ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটগল্প || কাফকা’র অপ্রকাশিত অভ্যাস

আশরাফ জুয়েল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প ||  কাফকা’র অপ্রকাশিত অভ্যাস

 

‘কি? তাই? সত্যি? ভয়ানক। অসহ্য। খাবো। ধোঁয়া। নাহ্। মানুষ! নাই। তাহলে? মুশকিল। আচ্ছা। কালই? হ্যাঁ। বলেছি। মানে? মৃত্যু! কালো। ফেনিল। গাঁড়। ঐদিকে। আগামীকাল। হয়ত। কিন্তু? জোয়ার। আহারে। এখন? থাক। থাকুক। সময়। ভুল। কান্না। অবশ্যই। কিছু? বাকিটা? সম্ভাবনাময়। গ্রোথ।’ হঠাৎ বাঁ হাতের ক্রুদ্ধ তর্জনী বলল কথাগুলো।

যে চেয়ারটায় বসে আছি, তার সামনে একটা টেবিল, বিপরীতে বসে আছে আমার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সাতটি আঙুল, ডান চোয়ালের অংশ বিশেষ, উপড়ে আসা নিচের মাড়ির অপ্রাপ্তবয়স্ক কয়েকটা দাঁত, টাক মাথার পেছনের অংশ, উত্তল গ্লাস পরে থাকা ডান চোখের মণি, চিড় পড়া থুতনি, বাকরুদ্ধ কিছু লোম, পাঁজরের বোবা হাড়, আর্থ্রাইটিস আক্রান্ত পায়ের গোড়ালি, স্থূল পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা কিছু চর্বি- এরা সবাই সাক্ষী দেবে আজ। এতটুকুও অবাক বা আহত না হয়ে স্থির বসে আছি। ঠিক বসে আছি বলা ভুল হবে, বন জোভি’র একটা গানের শুরুর কয়েকটা লাইন মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বারবার ইটস মাই লাইফ/ ইটস নাও ওর নেভার/ আই আইন্ট গন্না লাইভ ফ’ইভার/ আই জাস্ট ওয়ান্ট টু লাইভ হোয়াইল আ’ম এলাইভ।’ শুধু লিরিক মনে করার চেষ্টা করছি তা নয়, গুনগুন করে সুরটা ঠোঁটে আনার চেষ্টাও করছি। না, লিরিক মনে আসবে না এটা জানা হয়ে গেছে আমার, তবে জোভি’র গিটারিস্ট রিচি’র কথা মনে পড়ছে খুব, হঠাৎ জোভি’কে ছেড়ে চলে যায় রিচি, আকাশ ভেঙে পড়ে জোভি’র ঘাড়ে।

মৃত্যু থেকে মাত্র কয়েকটি শব্দ দূরে বসে থাকা একজন মানুষ গানের লিরিক মনে করার চেষ্টা করতে পারে! এই ভেবে খুব হাসি পাচ্ছে আমার, দুঃখের বিষয় হাসতে অপারগ আমি, কারণ অর্ধেক চোয়াল বিদ্রোহ ঘোষণা করে আমারই বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য নিজের স্মৃতি ধার দিতে ব্যস্ত। বন জোভি মন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, যদিও জোভি’র গিটারিস্ট একনাগাড়ে বেজেই চলেছে আমার এলঝেইমারস আক্রান্ত সেরিব্রালে। বুকের ভেতরের পুকুর অনবরত কাঁদছে। ইদানীং কারও কান্না দেখলে হাসি পায়,  এখন যেমন হাসি পাচ্ছে। না গোপনে নয়, বরং প্রকাশ্যেই; সেই হাসি পূর্ণতা পায় না, এবারও পেল না, হাসির অর্ধেক আমার মুখে, বাকি অর্ধেক টেবিলের ওপারে বসে থাকা অর্ধেক চোয়ালে ঝুলে আছে। আমার দুই চোয়ালের বিচ্ছিন্নতার কথা মনে পড়া মাত্রই পুকুরটা দমে যায়, অতীতের সাঁতারগুলো তাকে খুব পীড়া দেয়, বুঝতে পারি, কিন্তু কিছুই করার থাকে না।

গতকাল একটা ব্যালিস্টিক মিসাইল চিলের মতো উড়তে উড়তে এসে পড়েছে সিরিয়ার জনবহুল আলেপ্পোতে, বিস্ফোরিত হবার পূর্বে মিসাইলটি কিছু কথা বলে গেছে আমার বুকের পুকুরকে, ‘শান্তি। কার? ধুর! হাসিঠাট্টা। তোমাদের। সকাল। ধূসর। আজেবাজে? তবুও। মানুষ? অলক্ষ্যে। অভিশাপ। সন্ধ্যায়? তবে? হামাগুড়ি। অন্ধকার। ভাবনা। আড়াল? শহরে? ওহ্। হ্যাঁ- তো! কালো। ভীষণ। শিকল? পায়ে? মুখে? বুকে? হাতে? পায়ে? কোথায়? অতীব। গর্ত। ভাবনা। সময়। নেই? অবরুদ্ধ। যন্ত্রণা। হাসিমুখ। সম্ভবত। তাহলে? কিছু না। কেন? হাততালি। ক্ষুধা। মেঘ। আড়াল। খাচ্ছে? মানুষ। কী? খাচ্ছে।’

ব্যালিস্টিক মিসাইলের শ্বাস নিতে হয় না, একনাগাড়ে কথা বলতে গিয়ে একবারও থামতে হয় না তাকে, তবে এটা সুনিশ্চিত, ব্যালিস্টিক মিসাইলের ফুসফুস আমার পুকুরের ফুসফুসের চেয়ে বড় নয়? নয় যে, এটা বুঝলাম বিস্ফোরিত হবার পূর্বেই সে আমার বুকের পুকুরে সাঁতরে গেছে কিছুক্ষণ। এটা অবশ্য আমার আত্মবিশ্বাসে কিছুটা বাড়তি ঘি ঢেলে দিয়েছে। ঘি খুবই বিস্ফোরণবান্ধব। আমি শুধু পুকুরের কাছে মিসাইলের বলে যাওয়া কথাগুলো শুনেছি। মিসাইলটি স্নান শেষে আলেপ্পোতে ফিরে যাবার পূর্বে যা কিছু বলে গেছে, ‘গতকাল সন্ধ্যায় নাস্তা করার সময় বিস্ফোরণ সম্পর্কিত বেশ কিছু শর্ত নিয়ে আলাপ হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী সে ষাটের বেশী মানুষকে হত্যা করতে পারবে না। তাদের আবদার, একটি জনবহুল স্থানে বিস্ফোরিত হতে হবে ব্যালিস্টিক মিসাইলটিকে এবং নিহতের মধ্যে কমপক্ষে সাতাশজন শিশু থাকতে হবে, শিশু না মরলে খবর গুরুত্ব পায় না।’ এতক্ষণ সেইসব গল্পের কথাই শুনছিলাম। বিচারের ময়দানে বসে আমি বন জোভি থেকে ঢুকে গেছি সিরিয়ার আলেপ্পোতে, এখন সেখানে বহু ‘হোয়াইট হর্স’ পতপত করে উড়ছে।

একটা গাঢ় নীল রঙয়ের স্যুট, যার কলারে একটা সাদা টাই, তখনও নিশ্চিত, আমার বিরুদ্ধে চলে যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর বিপরীতের চেয়ারে বসে আছি আমি, ঘুমিয়ে পড়েছি এবং ঘুমের মধ্যেই জেগে আছি; ‘অ্যাশর‌্যাফ’, ‘অ্যাশর‌্যাফ’ বলে আমাকে ডাকছে কেউ। আশপাশে তাকালাম। আমার চোখের সামনে সেই গাঢ় রঙয়ের ব্লেজারের মধ্য থেকে উঁকি দেয়া টাই আমাকে ডাকছে। কণ্ঠ শুনে কাউকে চেনা যায়, যদি সেই কণ্ঠ পরিচিত হয়, আমার মাথার অর্ধেক ঘিলু কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম, আর নিবিড়ভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম আসলে, কে, কেন আমাকে ডাকছে, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে; ঘুমের মধ্যেই আমাকে ডেকে তুলতে চাইছে কেন? ইদানীং ঘুমের মধ্যেই ভালো দেখতে পাই, আমার মাথার অর্ধেক ঘিলু, অন্ধকারের মধ্যেই ভালো কাজ করে। অবাক না হয়ে পারি না আমি।

ওয়েল, আই ডু থিংক দেয়ার’স ব্লেম- ইয়েস, আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম ওন বোথ সাইড’স, ইউ লুক এট- ইউ লুক এট বোথ সাইড’স, আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম অন বোথ সাইড’স।” মেলাতে পারি না, কার কণ্ঠ? আর আমাকেই বা কেন ডাকছে, আমাকে ডাকার কথা তো নয়? তবে? নিজেকে গর্বিত না ভাবার কোন কারণ নেই, যখন বুঝলাম, আমেরিকার মহামান্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জন ট্র্যাম্পের কণ্ঠ। কিন্তু তিনি কই? ব্লেজারের গলায় ঝুলতে থাকা টাই আমার দিকে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে আছে, কিছুতেই ডান হাতটাকে খুঁজে পাই না আমি, উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে থাকি, দেখি টেবিলের বিপরীতে বসে থাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আমার হাত সম্ভাষণের দিকে এগিয়ে আসে ধীরগতিতে।

মনে মনে আওড়াতে থাকি, ওয়েল,আই ডু থিংক দেয়ার’স ব্লেম- ইয়েস, আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম ওন বোথ সাইড, ইউ লুক এট- ইউ লুক এট বোথ সাইড’স,আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম অন বোথ সাইড’স।”  শব্দগুলো আমার বুকের পুকুরে চেলি মাছের মতো লাফাতে থাকে। মহামান্য প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পের দ্য আর্ট অফ দ্য ডিল’ বইটির সাজানোগোছানো পৃষ্ঠা আমাকে গভীর থেকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে চায়। উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমার অর্ধেক শরীরের সমস্ত শক্তি এক পায়ে জড়ো করি, কিন্তু পারি না, আমার বাম পা বলতে থাকে, ‘অবরোধ। সান্ত্বনা। মন। তবে? নয়নতারা। কোথায়? পাখি। ডালপালা। ছাপ। নিরন্ন। ডাইরিয়া। হুঙ্কার। কেমন? হালকা। তিন। টোন। বারবার। সজোরে। ঠিকঠাক। মরেছে। হাসপাতাল। বিরুদ্ধবাদ। মোবাইল। চোখ। শেষ! তবু। নিরহঙ্কার। আবছা। সম্পদ। কুয়াশাচ্ছন্ন। অতীব। সংকোচ। ভাড়া। কয়জন? সংখ্যাতীত? সমস্যা। সমাধি-পুত্র। কার? অপাপবিদ্ধ। পুনরায়। সংকলিত। জীবিকা। যৌথ। কলাকৌশল। তাই?’

স্যুট একটা বাহন? আমার দৃষ্টির আওতা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবী। আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে ইচ্ছুক আমার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য আরও কিছুটা সময় পেয়ে বেশ পুলকিত বোধ করছে। আমি ভাসছি, ঠিক জানি না কখন, কতোটা সময় পর- সম্পূর্ণ অচেনা এক শহর, চকচকে ফুটপাতের শতাব্দী পুরনো শহর। একটা বিশাল সাজানোগোছানো বুক শপের সামনে দাঁড়িয়ে আমি, অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, আশপাশের মানুষও একই দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমরা কেউ কারো দিকে এগুচ্ছি না, কথা বলছি না, আমি, অদ্ভুত আগুন্তুক এই শহরে- এক হাতবিশিষ্ট তিন আঙুলের একজন মানুষ, থুতনির কিছু অংশ অনুপস্থিত, চোয়ালের অবশিষ্টাংশ থেকে ঝরছে হতাশা, উপরের মাড়ির বিহ্বল দাঁত, টাক মাথার পেছনের অংশের কয়েকটা চুল ঘাড় তুলে পরিস্থিতি আঁচ করায় নিয়োজিত রেখেছে নিজেদের, উত্তল গ্লাস পরে থাকা বাম চোখের মণি ততক্ষণে বরফ, আহত থুতনির থেকে ঝরে পড়ছে গোঙানি, বাকরুদ্ধ লোমগুলোর খুব ক্ষিদে পেয়েছে, পাঁজরের ক্ষয়ে যাওয়া হাড় থরথর করে কাঁপছে, আর্থ্রাইটিস আক্রান্ত ডান পায়ের গোড়ালি বহন করছে সীমান্ত, বাম পা অনুপস্থিত, আর বুকের ভেতর একটা পুকুর- এমন বিচ্ছিন্ন একজন মানুষকে এই শহরের কেউ কোনদিন দেখেনি একথা নিশ্চিত, ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামক অভিশাপের খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট বাংলাদেশের কিম্ভূতকিমাকার শহর ঢাকা থেকে ভেসে আসা এক অর্ধেক মানুষ- আমাকে দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। মানুষের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করছি।

বুক শপটার গলায় ঝুলানো বিশাল সাইনবোর্ডের দিকে চোখ পড়া মাত্র দেখলাম, ‘কাফকা বুক শপ’ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুক শপটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে থাকে, ‘পচনশীল। আপেল। কারা? জান্তব। গিগাবাইট। অসীম। শূন্য। কোলাহল। মাতাল। কোথায়? বুড়িগঙ্গা। নিকষ। হাড়। কনকনে। আহত। বাচাল। আস্তরণ। ভাসছে। মুণ্ড। খবর। চেনা। নিরাপত্তা। কোথায়? নিরপরাধ। মা। কাঁদুক। মিথ্যা। যাপন। লাশকাটা। বিপত্তি। ভোগবিলাস। কিঙ্কর। তাহলে? অবিশ্রান্ত। ডর। দূর। হোক। তালাচাবি। কে? বুঝেছি। থাক। নিয়ম। সমঝোতা? তলা। ভাঙচুর। আঁচড়। আলগোছ। শঙ্খ। ফেসবুক। অন্তহীন। শ্রমণ। আখ্যান।’

ঘোরগ্রস্ত আমি। কয়েকটা পঙ্ক্তি ব্যতীত আর কিছুই মনে করতে পারছে না আমার অর্ধেক সেরিব্রাল, ওয়েল, আই ডু থিংক দেয়ার’স ব্লেম- ইয়েস, আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম ওন বোথ সাইড, ইউ লুক এট- ইউ লুক এট বোথ সাইড’স, আই থিংক দেয়ার’স ব্লেম অন বোথ সাইড’স।”  আমার একমাত্র রক্ষাকবচ, বুকের ভেতরের পুকুরে তখনো শব্দগুলো চেলি মাছের মতো ভাসছে। আমার এক চোখ, আরোপিত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। একশ সতের বছর বয়সী এক তরুণের ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। তীক্ষ্ণ সূচালো নাক, ঘন ভুরু, মোটা ঠোঁট, গাঢ় অন্ধকারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে জ্বলতে থাকা হ্যারিকেনের মতো চোখ, লম্বা-খ্যাপাটে দুইটা কান- খুব চেনা চেনা লাগে। নিখুঁত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে থাকি আমি আর আমার পুকুর, যেখানে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে চেলি মাছ, ঠাহর করতে পারি না। হঠাৎ বন জোভি’র ‘ইটস মাই লাইফ’ গানের প্রথম দুই পঙক্তি মনে আসে, দিস এইন্ট আ সং ফর দ্য ব্রোকেন-হার্টেড/ নো সাইলেন্ট প্রেয়ার ফর দ্য ফেইথ ডিপার্টেড।’ 

কে এই শতবর্ষী তরুণ, মুখে অবিশ্বাস মাখানো বিষণ্ণতা? আমাকে উদ্দেশ্য করে পৌরাণিক কণ্ঠে বললেন, ‘বিচারের কাঠগড়া থেকে পালিয়ে আসা মানুষ তোমরা?’ মহাবিশ্বের আশ্রয় থেকে সদ্য ছিটকে পড়া পৃথিবীর মতো মনে হলো কথাগুলোকে। কথাগুলো কানে আসামাত্রই আমার একটা চোখকে বাধ্য করলাম সেই কণ্ঠের ডান দিকে তাকাতে, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা, ‘কাফকা মিউজিয়াম।’ প্রার্থনার সুরের ঢঙে মিউজিয়াম আমার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলতে থাকলো ‘হাত। নদী। ভয়। এবং। তাহলে? কিছু। অথবা। সামান্য। যৌক্তিক। আজকাল। অধুনা। সমাপন। চাবি। হর্ষ। উদ্বেগ। বুদ্বুদ। ফানুস। সম্প্রতি। হরিণ। যাচ্ছেতাই। টিচার। সোম। হাতি। পারাপার। সংস্কার। ডিগনিটি। পতাকা। সম্পর্ক। অপরিণত। ঝাণ্ডা। স্খলন। সুখ। বিপত্নীক। রুগ্ন। কারা? আহার। মুঠো। তিথি। সময়। ঘড়ি। প্রত্যুৎপন্নমতি। নেশা-সক্ত। লেজার। মহাশ্মশান। নামাবলি। দয়াপরবশ। গ্রাসাচ্ছাদন। পাকড়াও। কষ্টিপাথর। ঝঙ্কৃত। প্রশ্নকর্তা। হেমলক। ফানুস। তবে? সুড়ঙ্গ?’

আমার হাতের অবশিষ্ট তিনটি আঙুল দাবি করে বসলেন তিনি। কাফকা? ফ্রানৎস কাফকা! বলতে থাকলেন, উই বিলিভিং প্যাসোনেটলি ইন সামথিং দ্যাট ডাজ নট একজিস্ট, উই ক্রিয়েট ইট। দ্য নন-একজিস্টেণ্ট ইজ হোয়াটএভার উই হ্যাভ নট সাফিশিয়েন্ট ডিসায়ার।’  বলতে বলতে ‘ফ্রানৎস কাফকা’ আমার বিশ্বাসের ক্ষতে একটি জ্যান্ত তেলাপোকা ছেড়ে দিয়ে স্মিত হাসলেন, তারপর দ্রুত মিলিয়ে গেলেন প্রাগ শহরের ব্যথাতুর ইতিহাসের দিকে। আপাতত আমার নিজের দখলে কোনো আঙুলই অবশিষ্ট থাকলো না। ভাবছি, আমার শরীর থেকে বিদ্রোহ করা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর কথা, যারা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে বলে অপেক্ষায় বসে আছে বিচারের টেবিলের বিপরীত প্রান্তে। আঙুল হারিয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি, আর ধূসর হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া কাফকা’র ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছি। শহর দেখতে বেরুবো বলে মনস্থির করতে কিছুটা বেশি সময় নেয়া হলে দ্রুতই অন্ধকার আমাকে গিলে ফেলে, নিজেকে অযত্নে পড়ে থাকা তৈলচিত্র মনে হয়, মনে হয় গলে যাচ্ছি আমি, মিলিয়ে যাচ্ছি প্রাগের পথে পথে, নিজের ছায়াকে দেখে আমি এতোটুকুও অবাক হই না, ‘তেলাপোকা।’

আমার বুকের পুকুরের ভেতর প্রথম বিশ্বে জন্ম নেয়া একটি তুলতুলে ব্যালিস্টিক মিসাইল স্নান সেরেছে, যেটা গতকাল আলেপ্পো শহরে ভীষণ সমাদরের সাথে বিস্ফোরিত হয় এবং যার ফলে প্রায় একশ সাতাশি জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, এরমধ্যে আটষট্টি জন শিশু- শিশুরা বাসে করে স্কুলে যাচ্ছিল, এই অপরাধে আমাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাকে নেয়ার কথা সিরিয়া কিন্তু হোয়াইট হর্সের পিঠে চড়িয়ে আমাকে নেয়া হয়, জানানো হয় আমাদের গন্তব্য সানা, সেখানে অপেক্ষা করছে আমার বিচার, ভাবছি, কতবার বিচার হবে? আমার জিম্মায় যা আছে তা অতীব নগণ্য- দুই হাত নেই, নেই মুখের চোয়াল, এক পায়ের গোড়ালি এখনও অবশিষ্ট আছে, কিছুটা ফেলে এসেছি কাফকা’র অভ্যাসে- বাকিটা বিচারের টেবিলের বিপরীতে অপেক্ষায় আছে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে বলে।

ইয়েমেনের রাজধানী সানা পৌঁছামাত্র আমার দিকে উড়ে এলো কিছু ক্ষুধা-ভক্তির স্বর, তারা চিৎকার করে আমাকেই ডাকছে আর বলছে, ‘তবে? চরাচর। হ্যাঁ। তাইতো। ভালোকথা। আইসক্রিম। সন্নিবেশিত। যাদু-টোনা। চাঁদা। নখ। কে? চন্দনকাঠ। কলঙ্কিত। তৎকাল। জুলুম। অদৃষ্ট। ভাবছি। কেন? কু-দিন। যথাচার। ম্লান। আবেদন। কিয়ৎ। তমসা। হালত। খারাপ। বৃথাব্যয়। আগন্তুক। পায়ু। জিজ্ঞাসা। কি? পর্যাপ্ত। পূর্বকালে। দারিদ্র্য। সমিতি। অপরিচিত। কঙ্কাল। সূত্রপাত। নিয়মাবলী। খেদ। সাম্প্রতিক। বিধান। মৌলিক। চমক। বিস্ময়। মূলধন। নাই? প্রজ্ঞাপন। কাটতি। ব্যবসা। মার। কাট। প্রভা। আজ্ঞে। হাল। নিমন্ত্রণ। সম্ভব? সূচনা। বাটিক? অনুশাসন। কে? যৌথ। কারণ? গগন। আহ্লাদ। ফাক।’

ঘুরে ঘুরে ক্ষুধা আর মৃত্যুর মাঝামাঝি বসে থাকা টাইম মেশিনে চড়ে ভাবছি স্থায়ী ঘায়ের কথা, আর শিশুদের কঙ্কালে হাড়ের সংখ্যা  গোনার জন্য ছোটবেলায় মুখস্থ করা নামতা ঝালিয়ে নিচ্ছি। এগারো দশকের নামতা আমাকে বারবার ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর সাথে বসে মৃত্যুর সংখ্যা মেলাতে না পারা বড়ই লজ্জার বিষয়। এরই মধ্যে এক টুকরো আকাশ উড়ে এলো, মৃত্যু উদার- বুক পেতে আকাশকে জায়গা করে দিল, যদিও সে জানত, এই এক টুকরো আকাশ তিনটা নতুন মডেলের মিসাইল সাথে করে এনেছে। স্কুলের বেল বাজা মাত্র বিকট শব্দে হেসে উঠল মিসাইল, মরু ধুলোয় মিশে যাওয়া শিশুদের কচি মেরুদণ্ড বলতে থাকল, ‘মাদাগাস্কার। ট্রেনলাইন। আয়ুষ্কাল। মার্ক্স। হলুদ। পেট। হাততালি। খটখটে। ন্যাড়া। ফুটবল। আর্য। কবুতর। বনানী। প্রেমিকা। সংলগ্ন। বাহুবল। কান্না। কেন? ইত্যাদি। সম্ভ্রম। মলাট। টাকা। স্টেট। ডেমোক্রেসি। ফাকার। তাহলে? গাভী। উদ্ধারকর্মী। শাদা। অভিধান। রাজভাষা। জন্মাষ্টমী। আত্মপরায়ণ। বধুয়া। দাঙ্গাহাঙ্গামা। ইলেকশন। বিচ্ছিন্ন। নিঃশ্বাস। মার্বেল। আত্মকলহ। বৃক্ষ। মর্তলীলা। দাপট। হাল্কা। তলপেট। আকণ্ঠ। প্যারিস। টিকটিকি। নিশ্চয়। কবিতা। শক্তি। দোপাট্টা। নিউজার্সি। ক্রু। পাথর। নিদ্রা। শাদা। চর্যাপদ।’

সুদীর্ঘ সময় অপেক্ষা আমার বিচারের আর্জি নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে আমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আরও ক্ষেপে উঠেছে, তারা আমার সাজা নিশ্চিত করবেই, তাদের কাছেই সমস্ত প্রমাণ। অতএব আমাকে ফিরে যেতে হবে। ফিরে আসার সময় আমার বাকি প্রত্যঙ্গগুলোকে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে আসলাম ইয়েমেনের মৃত শিশুদের মাঝে, যদি তাতেও তাদের ক্ষুধা কিছুটা নিবারণ হয়। ক্ষুধা মেটে না- জন্মের নিয়মাবলীর তালিকায় ক্ষুধা সর্বাগ্রে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছাত্রের ভঙ্গিতে আড়ষ্ট ক্ষুধা’রা মুখস্থ করতে থাকে, ‘লা-লীগা। উদ্যত। কুমিল্লা। মাইনাস। ক্ষুদ্র। আভাস। চিকিৎসক। পর্দা। মদ। ডিক। তুরস্ক। খেলনা। খনি। ব্রাদার। গোগোল। আব্রাহাম। হিজল। চর। শাহজালাল। বুভুক্ষু। কাস্তে। শুয়োর। জানালা। শিয়র। বাই-ফোকাল। জিলিপি। নিরবচ্ছিন্ন। আত্মসাৎ। নিউজ। মৌলিক। বৃদ্ধাশ্রম। কাঁধে? বিমানবালা। কবর। আলোকিত। নবান্ন। ফার্সি। থ্রি-সাম। কৃষ্ণসাগর। জ্বলজ্বলে। নিরাকার। কৃতার্থ। ভ্যাংকুভার? চিঠি। লেন। ফরাশগঞ্জ। লালু। কুত্তা। রামায়ণ। গোমস্তা। রিটার্ন। হালকা। বিভেদ। সাম্পান। দেশবিভাগ। সক্রেটিস। ফুলকি। মধুমেহ।’

বিচারের টেবিলের বিপরীতে অপেক্ষারত, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য প্রস্তুত আমারই শরীরের প্রত্যঙ্গগুলো- ক্রোধে ফুঁসছে। আমার শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের শান্তির বিঘ্ন ঘটছে। পুনরায় বিচার কাজ আরম্ভ হলে, দায়িত্বপ্রাপ্ত মদের বোতল বিচারকার্য আরম্ভ করেন।
সাক্ষী- এক (চোয়ালের খণ্ডাংশ),‘বলুন আপনার শরীরের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ কী?’ দূরে কোথাও বেজে চলছে আজানের হৃদয়গ্রাহী সুর।
সাক্ষী – দুই (জিহ্বার অগ্রভাগ),‘আপনি নিশ্চিত? আপনার নির্লজ্জ এবং বেয়াড়া শরীর আপনার সাথে এই অন্যায় করেছে?’
সাক্ষী – তিন (দুই হাতের সাত আঙুল, বাকি তিনটি কাফকা নিয়ে গেছেন),‘আপনার প্রদত্ত সাক্ষ্য অনুযায়ী আপনার শরীরের ফাঁসি হতে পারে, আপনাকে রাজসাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।’
সাক্ষী- চার (পেটের নিম্নভাগ),‘এইটা একটা শুয়োর, ধর্মাবতার একে আমাদের সকলের সম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এর মৃত্যু নিশ্চিত করুন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আর আমার পুকুরের বিচার কাজের স্থগিতাদেশ আসে, এই বিচার যেনতেন বিচার নয়, এই বিচারকার্য হবে বিশ্ব সভার সদর দপ্তরে। হুড়মুড় করে মদের বোতলের দিকে সকল সাক্ষী ঝুলে পড়ে জিহ্বা পেতে বলতে থাকে, ‘হুজুর আমরা সাক্ষ্য প্রত্যাহার করতে চাই, আমরা সকলেই শরীরের যথাস্থানে ফিরে যেতে চাই, বিশ্ব সভায় গিয়ে পুনরায় সাক্ষ্য দেবো আমরা, আমাদের ভিসা, পাসপোর্টের ফর্ম পূরণ করে দিন, মহাশয়। এই সুযোগে স্বর্গের মতো দেশ মানে; বিশ্ব সভার সদরদপ্তর ঘুরে আসাটাও হয়ে যাবে।’
আমি আর আমার বুকের ভেতরের পুকুর ততক্ষণে সমানে হাসির বাজি ফোটাচ্ছি, আমাদের হাসির বন্দীশালা থেকে একে একে মুক্ত হচ্ছে বন জোভির গিটারিস্ট, কাফকার অপ্রকাশিত অভ্যাস, একটা সাদা টাই, আলেপ্পোর আঁশটে গন্ধ, ইয়েমেনের মৃত শিশুদের রক্তবমি।   



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়