ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অনন্তের মুখোমুখি শূন্যতায় হেমিংওয়ে

দিত্তা আলাউদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২০, ২১ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনন্তের মুখোমুখি শূন্যতায় হেমিংওয়ে




১৯৬১ সালের ২ জুলাই, সময়ের একজন দক্ষ গল্পকার ও অতি পৌরষভরা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে আত্নহত্যা করেন। অথচ তিনিই বলেছিলেন ‘জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছি পশু আর মাছ শিকার করে, সুতরাং আমি কখনও আত্নহন্তারক হবো না’। সবকিছু উল্টে গেল। তিনি আত্নহন্তারক হয়ে পর্যুদস্ত ও পরাজিত হবার রক্তে ভাসিয়ে দিলেন জীবন। যে ছোট ছেলেটি একটানা ৮৪ দিন মাছ না পেয়েও সান্দিয়াগের প্রতি অবিচল বিশ্বাস রেখেছিল- তাকে সমুদ্রে ভাসার, মাছ ধরার আরও কিছু কৌশল জানিয়ে যেতে পারতেন। তারপর দু’জনে মিলে সত্যিই আর একটা নিটোল মারলিন মাছ ডাঙ্গায় তুলতে পারতেন। কী অসাধারণ প্রতীক ব্যবহারের কৌশল জানাতে হেমিংওয়ে, ঐ একরত্তি ছেলেটাকে দিয়ে দেখালেন সবাই চলে গেলেও কেউ না কেউ থাকে যায়, একেবারেই বিমুক্ত ও নির্ভেজাল। কত অল্প কথায় কত গভীর বেদনার কথা তিনি বলতে পারতেন তার একটা উদাহরণ হলো- ‘বিক্রয়ের জন্য নবজাতকের জুতা, যা কখনও পড়া হয়নি’।

সতেরো বছর বয়সে তিনি ক্যানসাস সিটির একটি পত্রিকা অফিসে লেখক হিসেবে যোগ দেন। প্রথম মহাযুদ্ধ কালে ইতালিতে নিয়জিত অবস্থায় আহত হন এবং কিছুকাল পরেই আমেরিকা ফিরে এসে ক্যানাডিয়ান ও আমেরিকান পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। এরই কিছুদিন পর তিনি ইউরোপে নিযুক্ত হন গ্রীক গৃহযুদ্ধের পর্যবেক্ষণের খবরাখবর জানাতে।

শেরউড এন্দারসনের আমন্ত্রণে তিনি ১৯২১ সালে, ‘টরেন্টো স্টার’ পত্রিকার বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে প্যারিসে আসেন। এখানেই তিনি গ্রটউড স্টেইন, জেমস জয়েস, এজরা পাউন্ড, এফএস ফিট জেরাল্ড, পাবল পিকাসো এমনি আরও বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে আসেন। তার এই সময়ের জীবনের প্রতিফলনকে কেন্দ্র করে তিনি ১১২৬ সালে তার প্রথম উল্লেখজনক উপন্যাস ‘দ্যা সান অলসো রাইজেস’ প্রকাশ করেন। ১১২৯ সালে ইটালিয়ান ফন্টের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তার আরেকটি উপন্যাস ‘ফেয়ার অয়েল টু আর্মস’ সমানভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘ফর হুম দ্য বেল টুলস’, হেমিংওয়ের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষি উপন্যাস। এর প্রায় দশ বছর পর তিনি একটি বিস্ময়কর বড় গল্প বা ছোট উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ লেখেন। যা ১৯৫৩ সালে পুলিৎজার আর ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়। বলা যায় তিনি তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো লিখে গেছেন ১৯২০ সাল থেকে ১৯৫০ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত।

১৯৩৩ সালের ১০ মে বার্লিনে তার লেখা ‘আধুনিক অবক্ষয়ের নমুনা’ হিসেবে পোড়ানো হয়। আর এই কাজটিই প্রমাণ করে যে, তিনি নতুন এক শৈলীর জগত সৃষ্টির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন। তাকে উপেক্ষা করা যায়নি। তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গি অনেকের কাছে যেমন ছিল কর্কশ, অপরিচিত, অসভ্য ও আবেগহীন তেমনি অনেকের কাছে ছিল তা সময়ের কণ্ঠস্বর এবং একান্ত প্রার্থনীয়।
হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১), তার সমসাময়িকদের চেয়ে কিছুকাল বেশি বেঁচে ছিলেন। অন্তত পরিমাণে লিখেছেনও প্রচুর। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে তার সকল অন্তরঙ্গ বন্ধু একে একে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অত্যন্ত সহজ ভাষায় ছোট ছোট বাক্য প্যারাগ্রাফ আর জোরালো ভাষা ব্যবহার করতেন তার লেখায়। বলা হয়ে থাকে তার লেখা পড়তে গিয়ে কখনও অভিধানের পাতা ওল্টাতে হয় না। লেখার দুটি বিষয়ের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। এক. যতটুকু না বলে গল্পটা বলা যায়, তা না বলা। এবং দুই. হিমশৈলের মতো উপরের অল্পটুকু দেখানো আর নিচের বিস্তার অংশটুকু রেখে দিতেন পাঠকের প্রাজ্ঞতার উপর। সাহিত্য তত্ত্বে একে ‘অমিটেড থিউরি’ বা ‘আইস বার্গ’ থিউরি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই তত্ত্ব দাবি করে যে একজন সার্থক লেখক পাঠককে টের পাইয়ে দেন গল্পের ভেতরের আরেকটি গল্পকে। তিনি মনে করতেন যা লেখক এবং পাঠক উভয়েরই জানা তা লেখা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন।

সাহিত্যিক হিসেবে তার সততার জায়গাটি ছিল, তিনি যা কিছু লিখেছেন তার প্রায় সবই আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং তাই তাকে করেছে সাহসী, ভয়শূন্য এবং সমালোচনার যোগ্য ও অর্থবহ। লেখালেখির ভেতরেই তিনি চেয়েছিলেন জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান। যুবক বয়সে হেমিংওয়ের খ্যাতি ছিল শিকারি, পরিশ্রমী এবং জনপ্রিয় এবং সাহিত্যের প্রিয়তম একজন হিসেবে। তিনি কিঞ্চিৎ সুরাসক্ত ছিলেন বরাবর কিন্তু দু’দুবার উড়োজাহাজ ক্রাশ থেকে বেঁচে গিয়ে হয়ে উঠলেন মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপায়ী। এই অতিরিক্ত পানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তার ওপর পড়তে শুরু করে, যদিও তিনি তা স্বীকার করতেন না। এর মধ্যে আরও একটি আতঙ্কে তিনি জড়িয়ে পড়েন, তা হলো তিনি প্রায়ই বলতেন- এফবিআই তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। ফলে তিনি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। ইত্যাদি নানা কারণে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা হলেও ভারসাম্য হারান।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখার মধ্যে আমরা পাই আশাবাদ, অধ্যবসায়, বন্ধুত্ব ও মনুষ্যত্ব আর নিজের সান্নিধ্যকে ভালোবাসতে শেখা। অথচ জীবনের মধ্যভাগে এসে কেন সে এর সবই ত্যাগ করলেন নিজেকে হত্যার মাধ্যমে- কি তার উত্তর?

হেমিংওয়ের শেষ উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ লিখতে মাত্র আট সপ্তাহ নিয়েছিলেন তিনি, এবং এতে কোনো নীতি-নৈতিকতার কথা নেই। উপন্যাসজুড়ে আছে লেখকের আত্নগত গভীর উচ্চারণ, অসাধারণ চিত্রকল্প এবং শব্দ আর বাক্যের অসম্ভব সুন্দর সব বিন্যাস। উপন্যাসটির শেষ পর্যায়ে আছে সান্ডিয়াগো, তার নৌকা আর মারলিন মাছের কঙ্কাল পাশাপাশি শুয়ে আছে। তখন হয়ত সান্ডিয়াগো আর বেঁচে নেই। তবে তার অবয়বে অপমানের চিহ্ন মাত্র ছিল না। ছিল কৈশোরে আফ্রিকার দেখা উপকূলে লেখা সিংহ শাবকদের শঙ্কাহীন দৃপ্তি। তিনি স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। ছিলেনও অনেকখানি তার একমাত্র মূল্য একাকীত্ব, কড়ায়-গন্ডায় দিয়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। তার এ পর্যন্ত সাতটি উপন্যাস, ছয়টি গল্পের সংকলন এবং দুটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি উপন্যাস, চারটি গল্পগ্রন্থ এবং দুটো প্রবন্ধ সংকলন তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। তার অনেকগুলো কাজকে আজ আমেরিকান ক্লাসিকস হিসেবে গণ্য করা হয়। যদি কোনো লেখক সম্পূর্ণরূপে জানেন যে, তিনি কি লিখতে যাচ্ছেন, তখন তিনি সে অংশগুলো বাদ দিতে পারেন যা তিনি এবং তার পাঠকেরা জানেন। একজন লেখক যখন সত্যের মুখোমুখি হয়ে লিখতে বসেন, তবে সে লেখকের মনে জাগবেই সে অনুভূতিগুলো শীতের মত তীব্র হয়ে।

১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে নোবেল লরিয়েট হিসেবে তার নাম ঘোষিত হওয়ার পর তিনি বিনয়ের সাথে জানিয়েছিলেন পুরস্কারটি কার্ল সেন্ডবার্গ, আইজাক ডেনমেন বা বার্নার্ড বেনসনের পাওয়া উচিৎ ছিল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নোবেল পুরস্কারের লিখিত বক্তব্যের খানিকটা ছিল এরকম:
‘লেখা সবচেয়ে ভালো হয় যখন জীবন হয় একা, বিভিন্ন প্রয়োজনে এই একাকীত্বের কিছুটা উপশম করে কিন্তু আমি মনে করি না যে, তা তার লেখার উৎকর্ষতার কোনো কাজে লাগে। জনসমষ্টির মাঝে সে বড় হয়ে উঠতে পারে তার একাকীত্ব বিসর্জন দিয়ে। কিন্তু তা অবশ্যই তার ক্ষতি করে। কারণ তা তাকে একাই করতে হয় এবং সে যদি সত্যি একজন উৎকৃষ্ট লেখক হন তবে তাকে অনন্তের মুখোমুখি হতে হবে শূন্যতার, প্রতিদিন।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়