুশ, কাফশাততাইউশ৷ (কুদ্দুসের একদিন)

নিষ্পাপ মানুষের মুখবই, সাত সাতটা দোজখ, সূর্যমন্ত্র, পরাণঢোলী পিথিমীর মইধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পী, মৎস্য শিকারের কৌশল। আমরা বুঝিনি সাহিত্যে এসব অপ্রয়োজনীয়, আমরা বুঝিনি এসব খাপছাড়া। আমরা তাঁকে ভালোবাসি বলেই তাঁর হয়ে খুঁজে এনেছি একশ এক ফানুস। হুমায়ূনকালে তার সুরে সুর মেলানো ছাড়া আমাদের বিকল্প কোন ভাবনার বোধ তৈরি হতে দেয়নি এই কথাকার, আমরা অর্থহীন আবেগে পা দুলিয়ে, মাথা নাড়িয়ে পড়ে গেছি:

উত্তরে হিমালয় পর্বত

দক্ষিণে সাগর

নদীতে সপ্তডিঙ্গায় চাঁদ সওদাগর।

আমি চুলার ধারে ধোঁয়া বেশুমার

অগ্নিবীনা রন্ধন হবে

প্রতিজ্ঞা আমার।

অগ্নি আমার ভাই

জল আমার বোন

আমি কন্যা চম্পাবতী

শোন মন্ত্র শোন

আশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি

কার্তিকে হিম

শরীরে দিয়াছি বন্ধন

আলিফ লাম মিম। (আমিই মিসির আলী)


রন্ধন উপাচারে আমরা শিল্পী হয়েছি তাঁর সাথেই:

আয় জলি বাঁয় জলি

জলির নামে মন্ত্র বলি

হাঁটু পানিতে রক্ষাকালী

রক্ষাকালীর নয় দরজা।

মাছের রাজা জামজা

মীর পীরের দোহাই লাগে

সুতার আগায় মাছ লাগে

(মীরার গ্রামের বাড়ি)

তাঁকে ভালবেসে আমাদের বাড়িগুলোর নাম রেখে দিয়েছি উত্তর দিঘি, নীদমহল, নিরিবিলি বা সুখানপুকুর।


অদ্ভুত এই হচ্ছে আমাদের হুমায়ূন আহমেদ! কেন তাকে পড়ছি তা না জেনেই তাকে ভালোবেসে কণ্ঠস্থ করছি খুঁটিনাটি সব। তাই যেকোন এক জায়গা থেকে গুছিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভাবা সম্ভব না, লেখাও সম্ভব না। তিনি চলমান। ছোট ছোট কিছু আইডিয়া, এলোমেলো ভঙ্গিতে মগজে গেঁথে দিয়ে গেছেন, এ তার হিপনোটিস্টিক প্রভাব। আমাদের তরুণ মধ্যবিত্ত কল্পনাজগতে এখনো চলছে সে মোহাবিষ্ট কাল। তার শিল্পের পুনর্চাষ। আমরা ঘুরেফিরে বার বার কেবল আমাদের কথাই বলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে তাঁর কণ্ঠে শুনেছি আমাদের কথা, আমাদের সংকট, আমাদের মোহ, আমাদের ভ্রান্তি, আমাদের প্রণয়!

কেমন করে তিনি এমন লিখেছেন? কেন লিখবেন না? তাঁরইতো লেখার কথা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে তিনি দেখেছেন পাশের বাড়ির ঈশ্বরের মতো, যে ঈশ্বর মানুষ দেখে মুচকি হাসেন, ঈর্ষা করেন আবার ভালোওবাসেন। তাই হুমায়ূন সাহিত্যের বুড়ি এলিজাবেথ থেকে আলেমুজ্জামান তারা সবাই আমরা, আমরা সবাই তারা। আমরা কঠিনে কোমল, কোমলে কঠিন। আমরা একরূপে শতরূপ। নীতু, ইরা, মীরা, পুষ্প, কুসুম,শওকত অথবা মতিন আমরা এক থেকে একাধিক হয়ে ঘুরে বেড়াই এপাড়ায় ওপাড়ায়, এগল্প থেকে ওগল্পে।


একদিকে জনপ্রিয়/ প্রবাদপুরুষের তকমা অন্যদিকে শিল্পমানহীন বাজারী লেখকের অভিধা কোনটা নিয়েই হুমায়ূন আহমেদের খুব একটা ক্ষোভ বা আবেগের আতিশয্য ছিল বলে মনে হয় না। শিল্পের চাতুর্যে চতুর কথাকার হওয়া তাঁর পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব ছিল না কিন্তু জীবন ও জগতকে সহজ আবেগী দৃষ্টিতে দেখাটাই ছিল তাঁর কাছে আনন্দদায়ক। মহৎ শিল্প বা শিল্পীদের নিয়ে বরং একধরনের কৌতুক বোধ করতেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের নামই সবার আগে উল্লেখ করা যায়। তিনি তার অজস্র গল্প উপন্যাসে রবি ঠাকুরকে কারণে অকারণে টেনেছেন। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘সবাই গেছে বনে’ কতিপয় উপন্যাসের নামকরণ ছাড়াও সঞ্চয়িতার কবিতা, গীতবিতানের অনেক গান তিনি ব্যবহার করেছেন চরিত্রের অন্তর্জগৎ নির্মাণে, এমনকি ‘তিথির নীল তোয়ালে’ উপন্যাসে বংশীবাদক নূরুজ্জামান পাতার বাঁশিতে সুর তোলে সেই সুরও রবীন্দ্রসুর "ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা" তারপরও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার হেঁয়ালিপনার শেষ নেই। কথায় কথায় অপরপক্ষকে 'তোমাদের রবীন্দ্রনাথ' বলে উল্লেখ করতেন তিনি। এই যেমন ‘নীতু আন্টি’ নামক এক চরিত্রের কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গল্প করেন একসময়। তার এক বোন নাকি মাঝে মাঝে আত্মা নিয়ে আসতেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মা। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শেক্সপিয়ার, আইনস্টাইন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ আসতেন ঘনঘন, নীতু আন্টির মতে মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব শক্তি অনেক কমে গিয়েছে, নীতুকে নিয়ে তাঁর লেখা একটা কবিতার নমুনাও সেই যুক্তি আরও জোরালো করতে উপস্থাপন করেন—

"আকাশে মেঘমালা

বাতাসে মধু

নীতু নব সাজে সেজে

নবীনা বধূ (তন্দ্রাবিলাস)

এছাড়া নারীর স্তন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রকাব্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে ইয়ার্কি করতে দেখা যায় ‘মন্ত্রসপ্তক’ উপন্যাসের ছোট চাচী চরিত্রে—

"পত্র পুটে রয়েছে যেন ঢাকা অনাঘ্রাতা পূজার কুসুম দু'টি- রবীন্দ্রনাথের মত মহামানবেরই যদি এই ভাব হয় তাহলে সাধারণ পুরুষদের অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখ" (মন্দ্রসপ্তক)

আরও একটা উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গের ইতি টানা যায়। হুমায়ূন আহমেদের এক চরিত্রের বয়ান—

একদল মানুষ আছে বাথরুম প্রেমিক... রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে আহত হতেন, কারণ বাথটাবে শুয়ে আমি শুনছি তাঁর মায়ার খেলা, সখী বলছে— ওগো কেন মিছে এ পিপাসা। ( হিমু)


আসলে মহৎ-অমহৎ বলে কিছু নেই হুমায়ূন আহমেদ চাইতেন হুটহাট পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে। পাঠককে চমকে দিয়ে তিনি নিজে আনন্দ পেতেন, অন্যকেও আনন্দ দিতেন। আপাত খেয়ালি বা অসংলগ্ন বর্ণনে অস্বস্তি যেখানে সেখানেই হুমায়ূন আহমেদের শিল্প। অনেকটা তার গল্পে উদ্ধৃত করা সুনীলের কবিতার মতই—

সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম

কেউ দেখে নি, কেউ টের পায়নি

প্রবল ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মধ্যে

মিশে গিয়েছিল আমার থুতু

তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই সমুদ্রের অভিশাপ।


কত তুচ্ছ অনুভূতির অবিশ্বাস্য শৈল্পিক বোধ!

হুমায়ূন আহমেদকে সুখবিলাসী আবার দুঃখ কারিগর দুটোই বলা যায়। তিনি প্রাণপ্রাচুর্যের তরঙ্গিত শব্দের কথামালায় নিমিষেই পাঠককে এক অনুভূতি ধারণ করার আগে আরেক অনুভূতিতে নিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর বেশিরভাগ গল্পের শুরুতে অথবা চরম ক্লাইমেক্সের চূড়ান্ত সময়ে হাস্যরসের দেবতাগণ স্বর্গ হতে বিকশিত দন্ত্যপাটি সহযোগে এগিয়ে আসতেন পাঠককূলকে টেনে হিঁচড়ে হাসিয়ে দিতে অথবা ভাসিয়ে দিতে। হাস্যরস আর করুণরসের যৌথ মিশ্রণে হুমায়ূন শৈলী একারণেই অন্যরকম।

হাস্যরসের সাথে প্রহসনের একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে। রান্না যে একটা শিল্প এবং এ শিল্প যে কখনো কখনো কোন একক ব্যক্তির কারণে প্রহসন হয়ে দাঁড়ায় তা হুমায়ূন আহমেদই হাস্যরস সহযোগে প্রথম পরিবেশন করেছেন। যেমন তাঁর সৃষ্ট এক চরিত্রের রান্না সম্পকিত বক্তব্য—

"রান্না শেষ হবার পর আধ চামুচ ফুড কালার দিয়েছি। তোর দুলাভাই ব্যাংকক থেকে এনেছিল, একচামুচ দিলেই রক্তের মত লাল হয়ে যায়৷" (আমাদের শাদা বাড়ি)


রক্ত যে বীভৎস কিছু এবং জোর করেও যে সেটা খাদ্য বানানো যায় না বরং এর উপমাও অস্বস্তির ঐ বোকা বড় আপার বোধে তা আসে না বলেই পাঠক হাসে তার নির্বোধ রসবোধে।

একি কান্ড! উপন্যাসে টুকুন আর টুকুনের ছোটফুপু অপলার কথোপকথন নিতান্তই আজগুবি তবুও অন্যবদ্য। টুকুনের একটা কাকের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠার ইতিকাহিনি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য:

ও টুকুন তুই নাকি কাকের সঙ্গে কথা বলিস?

বলি তো

তা কি নিয়ে তোদের কথাবার্তা হয়?

কোনো ঠিক নেই। একেক দিন একেকটা। ঐ দিন বললেন, টুকুন একটা গান শোনাও তো

তোকে তুমি করে বলেন?

তাতো বলবেনই, বয়সে বড় না? ওনার ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেছে।

তাহলে তো খুবই সিনিয়র লোক!

হু

তুই তাকে কী ডাকিস—চাচা?

না, আমি ডাকি কাকা। চাচা ডাকতে চাচ্ছিলাম উনি বললেন চাচা ডাকবে না, বরং কাকা ডাক। কাকা ডাকলে কাকের সঙ্গে মিল হয়, শুনতে ভাল লাগে। (একি কান্ড!)


এ তো গেলো হাস্যরসের প্রসঙ্গ। করুণ রসে হুমায়ূন আহমেদ প্রচণ্ড আবেগী, নিপুণ এবং নিখুঁত। হুমায়ূনচরিত্রেরা কাঁদে যখন তখন প্রণয়ে কাঁদে, বিচ্ছেদে কাছে, প্রাপ্তিতে কাঁদে, কাঁদে কল্যাণেও। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ উপন্যাসে পরাণঢুলির জীবিত সন্তান প্রসবকারী শাহানার চোখে আমরা যখন পানি দেখি সে পানি বড় পবিত্র লাগে আমাদের, কোমল লাগে, অজান্তে ভিজে যায় আমাদের চোখ।

"শাহানা দরজা খুলে বের হয়েছে, কোনদিকে না তাকিয়ে সে প্রায় ছুটে যাচ্ছে। সে চায় না কেউ তাকে দেখুক। তার চোখ ভর্তি পানি। চোখ ছাপিয়ে এত পানি কেন আসছে তাও সে জানে না। না সে কোনদিন বড় ডাক্তার হতে পারবে না৷ ডাক্তাররা হয় আবেগশূন্য অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক যন্ত্র৷" (শ্রাবণ মেঘের দিন)

আবেগ আর প্রেমের উল্টোপিঠে জীবনের যে কদর্যতা, বীভৎসতা—শিল্প তৈরিতে হুমায়ূন আহমেদ সেদিকেও ছিলেন সমান মনোযোগী বাস্তব যেখানে প্রায়ই নির্মম:

"মতি মিয়ার ছেলেমেয়েরা তার বাবার চারপাশে বসে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার বাবার খাওয়া দেখছে। মতি মিয়া ফিরেও তাকাচ্ছে না। তার গা দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। চোখ দু'টি মনে হচ্ছে একটু ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। আমার মনে হয় পিতলের এই বিশাল হাঁড়ির মাংস শেষ করবার আগেই লোকটা মারা যাবে। আমি হব মৃত্যুর উপলক্ষ।" (গল্প: খাদক)

একদিকে অভুক্ত সন্তান অপরদিকে বাজিতে জেতার জন্য খাদকের কুৎসিত গলধঃকরণ এই দুই মিলেই বীভৎসতা আর করুণ রসে মাখামাখি হয়ে উঠেছে তাঁর এ গল্প। এ প্রসঙ্গে আরও একটা কাহিনির খণ্ডিত অংশ উপস্থাপন করা যায়। হিমুর মামা বাড়ির প্রসঙ্গ বর্ণনায় হিমু বলে :

"হাদিসে আছে বিড়াল উপদ্রব করলে আল্লাহর নামে এদের জবেহ করা যায়, তাতে দোষ হয় না... মামা নিজেই উঠোনের তিনটা বিড়ালকে জবাই করলেন, এর মধ্যে একটা ছিল গর্ভবতী৷" (ময়ূরাক্ষী)

নারীর প্রতি নোংরা পুরুষতন্ত্রীয় মানসিকতার দিকটিও হুমায়ূন আহমেদ এড়িয়ে যাননি, তাই পুত্রবধূর প্রতিও দেখি তার ইন্দ্রিয় লালস আকাঙ্ক্ষা:

"সুরমা মশারি তুলে মাথা ভেতরে ঢুকালো, রহমান সাহেব দেখলেন তার ফর্সা হাত এগিয়ে আসছে পায়ের দিকে। আহ কী ফর্সা হাত মেয়েটার!" (গল্প: সুখ অসুখ)

যাক এসব টুকরো অংশে যে হুমায়ূন আহমেদ সূক্ষ্ম জীবনবাদী শিল্পী সে হুমায়ূন আহমেদই আমাদের আলোচ্য নন, তিনি যেখানে শিশুর মতো সরল, বলায়, কলায় একেবারেই নিষ্পাপ সেখানেও আমরা হুমায়ূন আহমেদের শিল্পীসত্তা খুঁজি। এই যেমন পিপলী বেগমের গান:

"ভালো লাগছে ভালো লাগছে।

আমার বড় ভালো লাগছে

মজা লাগছে মজা লাগছে

আমার বড় মজা লাগছে

আনন্দ হচ্ছে আনন্দ হচ্ছে

আমার বড় আনন্দ হচ্ছে।" (পিপলী বেগম)

এই অর্থহীন আবোল তাবোল রচনা হুমায়ূন জনপ্রিয়তার পেছনের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আদতে তাঁর একটা মন পৌঢ় ঋদ্ধ কথাকার হলেও আরেকটা মন শিশু তাই হেঁয়ালি, ধাঁধা, ছড়ার প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ:

ধাঁধা :

বাঘের মত লাফ দেয়,

কুকুরের মত বসে

লোহার মত জলে ডুবে

শোলার মত ভাসে (গল্প: ভয়ংকর ভূতুরে)


কাটলে বাঁচে, না কাটলে মরে

এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে? (গল্প: জিন কফিল)


হেঁয়ালি :

ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান

কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান৷ (নীল অপরাজিতা)


বচন:

উঁচু কপালী চিরলদাঁতি

পিঙ্গল কেশ

ঘুরবে কন্যা নানান দেশ। (তোমাদের এই নগরে)


হুমায়ূন পাঠকরা বারবার প্রেমে পড়ে হুমায়ূন রমণীদের সরল অথবা দুর্বোধ্য নৈকট্যে অথবা দূরত্বে। প্রেমিক পুরুষের মতই খেয়াল করে দেখে তাঁর সৃষ্ট সকল রমণীসকল অসম্ভব রূপবতী, সে রূপবতী মায়াবতী রমণীকূলের জন্য পুরুষ সহস্রবছর আওড়ে যায়

"ও রিংয র পড়ঁষফ নব বরমযঃববহ ধমধরহ" তাদের বাঁ চোখের নিচে চোখে পড়ার মতো থাকে কালো তিল তবু মোহরের মায়েদের মত কিছু কুচুটি বৃদ্ধা মগজে এসে কুট করে কামড় দিয়ে করে যায় সে রূপের সমালোচনা—

"রূপ আর কয়দিনের?

নিমতা ফুল যয়দিনের৷" (অচিনপুর)

হায় রূপ, হায় নিমতাফুল!

রহস্যাবৃত মানবমনের জটিল সব কৌণিক অংশে বিচরণ করে হুমায়ূন আহমেদ পৌঁছে ছিলেন হৃদয়ের নিমধ্যমায়। তিনি রহস্যপুরুষ তবুও এই তাকেই দেখি চেনা গণ্ডির সীমানায় অবাধ বিচরণ অর্থাৎ স্থানিক দিক থেকে তিনি রয়ে যান সেই মইমনসিংয়ে, দূর্গাপুরে বা নেত্রকোণায়৷

গৌরীপুর রেলস্টেশনে ভোর হয়।

চারদিক ঘন কুয়াশা

টু ডাউন মোহনগঞ্জ—ময়মনসিংহ প্যাসেঞ্জার স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে।


সেই ট্রেন যেন ঘুরে ঘুরে ময়মনসিং ছেড়ে আবার কোথায় যায় জানি না, একটু দূরে আউটার সিগনাল অন্তু ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় পুতুলকে অথবা আমাদের

"লাফ দিয়ে নামুন লাগবো"

পুতুলের সাথে আমরাও অবাক হয়ে প্রশ্ন করি "কেন?"

ইস্টিশনে মবিল কোর্ট আছে! অর্থাৎ আমরা খুব দূরে যাই না কাছেই থাকি ঘুরেফিরে।

চরিত্রগুলো তেমনই স্থানের মতই স্থাণু। চলমান হয়েও একরুপে পৌণপৌণিক আগমনে পাঠককে দ্বিধায় ফেলে বারবার। বৃত্তাবদ্ধ নামকরণের অভ্যেসে আমরা ভুলে যাই এইতো কিছুক্ষণ আগে জাহানারা হয়ে ঠোঁট উল্টে আহসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম "ভাবি মারা গেছে? কী কন ভাইজান?" সেই একই আমি অন্য জাহানারা হয়ে মনজুরের হসপিটালের কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি ছোটভাই ফরিদকে নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ভুলিয়ে দেন আমরা কে কখন কোথায় ছিলাম। অথবা তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা কোথায় ছিল।

আসলে এভাবেই একজন মহৎ শিল্পী বেঁচে থাকেন অনন্তকাল, স্রষ্টা নশ্বর সৃষ্টি অবিনশ্বর, কালপ্রবাহ শুধু ধায় শুধু ধায় কোনদিকে নাহি চায়। আমরা সে স্রোতে হারিয়েছি তাকে, কিন্তু মহাকালের মাঝে অভিযাত্রী হয়ে নিরন্তন খুঁজে যাই তাঁর পদছাপ। বিখ্যাত সেই উক্তির মতো:

when he was dead

he hopes it may be said

"my sins were scarlet, but my books were read"

তাই আমরা চাইতেই পারি তাঁর পাপগুলো রঙিন হয় হোক তবু তার বইগুলো পঠিত হোক ঠিকঠাক।

সবশেষে গীতার সুরে প্রার্থনা:

"তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যের্মামৃত গময়"

আমিত্বের খোলস ছেড়ে যদি শিল্পীর কল্যাণে আজ আমরা তার জন্যই বলি, "হে ঈশ্বর তাকে অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে অমৃত্যুতে"— আমাদের প্রার্থনায় তিনি কি পৌঁছে যাবেন এমন কোথাও যেখানে শুধু আলো আর আলো? হয়তো যাবেন। অবশ্যই যাবেন!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়