ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ধ্রুব এষ-এর রহস্য গল্প || কাফকা সিনড্রোম

ধ্রুব এষ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪০, ৩০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধ্রুব এষ-এর রহস্য গল্প || কাফকা সিনড্রোম

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

ফল এ স্লিপ ফার্স্ট

ডিপ স্লিপ।

মেডিটেশন মিউজিক।

শুনলে সত্যি ঘুম ধরে যায়।

দেখতে দেখতেও।

মিউজিকের সঙ্গে ভিডিও আছে। অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র, আকাশের ভিডিও। দেখতে দেখতে ঘুম ধরে যায়।

সে অবশ্য কখনও দেখতে দেখতে ঘুমায়নি। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রিপিট দিয়ে রাখে। ঘুম থেকে উঠে পাহাড় দেখে ঘরে। না হলে অরণ্য। না হলে মেঘদল। সকালটা তাতে খুব দারুণভাবে শুরু হয় তা না। সে ঘুমায় রাত সাড়ে ৩টা-৪টায়। ঘুম থেকে উঠে ১১টা-সাড়ে ১১টায়। কোনও কোনও দিন আরও দেরি হয়ে যায়। ১২টা-১টা বেজে গেছে দেখে।

ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দিতে হয়। হাঁটা দূরত্বে মোটামুটি একটা রুটি রোজগারের জায়গা তার আছে। ‘অবসর বিনোদন’ বলে একটা পাক্ষিক পত্রিকার অফিস। ১ বছর ২ মাস ধরে সে আছে এই পাক্ষিকে। এর আগে ছিল একটা দৈনিকে। ফকিন্নি দৈনিক। ৬ মাস পর হয়ত দেড় মাসের বেতন একসঙ্গে দিল, ৮ মাস আর কোনও খবর নাই। এদিক থেকে ‘অবসর বিনোদন’ ঢের ভালো। ১ তারিখের বেতন তারা ১ তারিখেই দেয়। কোনও কারণে ১ তারিখ বন্ধ থাকলে আগের মাসের ২৮, ২৯, ৩০ নয় ৩১ তারিখে দিয়ে দেয়। দুই ঈদে বেতনের ডবল বোনাস। পায় কে আর?

‘অবসর বিনোদন’-এ জয়েন করে হঠাৎ সামান্য ধনী হয়ে গেছে সে। আঙুল ফুলে কলা গাছ না হোক ছোট সাইজের ঢেঁড়স গাছ হয়েছে। ‘হলিউড’ ছেড়ে ‘মারলবোরো’ ধরেছে। মারলবোরো লাইট। দেখতে সুন্দর প্যাকেটটা। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের ভয় ধরানো ছবি সত্ত্বেও!

তার ঘুম ধরছে।

চোখ ভার হচ্ছে।

টিভির মনিটরে পাহাড়ের দৃশ্য।

তার কি আজ মন খারাপ ছিল?

মন খারাপ ছিল?

মন খারাপ ছিল?

সে আর মনে করতে পারছে না।

কষ্ট?

একটু।

ঘুমিয়ে পড়ল সে।

চারুকলার স্টুডেন্ট। গ্রাফিক ডিজাইনের বিএফএ করে আর পড়েনি। ‘অবসর বিনোদন’-এর স্টাফ আর্টিস্ট এখন। অফিসে নিজস্ব একটা খুপরি তার আছে। ওয়ান এইট সাইজের ম্যাগাজিন, ৯৬ পৃষ্ঠা, ‘অবসর বিনোদন’ লোগোর নিচে ট্যাগ লাইন থাকে-

অবসর বিনোদন

অবসরে পড়ুন

প্রদায়ক ইউসুফ ভাই পুংটার বাপ অ. বি. হাউসের। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল:

‘অবসর বিনোদন

অবসরে করুন’

ব্যাপক লাইক, কমেন্ট ইত্যাদি। সম্পাদক পীর হাসিব ভাই ডেকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন, ‘এসব কী ইউসুফ?’

‘কোনটা হাসিব ভাই? কোনটা কী?’

‘ফেসবুকে এটা কী স্ট্যাটাস দিয়েছ?’

‘কেন হাসিব ভাই? অবসর বিনোদন কি অবসর সময়ে করতে হয় না?’

কলকাতার সিনে ম্যাগাজিন ‘আনন্দলোক’ খুবই প্রিয় ইউসুফ ভাইয়ের। তারা কারিনাকে লেখে করিনা, কারিশমাকে লেখে করিশমা। ‘আনন্দলোক’ দুই ‘কপুর’ বোনকে নিয়ে লিড স্টোরি করেছিল একবার। সেই স্টোরির একটা সচিত্র পৃষ্ঠা তার এফবি পেজে শেয়ার দিয়েছিল ইউসুফ ভাই। সঙ্গে কমেন্ট:

‘করিনা

করি না

করিশমা

করিস মা’

হোয়াট টু ডু মিটিঙে বসে ইউসুফ ভাই-ই একমাত্র নির্বিকার গলায় পীর হাসিব ভাইকে বলতে পারে যে, ‘অবসর বিনোদন’ সেলেব্রিটিদের লঝেঁরি নিয়ে কেন স্টোরি করছে না?

‘লঝেঁরি নিয়ে স্টোরি! তুমি কী বলতে চাচ্ছ, ইউসুফ?’

‘অন্তর্বাস, হাসিব ভাই। কোন সেলিব্রিটি কোন সাইজের ব্রা পরে, কোন সাইজের প্যান্টি পরে এইসব আর কি।’

লুপলিকা বাম রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। নারীবাদী কিছুটা। খেপে গিয়েছিল, ‘মেয়েদের অন্তর্বাস কেন শুধু তাহলে? ছেলেদের অন্তর্বাস নিয়েও তো স্টোরি হতে পারে।’

ইউসুফ ভাই লাইভ, ‘অবশ্যই। কে কোন সাইজের আন্ডারওয়ার পরে, রবীন্দ্রনাথ কি আন্ডারওয়ার পরতেন, এইসব থাকতে পারে স্টোরিতে।’

‘আপনি একটা অসভ্য লোক।’

‘অবজেকশন, হাসিব ভাই। লুপলিকা ঠিক বলল না কথাটা। আমি মোটেও অসভ্য লোক না। অসভ্য লোকরা আন্ডারওয়ার পরে না। আমি পরি। আমার আন্ডারওয়ার চৌত্রিশ সাইজের।’

তাদের সঙ্গেও ছিল এক ইউসুফ। পিডব্লিউডির অফিসারের ছেলে। ফোর, ফাইভ, সিক্স- এই তিন ক্লাস ছিল তদের শহরে, তাদের সঙ্গে পড়েছে। ইমরুল ইউসুফ, রোল নাম্বার ফোরটিন। মনে আছে এখনও। ক্লাস সিক্স বি সেকশনে ইউসুফের রোল নাম্বার ছিল ফোরটিন। আবদুল খালেক স্যার তাদের সমাজ পাঠ পড়াতেন। পড়া যখন ধরতেন এভাবে ডাকতেন।

বিশ্বজ্যোতি দত্ত, রোল নাম্বার ওয়ান।

ফরিদ আহমেদ, রোল নাম্বার সেভেনটিন।

শুভঙ্কর তালুকদার, রোল নাম্বার ফাইভ।

ইউসুফ ছিল লাজুক, মুখচোরা কিছুটা। কথা কম বলত। স্কুল ছুটির পর একদিন বলেছিল, ‘শোন, এখন থেকে তোরা আমাকে হেনিবল বলে ডাকবি।’

‘হেনিবল। হেনিবল কী?’

‘আমার নাম।’

‘তোর নাম তো ইমরুল ইউসুফ। হেনিবল হলো কোনদিন?’

‘কাল রাতে আব্বা বলেছে। আমি হলাম হেনিবল দ্য গ্রেট। তোরা শুধু হেনিবল ডাকবি।’

‘আচ্ছা, ডাকব।’

সিক্সের ষান্মাসিক পরীক্ষার পর পরই দুঃখের সংবাদ দিয়েছিল হেনিবল। তার আব্বা বদলী হয়ে গেছেন। পঞ্চগড় বলে এক জায়গায় চলে যাবে তারা। কী কষ্ট! কী কষ্ট!

হেনিবল ইউসুফকে হৃদয় বিদারক ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল তার ক্লাসের বন্ধুরা। ক্লাসকবি আবিদুর সেই উপলক্ষ্যে একটা কাব্য রচনা করেছিল এবং আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে সেটা পাঠ করে সকলকে অশ্রুসিক্ত করে দিয়েছিল। আবিদুরের সেই অমর কাব্যের শেষ দুটো পঙ্‌ক্তি ছিল এরকম:

‘সুখে-দুঃখে আনন্দ বেদনায় তুই ছিলি হেনিবল

তোর মতো প্রিয় বন্ধুকে মোরা কি করিয়া ভুলিব বল?’

হেনিবল ইউসুফ এখন থাকে আমেরিকায়। বিয়ে করেছে এক সেনেগালিজ মেয়েকে। এক মেয়ে, এক ছেলে তাদের। মেয়েটা দেখতে, খুবই আজব, সুপার মডেল নাওমী ক্যাম্পবেলের মতো হয়েছে।

ধোপাখালি ঘাটের তৈয়ব আলী মুহুরীর মেয়ে নাফিসা ছিল তাদের শহরের মিস ইউনিভার্স। নাওমী ক্যাম্পবেলের মতো দেখতে। তুষার, মুস্তফা, শামীম, নজরুল, কম লাইন দেয়নি। এই নাফিসা কিছুদিন আগে ধরা পড়েছে উত্তরা, সেক্টর-আট থেকে। তোলপাড়মূলক নিউজ হয়েছিল মিডিয়ায়। লাইভ দেখিয়েছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং কিছু অনলাইন পোর্টালে। নিষিদ্ধ কী এক জিহাদী সংগঠনের নারী নেত্রী হয়ে গেছে নাফিসা। বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড, পিস্তল, গুলি, মোবাইল ফোন এবং জিহাদী বই পত্রসহ তাকে গ্রেফতার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। র‌্যাব-এর কমান্ডার বলেছেন, ঈদের আগে কয়েকটা শপিং কমপ্লেক্সে নাশকতার পরিকল্পনা ছিল এই জঙ্গিবাদী নারী নেত্রীর। কাশিমপুর কারাগারে আছে এখন নাফিসা।

ছাড়া ছাড়া চিন্তা, ছাড়া ছাড়া ঘুম।

সাড়ে ৩টার দিকে সে একবার উঠল। প্রস্রাব করে সময় দেখল মোবাইল ফোনের ঘড়িতে। ৩টা ৩৩ বাজে। এরকম আরও কিছু সময় মনে পড়ল তার।

১২:১২

০৯:০৯

১১:১১

০৫:৫০

সময় না, টেক্সট।

তাকে টেক্সট করত।

সেও টেক্সট করত।

সংকেতের মতো হয়ে গিয়েছিল।

১২:১২ টেক্সট করার মানে কী?

আমি আছি, তুমিও থাক।

০৯:০৯?

আমি আছি, তুমিও থাক।

১১:১১?

ঐ।

০৫:৫০?

ঐ।

এসবের কোনও মানে হয় আর?

আবার বিষাদ তাকে ধরল।

পৃথিবীর সব বিষাদ।

এরকম কেন? এরকম কেন?

কত বছর ধরে একটা সম্পর্ক?

মাত্র একটা টেক্সট-এ শেষ হয়ে যায়?

শুয়ে আবার সে টেক্সটটা পড়ল। অনেকবার পড়েছে। আবার পড়ল।

: না। তোমার কোনও

দোষ নাই। আমি

একটা কুকুর। আমার

কোনও কন্ট্রোল থাকে

না। ফরগিভ

মি। ঠিক আছে কয়েকদিন

দূরে থাকি... ট্রাস্ট মি

আই লাভ ইউ ভেরি

মাচ। আমার পেরেন্টসের

পর আমি তোমাকেই

ভালোবাসি...আমার

কোন আচরণে কষ্ট পেলে

মাফ কোরো আমাকে...

ইভেনচুয়ালি তুমি

খুব ভালোমানুষ

এভার আই মিট...

সেন্ট: ১০.৫১.৩০ পিএম

গতরাতে।

আরও টেক্সট করেছে পরে।

: আই অ্যাম আ ব্যাড গার্ল

...ফরগেট এন্ড

ফরগিভ মি।

সেন্ট: ১১:৪৯:৩৮ পিএম

পরশু রাতে তারা ছিল একসঙ্গে। সে কিছু চায়নি। একটা চুমু কি একটু স্পর্শ। রেড ওয়াইন এবং দেশাল তামাক। কিছু ধরে গিয়েছিল হয়ত, সব নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিল ইনকা। ‘হাউ টু সিডিউস ইয়োর ফ্রেন্ডস ড্যাড’- এর ক্লডিয়া ভ্যালেনটাইন হয়ে গিয়েছিল। ডিডিএফ প্রডাকশনের পর্নফিল্ম, ‘হাউ টু...।’

সে তার টেক্সটটাও পড়ল।

: রাগ করে বলছি

না। তুই কিছু দিন

আমার কাছে আসিস

না। আমি কি

চেয়েছিলাম কিছু?

শেষ পর্যায়ে যখন

বুঝলাম অনিচ্ছুক

ব্যাপারটা এবং

আমার করার

কিছু নাই,

কষ্ট-টষ্ট

না, কুকুর-কুকুর

মনে হচ্ছিল নিজেকে।

ভালো থাক তুই।

নিজের মতো

থাক। পরে দেখা

হবে একদিন।

সেন্ট: ১১:৫৮:০২ পিএম

সেন্ট টেক্সট সে সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দেয়। এটা করেনি। এখন করল। আর কোনও সেন্ট টেক্সট তার ফোনে থাকল না। ইনবক্সে? এর ওর মিলিয়ে ৮শ’ ২৬টা টেক্সট। ডিলিট করে দিল। করে বুঝল সর্বনাশ করে ফেলেছে। ৮শ’ ২৬টা টেক্সটের মধ্যে ৮-৯টা টেক্সট অন্তত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার জন্য। মউজদীন ভাই, ফরিদ, আপ্পাদার টেক্সট। মিস রেইনের টেক্সট। মর্মরের টেক্সট।

কখনও এই পৃথিবীতে একটা আশ্চর্য মেয়ের নাম ছিল মর্মর। ফিলোমিনা দাস মর্মর। সাংবাদিক নিকোলাস দাসের মেয়ে। মহা এই নগরে প্রথম বন্ধু তার। চারুকলায়, স্কাল্পচারে পড়ত। ফ্রান্সে স্কলারশিপ পেয়েছিল। যায়নি। আত্মহত্যা করেছে। কেন? বিয়ে করেছিল পেইন্টিং-এর নীলকণ্ঠদাকে। নীলকণ্ঠ শর্মা। আজব ভালো মানুষ। তার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, এরকম কখনও বলেনি মর্মর। তাহলে? আত্মহত্যা করে কেন মানুষজন?

: তুই একটা ভূত

তোর বউটা

একটা ভুত্নী।

শমিতাকে প্রথম দিন দেখে এই টেক্সট করেছিল মর্মর। আর একটা টেক্সট করেছিল আত্মহত্যার কিছুদিন আগে। টেক্সট না কবিতা?

মর্মর কবিতা লিখত। ইংলিশে টেক্সট করেছিল।

: WHY YOU are here?

: TO KILL A

mocking bird

: where is the

bird?

: in the mirror

 

And in the mirror

there lived a soul.

cruel, taught in

all devauch. AND

I

o

n

e

L

Y.

টেক্সট পেয়ে টেক্সট করেছিল সে, ‘মকিংবার্ড কী?’

বাংলায় উত্তর দিয়েছিল মর্মর, ‘হরবোলা পাখি।’

এই এপ্রিলে অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী গেছে মর্মরের। ফেসবুকে লিখেছে অনেকে। নীলকণ্ঠদা আর বিয়ে করেনি।

৩টা ৫৩ বাজে।

ইনকা কি ঘুমায়?

আচ্ছা, ইনকার প্রতি তার কি লিবিডো ছিল না?

ছিল।

ইনকা জানত না?

জানবে না কেন?

তারপরও পরশু রাতে যা ঘটেছে, এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করে তারা? একদিন না একদিন কি এরকম ঘটত না? সে শুধু চিন্তা করেনি এতটা ভালোবাসাহীন হবে বিষয়টা। চার বছর আগে শমিতার সঙ্গে তার আইনগত ভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে। এই চার বছরে মাত্র একবার সে একটা রেস্ট হাউসে গিয়েছিল। ভালো লাগেনি। সেও আড়াই বছর আগের ঘটনা। ফেইক শরীর তার ভালো লাগে না। আর বড় একটা ফ্যাক্টর এসেন্স। শরীরের ঘ্রাণ। সব শরীরের ঘ্রাণ একরকম না। সব ঘ্রাণ নিতে পারে না সে। আত্মরতি নির্ভর শীতঘুমের দিনগুলো তো কেটেই যাচ্ছিল। ইনকা সেই শীতঘুম ভেঙে দিল কেন? আশ্চর্য ঘ্রাণ ইনকার শরীরের। তেতেমেতে উঠেছিল সে। উষ্ণ স্বপ্নময় মনে হচ্ছিল মুহূর্ত। সব একেবারে চূরমার হয়ে গেল শেষ মুহূর্তে ইনকা যখন ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোমার হয় নাই?’

সঙ্গে সঙ্গে বিষাদের এক চক্রবুহ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল সে। সারা পৃথিবীর সব বিষাদ। কাটছে না আর। কাটছেই না।

‘অবসর বিনোদন’-এ ভালো থাকে সে। যতক্ষণ থাকে আনন্দে থাকে। কিন্তু তার নিজস্ব দিন রাত? একা এবং একা। মানুষ হিসাবে সে হয়ত অস্বাভাবিক আছে কিছুটা। এত বড় একটা মহানগরে তার ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক মাত্র ৪-৬ জনের সঙ্গে। ইনকা সেই ৪-৬ জনের একজন। দুর! অযথা এত জটিল চিন্তা করছে সে। ঠিক যে ইনকা একরাতে তাকে একটা পিঁপড়া বানিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তাতে কী?

ইনকার দুটো নাম্বার আছে তার ফোনে। কাল সকালে উঠে ডিলিট করে দেবে। না, এখন। ডিলিট করল। অযথা কল দিল শমিতার নাম্বারে। শমিতা এখন ঘুমিয়ে আছে তার জামাই এবং বাচ্চাটাকে নিয়ে। তিন মাস আগে হয়েছে বাচ্চাটা। তারা বাচ্চার নাম রেখেছে শালিখ। ‘ক’ না, ‘খ’ দিয়ে- শালিখ। বাবা মা নিয়মিত শালিখের ছবি তাদের ফেসবুক পেজে আপলোড দেয়। ইনস্টাগ্রামে, টুইটারে দেয়।

‘ফল এ স্লিপ ফাস্ট’ চলছে।

সবুজ হয়ে যাচ্ছে ভিডিওর শাদা মেঘদল। রূপ নিচ্ছে গাছ গাছালির। দেখতে দেখতে আবার ঘুম ধরল তার। অরণ্যকে সমুদ্রের ঢেউ হতে দেখল না সে। শুভ্র সমুজ্জ্বল ঢেউ।

আবার রিপিট হলো মেঘদল।

আবার রিপিট হলো অরণ্য।

আবার রিপিট হলো ঢেউমালা।

আবার রিপিট হলো পাহাড়ের সারি।

হতেই থাকল। হতেই থাকবে।

সে দেখল তার খাটের পাশে বসে আছে একজন। সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে। বিদেশী চেহারার একজন মানুষ। চেনা লাগল কিছু। কোথাও দেখেছে। কিন্তু এই লোক তার ঘরে কেন? ফ্ল্যাটের দরজা কি খোলা ছিল? না হলে ঢুকল কীভাবে? চেয়ার সামনের ঘর থেকে নিয়েছে। বসে ‘ফল এ স্লিপ’ শুনছে, দেখছে। চোর-টোর না তো? বিদেশী চোর! না, চোর এমন গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে না।

বাংলায় বলবে না ইংলিশে বলবে?

‘এই যে ভাই! হেই!’

লোকটা তাকাল।

‘আপনি কে? হু আর ইউ?’

লোকটা বাংলায় বলল, ‘আমি কাফকা।’

‘কাফকা মানে?’

‘ফ্রাৎনজ কাফকা।’

আগামাথা নাই স্বপ্নের। ফ্রানৎজ কাফকাকে স্বপ্নে দেখছে সে। অদ্ভুত সেই লেখক মানুষটা। সে বলল, ‘এখানে আপনি কী করছেন, কাফকা?’

‘তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম, হতভাগ্য গ্রেগর সামসা।’

‘গ্রেগর সামসা! গ্রেগর সামসা কে?’

‘কেন, তুমি। তুমি কি আমার গল্পটা পড়ো নাই? তোমাকে নিয়ে লিখেছি। মেটামরফসিস। না পড়লেও ক্ষতি নাই কোনও। তুমি যদি আমার কথা শোনো, তবে বলি।’

‘বলে যান, কাফকা।’

‘কাল রাতে কী হয়েছিল, গ্রেগর সামসা?’

‘এটা প্রাইভেট ব্যাপার নয় কি? আপনাকে বলতে আমি বাধ্য না নিশ্চয়।’

‘কিছুই হয়নি, বাছা।’

‘কী?’

‘কাল রাতে কিছুই হয়নি, হতভাগ্য গ্রেগর সামসা।’

‘না হলে হয়নি।’

‘তাহলে এরকম কেন হবে?’

‘কী?’

‘তুমি কাল থেকে ঘুম থেকে উঠে কী দেখবে জানো? দেখবে তুমি একটা পতঙ্গ হয়ে গেছ। এজন্য বলি, না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দাও আজকের রাতটা।’

‘কাটালে?’

‘এটা খুব সহজ, গ্রেগর সামসা। না ঘুমালে ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপার থাকছে না। অতএব পতঙ্গ হওয়ার ব্যাপারও থাকছে না।’

‘কী বলেন এসব? আপনি কি উন্মাদ, কাফকা?’

ফানৎজ কাফকার সামান্য মন খারাপ হলো, ‘আমার যা বলার আমি বললাম। শোনার ব্যাপার তোমার, গ্রেগর সামসা। তোমার যদি মনে হয় তুমি শুনবে। মনে না হলে শুনবে না। না শুনলে তোমাকে নিশ্চয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে না।’

‘ধন্যবাদ। আপনি এখন দূরীভূত হোন, ফানৎজ কাফকা। চেয়ার যথাস্থানে রেখে যাবেন, প্লিজ।’

ফ্রানৎজ কাফকাকে দূরীভূত করে, ঘুম আবার গাঢ় হলো তার। প্রগাঢ় একটা ঘুম দিয়ে সে উঠল পরদিন ১১টা ১১মিনিটে। এবং দেখল সে একটা পিঁপড়া হয়ে গেছে। খুব কালো রঙের ছোট একটা পিঁপড়া। পিঁপড়া কি পতঙ্গ? না কীট? পোকামাকড়?

১১:১১:১১।

কলবেল বাজল।

বুয়া নিশ্চয়।

ছুটা বুয়া। সকালে কিছু কাজ-বাজ করে দিয়ে যায়। রান্না যা করে অখাদ্য। বাড়িঅলার ছোট ভাইয়ের ড্রাইভারের বউ। মাইন্ড করে কেউ ‘বুয়া’ ডাকলে। বুয়া না সে, ভাইয়ার জন্য রান্না করে দেয় শুধু। চোখ পড়ার মতো শরীরিনী। দেখে সে? না। এখন কি দেখবে? দেখবে হয়ত। পিঁপড়ার চোখ কয়টা? কম্পাউন্ড চোখ ৩টা। ওসেলো অগুণতি। এই বিবেচনায় পিঁপড়া না হয়ে মাছি হতে পারলে ভালো হতো। মাছিরও কম্পাউন্ড চোখ ৩টা। ওসেলো লক্ষাধিক। তবে আফসোস করল না সে। পিঁপড়া হয়ে মন্দ কিছু হয়নি। সে বিছানা থেকে নামল।

কলবেল বাজছে। বাজছেই। বাজছেই।

এই পর্যায়ে মহিলার মনে হয়ে থাকবে যে, দরজা খোলা রেখে প্রায়শ ঘুমিয়ে পড়ে তার এই ‘ভাইয়া’। দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল মহিলা। অনুমান সঠিক। দরজা খুলল এবং ঘরে ঢুকল শরীরিনী। দরজা আটকাল। এর নাম আয়েশা আখতার মুক্তা। সবুজ শাড়ি লাল ব্লাউজ পরে আছে।

আয়শা আক্তার মুক্তার দুই পায়ের মাঝখানে এখন পিঁপড়াটা। মেঝেতে। লাল রং দেখছে। আয়শা আক্তার মুক্তা একটা খুব লাল রঙের পেটিকোট পরেছে। পেটিকোটের নিচে আর কিছু পরেনি।

দরজা লক করে আয়শা আক্তার মুক্তা রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে। খুব লাল রং দেখে অজ্ঞান হয়নি, নিরাপদে দরজা পার হয়ে গেল খুব কালো রঙের ছোট পিঁপড়াটা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়