ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছোটগল্প || অপয়া

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৬, ৩ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || অপয়া

 

মেয়েটির নাম রহিমা হতে পারে, ফাতেমা, বিলকিস কিংবা জুলেখা হলেও কোনো ক্ষতি নেই। ডাকার জন্য মানুষের একটা নাম চাই। সে নামের কোনো মানে থাকলেও চলে, না থাকলেও অসুবিধা নেই। ভালো শোনালে ভালো, মন্দ শোনালেও ক্ষতি নেই। যে মেয়েটির কথা এখানে বলা হচ্ছে বাবা মায়ের দেওয়া একটা নাম তারও ছিল। কিন্তু যারা তা জানে তারা যেমন ভুলতে বসেছে, যারা জানে না তারাও জানবার কোনো আগ্রহ দেখায় না। কারণ অপয়া হিসাবে গাঁয়ে তার যে পরিচিতি গড়ে উঠেছে তার আড়ালে তার প্রকৃত নামটাই হারিয়ে গেছে। এখন ওটাই তার নাম। তার প্রসঙ্গে কেউ কিছু বলতে গেলে সচরাচর ‘ওই অপয়াটা’ বলেই উল্লেখ করে থাকে।

দূর সেই গাঁয়েরও হয়তো নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই কিংবা আছে কারো জানা নেই, কিংবা জানা ছিল মনে নেই। মনে থাকাটা খুব জরুরি ছিল এমনও নয়, তবে এটুক জানা যায় যে, তা দক্ষিণের সুন্দরবনঘেঁষা কোনো গাঁ হবে। যার পাশ দিয়ে ছোট বা বড়, চওড়া বা সরু কোনো নদী বয়ে গেছে, বর্ষায় ঋতুমতী নারীর মতো কামনা নিয়ে সে নদী জেগে ওঠে। তখন হয়তো তার উন্মত্ততায় ভয় পেয়ে যায় তীরবর্তী মানুষ, দুর্বার আঘাতে পাড় ভেঙে ঘর-বাড়ি, আবাদি জমি, পথঘাট বিলীন হয়ে যায় তার ঘূর্ণিজলে। মানুষ হয়ে পড়ে গৃহহীন, অনাহার, অর্ধাহারে কাটাতে হয় দিনের পর দিন, উঞ্ছবৃত্তি করে লেংচে লেংচে জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলে। তাতে জীবনকে ঠিক আর জীবন বলে মনে হয় না। নদীর জল আর মানুষের চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আবার এই নদী ঘিরেই হয়তো অনেকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। সারাবছরই এর বুকে ভেসে চলে নানা ধরনের নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত জলযান। চলে জেলেদের মাছধরা, ব্যবসায়ীদের মালামাল আনা-নেওয়া আর খেয়া পারাপার। সেই গাঁয়ে ছোট হোক বড় হোক একটি বাজার থাকে, সেখানে নিত্যকার ঘরগেরস্থালির জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রীর বেচাকেনা চলে, সেইসাথে অধিকফলা পণ্যের শহরমুখি বাণিজ্য পরিচালিত হয়। সেই পণ্যের ব্যবসাদার আছে, আছে দাদনদার মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগী ফড়ে আর তাদের প্রতারণা, আছে প্রান্তিক চাষির বেদনা-হতাশা-দীর্ঘশ্বাস।

এইরকম একটি গাঁয়ে আজ থেকে ১৫/১৬ বছর আগে শুক্লপক্ষের এক রাতে যে মেয়েটি জন্মেছিল তাকে দেখে তার মা-বাবা যে খুব খুশি হয়নি তা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধ-পথ্যির তোয়াক্কা না করে ফি বছর মাটির ঘরের ডুয়া লেপতে লেপতে ওইসব গ্রামের যে নারীরা সন্তান প্রসব করে সেখানে খুশির লাগামছাড়া মাত্রা থাকে না তা বলাই বাহুল্য। যতদিন নারী এয়ো এবং সক্ষম ততদিন বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দেওয়াও বাড়ির আর দশটা কাজের মতো স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সন্তান ছেলে হলে খুশির চেয়ে স্বস্তি থাকে বেশি। হাত-পা শক্ত হতে না হতেই ওরা বাপের সাথে ক্ষেতে যেতে পারে। বিড়ির আগুন এগিয়ে দেওয়াও একটি কাজ। কিন্তু মেয়ে? ওতো শুধুই বোঝা, খরচের খাত। পেলেপুষে বড় করে অন্যের বাড়িতে ঝি-গিরি করতে পাঠাও। সেখানেও ওর একই কাজ, স্বামীর বিছানায় ওম দেওয়া, বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করা আর ঘর-গেরস্থালি সামলানো। আর কপালে খেমচি থাকলে ও আবার বাপের বাড়িতে ফিরেও আসতে পারে, সেক্ষেত্রে একা নয় পুঁইপোনাসহ। আমাদের এই মেয়েটিও মা-বাবার অনাকাঙ্ক্ষার মাঝে জন্মে তাদের অখুশির মাঝে বেড়ে উঠছিল। শুধু মেয়ে হয়ে জন্মেছিল বলেই নয়, সাতসতের আরো অনেক কারণ জড়িত ছিল। প্রসবের পর দাই বলেছিল, ‘মায়েডারে এট্টু দেহেশুনে রাইহো, উঁচকপালী হইছে, উঁচকপালী মায়ে অলক্ষ্মী হয়।’ তার কথায় মেয়েটির মা-বাবা কতখানি আতঙ্কিত হয়েছিল তা জানা যায় না, তবে মনের মধ্যে খুঁতখুতানি যে হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই, আর সেইজন্যই জন্মের সাতদিনের মাথায় ‘দোষ কাটানোর’ জন্য ওর বাবা মসজিদের বড় হুজুরের কাছ থেকে নগদ সাড়ে বারো টাকা হাদিয়া দিয়ে রূপোয় মোড়া তাবিজ এনেছিল। নগদ কাঁচা টাকায় তা শোধ করতে হয়েছিল। কালো তাগা দিয়ে সেই তাবিজ মেয়েটির কোমরে বাঁধা হয়েছিল। নির্দেশমত তিনদিন সকালবেলা একগ্লাস পানির মধ্যে তাবিজটা ডুবিয়ে সেই পানি ছোট্ট চামচের সাহায্যে তাকে খাওয়ানো হয়েছিল। দু’দিনের মাথায় মেয়েটির পেট নেমে যখন বারকয়েক রানীক্ষেত রোগে আক্রান্ত মুরগির মত সাদা চুনাহাগা হলো তখন তাবিজের ক্রিয়া শুরু হয়েছে মনে করে তার মা-বাবা খুশি হয়েছিল। ‘দোষ কাটার সুমায় শরীল এটটু-আধটু খারাপ হতিই পারে। শোকর কর, তাবিজি কাজ হতিছে। বড় হুজুরির তাবিজ, কাজ না হয়ে কী যায়?’ মুখে হাসি ছড়িয়ে তার বাবা মাকে বলেছিল। এভাবে ধীরে ধীরে দোষ কাটাতে কাটাতে মেয়েটি প্রথমে উপুড়, তারপর হামাগুড়ি এবং পরে বসতে শিখলো। এই সময়টাতে তার মাঝে আর কোনো অলুক্ষুণে ধাত দেখা যায়নি। কিন্তু একদিন আচানক কাণ্ডটা ঘটে গেছিল।  বারান্দায় বসিয়ে তার মা বাড়ির কাজ সারছিল। ফিরে এসে যা দেখলো তাতে সে রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। তাগাছেঁড়া তাবিজটা মেয়েটার দুই পায়ের ফাঁকে ঢলনামানো হিসুর মাঝে ভাসছে। এক ঝটকায় মেয়েটাকে তুলে সে রোদতাতানো উঠোনে ধপাস করে বসিয়ে দিল। আলগা পাছায় গরমের ছ্যাঁকা লাগায় মেয়েটি ক্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। দৌঁড়ে গিয়ে প্রস্রাবের মাঝ থেকে তাবিজটা তুলে নিয়ে বক্‌বক্‌ করতে করতে ধুতে ছুটলো সে। ‘কী সব্বোনাশে কথা, আল্লাহর কালাম ভরে মূতিছে। মাগি কি সত্যিই অপয়া?’

সবার আশঙ্কার মাঝেই সে বড় হচ্ছিল- বসা থেকে দাঁড়ানো, দাঁড়ানো থেকে হাঁটা, হাঁটা থেকে দৌঁড়ানো, আদুর গা থেকে পরনে রাবার দেওয়া হাফপ্যান্ট,  প্যান্ট থেকে ফ্রক, ফ্রক থেকে জামা-পাজামা, শেষমেষ চাপাডুরে শাড়ি চেপেছে তার গায়ে। পার হওয়া এই সময়টাতে পরিবারে বড় কোনো অমঙ্গলের কারণ হয়নি সে। তবে কখনো কখনো কাজেকর্মে ছোটখাট কোনো ত্রুটি হলে ‘অপয়া’, ‘অলক্ষী’ এমন মন্তব্য শোনা লেগেছে। তবে তা পারিবারিক চৌহদ্দীর মধ্যেই সীমিত ছিল। আর এই বিষয়গুলো কারো গোচরে না এলেও রূপের যে ঝলক নিয়ে সে জন্মেছিল তা ভালোমতই সবার চোখে লেগেছিল। দাইয়ের ভাষ্যমতে সে কতটা উঁচকপালী ছিল তা নজরে না পড়লেও তার বতী হয়ে ওঠাটা কারো চোখ এড়ায় নি। চোখ তার মা-বাবারও এড়ায় নি। বাড়ির সামনের রাস্তায় গাঁয়ের উঠতি ছেলেছোকরাদের আনাগোনা বেড়েছে, যখন তখন হয়তো বিপদ ঘটে যেতে পারে। তাই চটজলদি কাজটা সেরে ফেলতে হলো। মেয়েটাকে তড়িঘড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। কিন্তু একবার বসে সে পার পেল না, তিন তিনবার বসতে হলো। তবে কোনোবারই তার বিয়ে ভাঙে নি সে; স্বামী পরিত্যাক্তা হয় নি। তারপরও বিবাহিতা নারীরা জীবনে যে অভিজ্ঞতা এক-আধবার লাভ করে, কারো কারো হয়তো সে সুযোগই ঘটে না, সে তিন তিনবার তা লাভ করেছিল। বিধবা হয়েছিল মেয়েটি এবং তা তিনবার। যারাই তাকে বিয়ে করে তারাই মরে যায়। এ পর্যন্ত তিনজনের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল এবং তিনজনই প্রাণ হারিয়েছে। সে যেন কোনো মৃত্যুপুরীর অভিশপ্ত রাজকন্যা, কামনার আবেগে যাকেই স্পর্শ করে সে-ই প্রাণ হারায়। এখন তার পূর্ণ বিকশিত শরীর, কিন্তু সেদিকে সাহস করে তাকালেও কেউ আর তাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন দেখে না।

প্রথমবার তার বিয়ে হলো তাদের গাঁয়ের দু’তিন গাঁ পরের এক মৌয়াল পরিবারের বড় ছেলের সাথে। সুন্দরবনের গহীনে ঢুকে তারা কেটে আনে চাক চাক মধু। মহাজনের কাছে বিক্রি করে। দাদনের টাকা শোধ করে ভালোই পায়, তবে এখন আর তাতে সারাবছর চলে না। তখন অন্য কাজ করতে হয়। হয়তো বাওয়ালীদের নৌকায় চড়ে আবার বনে যায়, গোলপাতা কেটে আনে। তা বিক্রি করে কিছু আয় হয়, এভাবেই চলে তাদের সংসার। কয়েক পুরুষ ধরে তারা এই পেশার সাথে জড়িয়ে আছে। এই পরিবারের বড় ছেলের সাথে যখন তার বিয়ে হলো তখন মাঘ মাস। কড়া শীতে কাঁথার ওমে স্বামীর গায়ের সাথে লেপ্টে থেকে সে সুন্দরবনের গল্প শুনতো। বনের মাঝে কিভাবে তারা মৌচাক খোঁজে, চাক খুঁজে পাওয়ার পর কিভাবে বৌলেন দিয়ে সেই চাক কাটে, বাঘ কিভাবে শিকার ধরে, আরো কত কী! ‘বুঝলি বউ, বাঘ খুব পাকা শিকারি, দলের মদ্যি ঝাপায়ে পড়ে না, এট্টারে নিরিখ করে, তারপর আস্তে আস্তে তার কাছে যায়, কোনো শব্দই হয় না, শেষে লাফ দিয়ে পড়ে ঘাড়ে থাবা মারে ধরে টানতি টানতি বনের মদ্যি নিয়ে যায়। গলায় কামড়ায় দম বন্দ করে মারে।’ শুনে শিউরে উঠেছে মেয়েটি, ভয়ে স্বামীর গায়ের সাথে একেবারে মিশে যেতে চেয়েছে। ‘তুমরা টের পাও না আগেরতে?’ মেয়েটি জানতে চেয়েছে। ‘কহনো পাই, কহনো পাই না। আমাগের চোখ থায়ে উপর দিকি, গাছের ডালে ডালে, তয় মাঝেমদ্যি পা’র ছাপ দেহি। আর বাঘের গায় এট্টা ভুটকো গোন্দ আছে বুঝলি। কিন্তু মৌমাছির কামড়ের ভয়তে গামছা দিয়ে মুখ বান্দা থায়ে বলে গোন্দ টের পাই না। সেবার পাশের গিরামের পটলরে ধরে নিয়ে গেল। ও আমার পাশেই ছেলো, আমি ওর সাথে কথা কতি কতি উপর দিকি তাকায়ে আগোচ্ছি, হঠাৎ চেচানু শুনে ঘুরে দেহি পটলরে টানতি টানতি নিয়ে যাচ্ছে। দাও নিয়ে আমরা তাড়া করলাম, কিন্তু পটলরে বাচাতি পারলাম না। নাড়ি আলোয়ে ফেলালো।’ অচেনা পটলের জন্য মেয়েটির মনে দরদ প্রকাশ পায়। এরপর বলে, ‘দুনিয়ায় এত কাজ আছে, এই কাজ না করলি হয় না ?’ তার স্বামী হেসেছে, বলেছে,‘ পাগল, তাহলি খাবি কী? মহাজনের কাছেরতে দাদন নিছি, আর মাত্র তো একমাস, চইত মাসের মাঝামাঝি সময় থেইকে বইশেখ মাসের মাঝ তামাতি। এই হলো চাক কাটার সুমায়। বন অফিসিরতে পারমিট নিতি হয়, বিটারা খুব হারামি। ঘুষ না দিলি পারমিট দেয় না। তয় কী জানিস, এইবার তোরে থুয়ে আমার যাতি ইচ্ছে করতিছে না। বনের মধু মিঠে, তয় ঘরের মধু আরো মিঠে।’ সবল পেশীতে তাকে সে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছে, সে বাধা দেয়নি, সমর্পণ করেছে, নিজেকে মেলে ধরেছে, জীবনের নতুন অভিজ্ঞতায় শরীর মন ভরে নিয়েছে।

সেই আনন্দের রেশ মিলোতে না মিলোতেই তার জীবনে প্রথম ধাক্কাটা এসে লাগলো। মধুশিকারি স্বামী সেবার বাঘের শিকারে পরিণত হলো। সঙ্গের লোকেরা বহু খুঁজেও তাকে আর পায়নি। কিভাবে মেরেছিল বাঘ তাকে? মেয়েটি ভাবে। ঘাড়টা ভাঙা, খুবলে মুখের মাংস তুলে নেওয়া, নাড়িভুড়ি বের করা, যেমন সেইরাতে সে পটলের মৃতদেহের বর্ণনা দিয়েছিল। সে আর ভাবতে পারে না, হু হু করে কেঁদে ওঠে। সে কান্না ছুঁয়ে যায় সবাইকে। ‘আহারে, কাচা বয়সে মায়েডা বিধবে হলো, সওয়া যায় না।’ সহানুভূতি জানিয়ে বলেছে সবাই।

তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কয়েক পুরুষ ধরে বনে যাচ্ছে। বনই তাদের জীবন ও জীবিকা। ঐ বনে তাদের পূর্বপুরুষের আরো কয়েকজন বাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছে। এইরকম দুর্ঘটনা তাদের জীবনে নতুন নয়। মেয়েটির উঁচুকপাল, তিথি-নক্ষত্র এখানে কোনো ভূমিকা রেখেছে বলে ঘুণাক্ষুরেও তাদের মনে হয়নি। আর তারা তো বনে যাওয়ার আগে মৌলবি ডেকে বাড়িতে মিলাদ পড়িয়ে যায়। এইরকম যে ঘটতে পারে সে সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অবগত। মানসিক প্রস্তুতিও থাকে, তবে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা তাতে কম হয় না। নিজেদের সন্তান হারানোর বেদনার পাশাপাশি বালবিধবা মেয়েটির প্রতিও তাদের সহানুভূতি ঝরে পড়তে থাকে। তার ব্যথা লাঘব করার জন্যই হোক আর রূপসী মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে তার পূর্বসতর্কতার জন্যই হোক তারা তাদের দ্বিতীয় সন্তানের সাথে বিয়ে দেওয়ার অনুমতি চেয়ে পাঠায় তার মা-বাবার কাছে। দরিদ্র পিতার তাতে আপত্তি করার কিছু থাকে না। একটি মুখের আহার তাকে কম যোগাতে হচ্ছে, আক্রার সংসারে তাই-বা কম কী!

সবার পছন্দমতো সময়ে মেয়েটা দেবরকে বিয়ে করে দ্বিতীয়বারের মতো একই বাড়ির বউ হলো। প্রথম স্বামীর স্মৃতি তার মনে এতটাই টাটকা যে, নতুন স্বামীকে মানিয়ে নিতে তার খানিকটা সময় লেগেছে। প্রথম স্বামীর সান্নিধ্যে অনুভূত পুলক নতুন স্বামীর কাছেও সে অনুভব করেছে। একটি দুর্ঘটনার কারণে শেষ হয়ে যাওয়া ক’মাসের দাম্পত্য জীবনের অতৃপ্তি নতুন করে ঘুচানোর সুযোগ পেয়েছিল সে। কিন্তু ক’মাস যেতে না যেতে বাড়িতে আবার বনে যাওয়ার তোড়জোড় দেখতে পেল সে। গতবার মধুশিকারে তাদের লোকসান হয়েছে। ছেলেটা বাঘের থাবায় মারা যাওয়ায় মাঝপথেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাদের। দরকার মত মধু তুলে আনতে পারেনি। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়েছিল, তা শোধ দেওয়ার চাপ আসছে। বাওয়ালীদের সাথে তাই তারা বনে যাবে গোলাপাতা কাটতে। অজানা আশঙ্কায় মেয়েটির বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু স্বামীকে নিষেধ করতে পারে না। সত্যিই তো, বনে না গেলে দেনা শোধ হবে কোথা থেকে? আর খাবেই বা কী ? ছেলে বাঘের পেটে গেছে বলে মহাজন তো আর টাকা মাফ করে দেবে না। মুখে চুকচুক শব্দ করে দুঃখ পাওয়ার ভান করবে, কিন্তু পাওনাটা আদায় করবে কড়ায়-গণ্ডায়। এতটুকু ছাড় দেবে না। শোকের সাথে টাকার কেনো সম্পর্ক নেই।

যেদিন নৌকা ছেড়ে যায় সেদিন অনেকের সাথে সেও নদীর কুলে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবকিছু গোছগাছ করে নৌকা ছেড়ে যাওয়ার সময় তার স্বামী তার দিকে চেয়ে হাত নেড়েছিল। মাথায় কাপড় তুলে আঁচলের কোণাটা দাঁতে চেপে ধরে সেদিকে চেয়েছিল সে। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত নদীর কূলে দাঁড়িয়ে ছিল। নৌকাটা ছোট হতে হতে একসময় বিন্দুর মত দূরে মিলিয়ে গেল।

রাতে মেয়েটি একলা শুয়ে থাকে। পাশে শূন্য বিছানা। ঘুমের ঘোরে হাত পড়ে খালি জায়গায়। পাশে যে সমর্থ পুরুষ শুয়ে থাকতো সে এখন বনে গেছে। বিছানায় সে তার শরীরের স্পর্শ অনুভবের চেষ্টা করে। বালিশে নাক ঘষে তার মাথার ঘ্রাণ নিতে চায়। মাঝরাতে গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ঢেউ সজোরে আছড়ে পড়ে কূলে, না না কূলে নয়, তার বুকে। মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিকষ কালো অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা ছাড়া সে কান্নার আর কোনো সাক্ষী থাকে না।

এবার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বাঘে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গীরা গোলাপাতা কাটার হেঁসো নিয়ে বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাঘ মুখ থেকে শিকার ছাড়েনি। অনেকক্ষণ টানাহেঁচড়ার পর বাঘ পিছু হটেছিল বটে, কিন্তু শিকারকে জীবন্ত ছাড়েনি। লাশ নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসতে আসতে পথে পঁচে যাবে মনে করে সঙ্গীরা তাকে বনের মধ্যেই কবর দিয়ে এসেছিল।

এই ঘটনার পর মেয়েটির পতিভাগ্য নেই, নাকি তার স্বামীদের স্ত্রীভাগ্য খারাপ তা নিয়ে ভিতরবাড়ির মহিলাদের উঁকুনবাছার আসরে, নদীর ঘাটে বাইরের বাড়ির ঝিদের এঁটো সাফের জটলায়, বাজারে চায়ের দোকানে পুরুষদের আড্ডায়, দাদনদার-মহাজনদের গদিতে কাজ করা মহিলা-পুরুষরা অজস্র কথা চালাচালি করলো। যার কিছু কিছু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কানেও এলো। দুটি জোয়ান ছেলে হারানোর বেদনায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও নড়েচড়ে বসলো। হঠাৎ করেই তার উঁচকপালী চেহারা তাদের নজরে পড়লো, সেইসাথে তার মাঝে ধেইনাচুনি স্বভাব রয়েছে আবিষ্কৃত হলো। শৈশবে তাবিজ ভরে পেচ্ছাব করার ঘটনাটিও নতুন করে জানা গেল। লোকে যুক্তি দেখালো, বাঘে বেছে বেছে তার স্বামীদেরই ধরে কেন। দলে তো আরো লোক ছিল, এমন কি ওদের বাপও। তাহলে? নিশ্চয় ওর রাশিতে কোনো গণ্ডগোল আছে। পেটে থাকার সময় ওর মা’র উপর জ্বিনের আছরও হতে পারে। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটি ধীরে ধীরে অবহেলার পাত্র হয়ে উঠলো। উঠতে বসতে খোটা আর গালমন্দ শুনতে হলো। ক্রমে ক্রমে তার অপয়া হয়ে ওঠার কারণ ও লক্ষণের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। সে হয়ে পড়লো সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ-একা।

মহাজনের দেনাশোধের চাপ বাড়তে থাকে। তার দিশেহারা শ্বশুর কী করবে ভেবে পায় না। যার দুই দুটো জোয়ান ছেলে বাঘের পেটে যায় তার তো বেঁচে থাকবারই কথা নয়, তবুও মানুষ বেঁচে থাকে জীবনের নিয়মে, জীবনটাকে টেনে নিয়ে যেতে পরিণতির দিকে। এরই মধ্যে মহাজনের চাপ, কোনোমতেই সামলাতে পারে না বুড়ো। সময় নিতে থাকে, বারকয়েক সময় দেওয়ার পর আর দিতে চায় না সে। হঠাৎ একদিন অদ্ভুত এক প্রস্তাব নিয়ে আসে মহাজন। প্রস্তাব মানলে দাদনের সব টাকা মাফ, না মানলে সুদসহ ফেরতের চাপ। ‘বউ ঘরের লক্ষ্মী,’ আমতা আমতা করে বলে বুড়ো। ‘লক্ষ্মী! ওই বউ তোমার ঘরের লক্ষ্মী হলি অলক্ষ্মী কী?’ কালচে দাঁত বের করে হাসে মহাজন। একসময় মহাজনের প্রস্তাব নিয়ে স্ত্রীর সাথে আলাপ করে মেয়েটির শ্বশুর। তার ভাব দেখে মনে হয় এরকম প্রস্তাব খারাপ কিছু নয়, বরং আপদ বিদায়ের আসান এক তরিকা। ‘কিন্তু ওর মা-বাপের তো এট্টা মতামত আছে।’ মেয়েটির শ্বশুরের এ প্রশ্নে তার শ্বাশুড়ি তেমন গা করে না। ‘ওরা যদি মত না দেয়, মায়েরে নিয়ে যাক।’ সোজাসাপ্টা উত্তর। ওর মা-বাবার মত পেতে কষ্ট হয়নি। ‘আপনাগের দুডো তরতাজা ছওয়াল চলে গেল, আমার মায়ে যে অলক্ষ্মী অপয়া না, তা জোর দিয়ে কী করে কই। এহন ও আপনাগে দায়দেনা মুক্ত করুক।’ মেয়েটির বাপ বলেছিল। আর মেয়েটি? যখন সব জানতে পেরেছে প্রথমে কিছু বলেনি, চুপ করে থেকেছে, কেউ জানতে পারেনি সে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল কিনা। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা পরম্পরা ও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া একজন মানুষের আত্মহননের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সে তা করলো না। জীবনের শেষ দেখবে বলে? তা কেউ জানে না। কিন্তু এইটুকু অন্তত বোঝা যায় যে, দুইজন সমর্থ পুরুষের সান্নিধ্য যে পেয়েছে এইরকম একজন হাড় নড়বড়ে তেঁতুলরাশি বুড়োকে সে কীভাবে মেনে নেবে? আরো তার ঘরে দুই বিবি বর্তমান। ‘মা, আমারে আপনারা গলা টিপে মারে ফেলান,’ শ্বাশুড়িকে বলেছিল সে। ‘তুই মরবি! তোর মরণ নাই, তার চেয়ে ওই সুদখোর দাঁতাল মহাজনরে নিকে কর, তোর বদকুষ্ঠির জোরে ও যদি মরে আমরাও বাচপো, গিরামের মানষিরও হাঁড় জুড়োবে।’ ঝামটা মেরে তার শ্বাশুড়ি বলেছে।

মেয়েটির আপত্তি টেকেনি। যথাসময়ে মহাজনের সাথে তার নিকে হয়েছে। ‘শোন, আমি তো আর জঙ্গলে যাই না, আমি কিন্তু বাঘের পেটে মরবো না। তুই নিশ্চিন্ত থাকতি পারিস, লোকে তোরে যতই অপয়া কয় কোগগে, আমার ওতে কিছু যায় আসে না।’ বিয়ের রাতে মহাজন ওকে বলেছিল। নতুন নিকে করার পর সে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতো। দিন পনেরর মাথায় একদিন সন্ধ্যায় গদি থেকে ফিরলো মহাজন। হাতমুখ ধুয়ে হাল্কা নাস্তা করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ করেই তার বমি শুরু হলো, বমির সাথে রক্ত। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার এসে কিছু বুঝতে পারলো না। শহরের হাসপাতালে নেওয়ার বন্দোবস্ত করতে করতে সব শেষ। মেয়েটির অপয়া নামের ষোলকলা পূর্ণ হলো। পরদিনই মহাজনের লোকজন তাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। লোকে ডাকতে লাগলো ‘স্বামী খেকো অপয়া’ বলে। মেয়েটাও তাই জানলো, মানলো কিনা জানা গেল না। অশিক্ষা-কুশিক্ষার জমিতে যাদের নাড়ি পোতা, নিরক্ষর মানুষের ভ্রুণে নিরক্ষর মানুষের গর্ভে যাদের প্রাণের সূত্রপাত, পৃথিবীর আলোও যারা দেখে একজন নিরক্ষর মানুষের হাত ধরে, জীবনটাকে খরচ করতে থাকে অজ্ঞতাকেই জ্ঞানের পুঁজি মনে করে, শিক্ষার আলো গায়ে না মেখে সেখানকার কৈশোর পেরুনো একটি মেয়ে বারবার বৈধবের শিকার হয়ে লোকের কথায় তিতিবিরক্ত হয়ে যদি মেনেও নেয় সে অপয়া তাতে তার কোনো দোষ থাকতে পারে না।
‘জানেশুনে মহাজন এমন কামডা করলো কী করে! চোখির সামনে দেখলো মাগি দুডো ভাতার গিলে খালো, তারপরও! বুড়ো বয়সে ভীমরতি মানষির হতি পারে, তা দেখেশুনে ভালো ঘরেরতে এট্টা আনা যাতো না? ঐ অপয়া মাগি! দেখ কেমন ঠেহে। মরলিতো। যাঁতির তলে নুনু! ’ গাঁয়ের লোকে বলতে লাগলো।

শুধু মহাজনের বড় বউ ওই ঘটনার দিনকতক বাদে সারা বাড়ি তন্ন করে খুঁজে কোথাও ইঁদুর মারা গুঁড়ো ওষুধের কৌটাটা খুঁজে পেল না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়