ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মধ্যবিত্তের প্রপাগান্ডা অথবা ঘোড়ার ডিমের গল্প

সাখাওয়াত টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ২২ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধ্যবিত্তের প্রপাগান্ডা অথবা ঘোড়ার ডিমের গল্প


শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৪ বাংলায় কথকরাজা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুর মা’র ঝুলি’ বহির ভূমিকায় লিখিয়াছেন: ‘ঠাকুর মা’র ঝুলিটির মত এত বড় স্বদেশী জিনিস আমাদের দেশে আর কী আছে? কিন্তু হায় এই মোহন ঝুলিটিও ইদানীং ম্যাঞ্জেস্টারের কল হইতে তৈরি হইয়া আসিতেছিল।’ ঠাকুর মহাশয়ের এ হেন উক্তির শতবর্ষ গুজার হইয়াছে, এখন বাংলা ১৪২৫ পার হইতেছে। তাহাতে কি বিশেষ নজরানা ফলিয়াছে? ইহাতে দুই হইবার পারে। আমাদের নজর আনা আনা, যাহা ‘স্বদেশী’ আকারে বা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ আকারে পাই। এই গেল একপদের কথা। কিন্তু অন্যপদে কী? ‘ম্যাঞ্চেস্টারের কলে’ বানানো গল্প। যাহার নাম হইবার পারে শেকড়হীন ‘ম্যাজিক’। যাহার লেজে ‘রিয়ালিজম’ বা ‘বাস্তববাদ’ দিয়া জায়েজ করা হইতেছে। প্রশ্ন হইতেছে- এই ‘যাদু’ বাস্তব নাকি অলীক? যাহা ঘোড়ার ডিমের নামান্তর মাত্র। তাহার এন্তার কারণ পশ্চিমে বাস্তব ফলে। তাই তাহাদের কল্পনাও বাস্তব! আর পশ্চিমের বাইরে যাহা ফলে তাহা ‘যাদুর বাস্তব’ অথবা ‘ঘোড়ার ডিমের বাস্তব’। সখি, তো কাহাকে কহিব তবে আধিপত্যের সংস্কৃতি? যাহারা সাহিত্য-সংস্কৃতির দু/চারআনা খোঁজ খবর রাখেন তাহারা কহিতে পারিবেন পশ্চিমের শুকনা-পণ্ডিতির তত্ত্ব ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বা ‘যাদুবাস্তববাদ’ আসলে কী মাল? আমাদের কথা- গোলকায়নের যুগে যাদুবাস্তববাদ হইলো- দেশে দেশে জাতীয় সংস্কৃতিকে চাপা মারিবার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সংস্কৃতিক ক্ষমতা কায়েমের নব্যকৌশল মাত্র। নতুন কথায় কহিলে- যাদুবাস্তববাদ আদপে নয়া ঔপনিবেশবাদের স্ফীত দুয়ার। মুক্তবাজারি সাহিত্যেরই খোলামুখ। আজিকে আমাদের আলোচনার বিষয় যাদুবাস্তববাদ নহে। তবুও নক্তা আকারে ইহা তোলা থাকিল।

রবি ঠাকুর আমাদের দুয়ারে দুটি জিনিস হাজির করিয়াছেন। তাহার একখানা ‘ম্যাঞ্চেস্টারের কলে তৈরি গল্প’, অন্যটি ‘স্বদেশী গল্প’। প্রশ্ন হইতেছে- কোন গল্প করিয়া আমরা এ জীবন কাটাইয়া দিব? এ জীবনের গল্প ম্যাঞ্চেস্টারের কলে কাটিব নাকি স্বদেশী কলে গড়িব? তাহার উত্তর হইাতে নাই, আছে গতে। কারণ কহি তো শোনেন- বাংলা গল্পের জমিন মরানদীর মতো শুকাইয়া আসিতেছে। সেইখানে কাষ্ঠ-নদীর শুষ্ক বালি বাহির হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে অবুঝ লোকের কী হইবে তাহা আমাদের জানিবার কথা নহে। অন্তত এই বঙ্গদেশে উন্নয়ন-সাহিত্যের জোয়ারে বুঝদার লোকেরা স্বার্থপর ও বিকৃত হইবার উপক্রম হইয়াছে- যারপরনাই যাহা টের পাওয়া যাইতেছে। এই সত্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও টের পাইয়াছিলেন। ধন্য রবীন্দ্রনাথ, ধন্য!

 

আজিকে এই রচনাখানিক গল্পকার শহীদুল জহির লইয়া রচিতেছি, ইহা আমাদের দুঃখের কারণ নহে। আমাদের দুঃখের কারণ তিনি গত হইয়াছেন। গল্পের কলকব্জায় যাহাই থাকুক, শহীদুল জহির বাংলা গল্পে নতুন ভাষা লইয়া হাজির হইয়াছেন। ফলে এহেন সমালোচনা তাহার জীবনকালে করিলে মন্দ শোনাইত না। এইখানে কওয়া প্রয়োজন- সমালোচনা আর নিন্দা একপদের মাল নহে। দুই মালের মাঝখানে বিশাল গর্ত আছে। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি সেই ভাবের কথা জারি রাখিতেছি। রাহা করিতেছি বাংলা গল্পের এসপার-ওসপার লইয়া। কারণ কি, সত্য সত্য আকারে থাকে। কিন্তু কোনো মিথ্যা দোসরাভাবে মিথ্যা বলিলেও তাহাতে সত্যের ভাবই প্রকাশিত হয়। এইখানে মিথ্যা মানে ‘মিথ’ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। এই আমাদের সমালোচনার মাজেজা।
বিটিশরাজ বাংলা ছাড়িবার পরও বাংলার মাটিতে টেমস নদীর পানি গড়াইতেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চেহারা দেখিলে তাহার গতি-প্রকৃতি মালুম করা কঠিন নহে। এহনে সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতিতে ফলিতেছে নয়া-ঔপনিবেশের আলো। বিহনে যা, এই আলো প্রহরের আলো নহে, শনির আলোই কহিলে বেহতর যুক্তিসিদ্ধ হইবার পারে। বাংলায় বিটিশের গতর প্রস্থান হইয়াছে সত্য, তাহার চাইতে সরল সত্য- বাংলার নীতি-নৈতিকতায়, সাংস্কৃতিক রফা-দফায়, রাজ কলকব্জায় তাহার আছর আজ অব্দি রহিয়া গিয়াছে। কেনো তাহা হাড়ে হাড়ে রহিয়া গেল? কেনো ম্যাঞ্চেস্টারের কলে গল্প তৈয়ার হইতেছে? তাহা এখন প্রশ্ন আকারে হাজির হইতেছে। হাজির হইতেছে এ কারণে- ম্যাঞ্চেস্টারের কলে তৈরি গল্প খালি খালি গল্প নহে। কেননা জহির মনে করিতেন, গল্পের ইতিহাস হইতেছে ‘কুটির শিল্পের ইতিহাস’। এইখানে শহীদুল জহিরের ‘আমাদের’ শব্দখানি বাদ দেওয়া হইলো। কেননা শহীদুল জহিরের ‘আমাদের আমরা’ আর ‘আমাদের আমরা’র মাঝখানে মস্ত ফাটল রহিয়াছে। সংকীর্ণচিত্তে তাহা অনুধাবন করাও সহজ নহে। জহির যে সভ্যতার পরে ভর করিয়া গল্পের ইতিহাস দেখিতে চাহিয়াছেন- তাহা বুর্জোয়া সংস্কৃতির লেশমাত্র চেহারা। আলকিপ্টে মধ্যবিত্ত তাহাকে আলপিতের ধনের মতো বহিয়া বেড়াইতেছেন। ‘কুটির শিল্প’ বা ‘লেদ মেশিনে’ যাহা পর্যবসিত হইয়াছে। জনশিল্প তাহাতে অনুপস্থিত কিংবা থাকিলে তাহা বনসাই আকারে থাকিতেছে। তাহা হইলে গল্পের ইতিহাস কী হইবে? ‘কুটির শিল্প’ নাকি ‘জনশিল্প’? আমাদের ইতিহাস হইতেছে জনশিল্পের ইতিহাস। তাহা হইলে আমরা কি লেদ মেশিনে বা কুটির শিল্পে আপন গলা কাটিব? তাহার সুরাহা দরকার।

শহীদুল জহিরের গল্পের বহি তিনখানা- ‘পারাপার’, ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’। তিনখানা বহিতে জহির বেশি গল্প লেখেন নাই, তবে প্রায় তিন দশক ধরিয়া এসব গল্প বানাইয়াছেন তিনি। তাহার ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ আর ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’-এর বহিতে একই ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ দুইবার সংকলিত হইয়াছে। শেষ বিচারে ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ বহিতে শুদ্ধপাঠ সংরক্ষণ করিতে তাহার এমন মাজেজা। মাজেজার মজা এই- গল্পের শেষে দাড়ি (।) না রাখা। জহির বলিতেছেন, ‘গল্পের অন্তিমে বাংলা যতি চিহ্নি দাড়ি (।) না রাখাটাই শুদ্ধ পাঠ বলিয়া বিবেচিত।’ জহিরের এই শুদ্ধপাঠ শুদ্ধ বলিয়াই বিবেচিত হইত যদি তিনি গল্পের ভাষা ও বানানরীতিতে তাহা রক্ষা করিতেন। এতদবিষয়ে উদাহরণ লেখস্য নাস্তি। তবে প্রশ্ন হইতেছে- দাড়ি (।) দেওয়া না দেওয়া নিছক শুদ্ধ মার্জনা নাকি গল্পের প্রপাগান্ডা? তাহার মত, ‘গল্পের অন্তিমে খোলা।’ পাঠক-পাঠিকাগণ খেয়াল রাইখেন- খোলা বা উন্মুক্তের মধ্যে প্রপাগান্ডার তফাৎ কদ্দুর? জহির কী ভাবিয়া এই কাণ্ড করিয়াছেন তাহা জিজ্ঞাসিবার সুযোগ বর্তমানে নাই। তাহা আমাদের নজরেই থাকিল। তো আমাদের মত, জহিরের দাড়ি বিষয়ক মন্তব্যখানি প্রপাগান্ডা বৈ, আর কিছু নহে! প্রশ্ন উঠিতেছে- দুই বহিতে একই গল্প হাজির করিয়া তিনি কি অন্যকিছু জাহির করেন নাই? জহির ইহাতে অন্যকিছু জাহির করিয়াছেন। এই অন্যকিছু কী? তাহার প্রপাগান্ডা কহে- এই ‘অন্য কিছু’র মানে শুদ্ধবাদী সাহিত্যের টোডো-জ্ঞান। কারণ তিনি গল্পের গঠন ধরিয়াছেন ‘কুটির শিল্পের ইতিহাস’ দিয়া। কুটির শিল্প তো যন্ত্র শিল্পেরই একনাম মাত্র। মন ও মন্ত্র তাহাতে অন্তর বায় ওষ্ঠাগত। কেননা গল্পের ইতিহাস তো শুধু শুধু যন্ত্রশিল্পের ইতিহাস নহে, তাহাতে জনশিল্পের ইতিহাস স্রাতোস্বিনী সাগরের মতো বহিয়া বেড়াইতেছে। তাই জহিরের গল্পজ্ঞান তথা সুদূর পরাহত। তাহার বর্তমান নাই, আগত দিনও গত। কিন্তু পরিণতিইবা কোথায়? ঘোড়ার ডিমের গল্পে? জহিরের বয়ান:

‘পুলিশকে আমরা জিজ্ঞেস করি, তরমুজ খাইবেন? তারা আমাদের ধমক দেয়, ধূত, আমরা হাসি, কারণ, পুলিশ দেখলে আমাদের সব সময় হাসি পায়; আমরা বুঝতে পারি যে, তরমুজ হচ্ছে ঘোড়ার ডিমের মতো, পঁচে যেতে পারে, ভেজাল হতে পারে না...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১২০]
‘আমাদের বড় অস্থিরতা হয়, আমরা পুনরায় মহল্লার তরমুজওয়ালার কাছে যাই এবং জানতে চাই, তরমুজ গাছের ডিম কিনা, কিন্তু সে বলে তরমুজে তা দিলে তরমুজ জন্মে না, ঘোড়ার বাচ্চা জন্মে...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১২৫]

গল্প কি নিছকই গল্প? তাহার ভিতরে কি বাস্তব বলিয়া কিছুই নাই? পানীয় ফল তরমুজকে প্রতীক করিয়া মৈশুন্দি এলাকায় গল্পের ঘটনা বিস্তারিত হইয়াছে। মৈশুন্দি কেন, নৈশুন্দি এলাকা হইলে ইহাতে দোষের কিছু নাই। এখানে দেখিবার বিষয়, অবাস্তব কীভাবে বাস্তবকে নির্ধারণ করিতেছে। জহিরের ধারণা- যাহা নাই, তাহা দেখানোই গল্প। অর্থাৎ যাহা কথায় আছে, বাস্তবে নাই। জহিরের অতি উৎসাহী ভক্তরা হয়ত কহিতে পারেন- গল্পে যুক্তি বা জ্ঞান চলে না। জহির যে গল্পে অযুক্তি ফলাইয়াছেন তাহাও নহে। তাহার ধারণা- গল্প বা তরমুজ ভেজাল হইতে পারে না। যে সংজ্ঞা বা সংস্কৃতির ওপর ভর করিয়া তিনি গল্প বানাইয়াছেন, তাহা ভেজালেরই অন্য রূপ। মোটেও নির্ভেজাল নহে। এই প্রপাগান্ডা মধ্যবিত্তের কলেই বানানো। তাহাতে কৃষক নামে আছে, কামে নাই। গল্পে যাহা আছে, তাহা- গাঁ থিকা শহরে আসা নানা কারবারীদের অনুমান। কারণ ঘটনার অনুমান পরিমিতি পাইলে তাহাকে ধারণার মান বলা যাইতে পারে। জহিরের অনুমান মান পায় নাই, তাহা অনুর ঘরে ধরফড়াইয়াছে। যন্ত্রশাসিত কলতন্ত্র জহিরকে কীভাবে শাসাইয়াছে পাঠক-পাঠিকা লক্ষ কইরেন-

‘কিন্তু কৃষকদের কথা আমরা ভুলতে পারি না, আমরা আবার তরমুজওয়ালার কাছে যাই, গিয়ে বলি, গ্রামের মানুষ এমুন খবিশ ক্যালা, হালারা হোগা বাইর কইরা রাখে ...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১২৪]

গল্পের এই পরতে কৃষক আর গ্রামের মানুষ সমার্থকই বটে। তাহার চোখে কৃষক ওর্ফে গ্রামের মানুষ এক্কেবারে ‘খবিশ’। ‘খবিশ’ শব্দের সদ অর্থ করিলে হয় ‘অপদেবতা’। তাহার মনোবাঞ্ছায় ইতর কিংবা পামরের প্রতি ঘৃণা গোপন থাকে নাই। ‘ইতর’ বা ‘অপদেবতা’ নামক মানুষ্য প্রজাতি- যাহারা জহিরের তথাকথিত ‘আমরা’র দিকে ‘হোগা বাইর কইরা রাখে’। এই হইতেছে- তাহাদের (জহিরের আমাদের) কৃষকের কথা না ভোলার কারণ। কহিতে পারেন, তাইতো- কৃষক বা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ‘অপদেবতা’ বলিয়া বিবেচিত? ‘হোগা লুকিয়ে রাখা’ সাফসুতোর মধ্যবিত্ত নয় বলিয়াই কি এমন খেদ? এই খেদকে অশুদ্ধ না কহিলে বিদ্বেষ বলিয়া প্রতীয়মান হয়। ইহাই মধ্যবিত্তের রুচি সংরক্ষণ করিবার বিরল বাসনা বটে। তাহার অতি উৎসাহী ভক্তকুল যাহাদের দলে টানিয়া জহির ‘আমরা’ বলিয়াছেন, তাহারা কহিতে পারেন- ‘না, না, এতো যাদুবাস্তবতা। উনি যাদুর বাস্তবেই আছেন। জবরদস্ত মালুম। এই বাস্তব কী জিনিস? অবাস্তবের নির্ধারিত বাস্তব। কারণ জহিরের বাস্তব সংশয়ী নহে, সন্দেহ আকীর্ণ। এহেন ভুল অঙ্কে কলমের কালি ফুরাইবে ঠিক, তবে ইতিহাস কাহাকে ছাড়িবে না। কেননা বাস্তব নির্ধারিত হইতে অবাস্তবের ধারণা তখনই নির্ধারিত হয়। ফলে অবাস্তবের কল্পনার ফানুস তাহাকে ভুল অঙ্কে ধাবিত করিয়াছে। তাই জহিরের গল্পে মানুষ থাকে তাহারই প্রতিপক্ষ। জহির হন মধ্যবিত্তের কাঠমোল্লার সেফাত। কারণ তাহাদের ‘দেশ’ বলিতে ‘নগর’, ‘মানুষ’ বলিতে ঠাঁই ‘মধ্যবিত্ত’।

মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির বড় সংকট কী? শ্যাওলার মতো নদীর স্রাতের মধ্যে ভাসিয়া যাওয়া। তাহাদের একূল-ওকূল দু’কূলই নাই। সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদের মাঝখানে এইবৃত্ত ভাসিয়া থাকে। শেকড় গাড়িতে চাহে না। না গাড়িবার ঐতিহাসিক কারণ- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ। তাহারা ক্ষোভ প্রকাশ করিবে, কিন্তু বিক্ষোভ করিবে না। সমাজ বদল তাহাদের ধাতে নাই। এইখানে বদল মানে অদল নহে। বদল মানে বিপ্লব। মধ্যবিত্তে আরো একপদের মাল থাকে, যাহাকে বলা যায় উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। জহিরকেই সাক্ষী রাখিতেছি-

‘আমরা হাঁচি দেওয়ার যৌন আনন্দকে আবিষ্কার করি, আমাদের জীবনে তিনটি জিনিস শনাক্ত করিতে পারি, লেদ মেশিন, তরমুজ এবং মস্তিষ্কের শেকড়ের গোড়া থেকে উঠে আসা হাঁচি দেয়ার আনন্দ...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১১৫]
‘আমরা রূপমহল সিনেমা হলে চান্দা অথবা তালাশ, অথবা উভয় ছবিতেই তাকে দেখি; তাকে দেখে আমাদের বিষণ্নতা বেড়ে যায়, কারণ বুঝতে পারি কি অসাধারণ সুন্দরী সে, কিন্তু সে আমাদের নয়...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১১৯]
‘সাদা তরমুজের ভেতর লাল রঙ এবং চিনির পানি ইঞ্জেকশন করে ঢোকান হয়, ফলে তরমুজ হয় লাল এবং মিষ্টি, এই কথা শুনে আমরা বিস্মিত এবং একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ হই, আমাদের মনে হয় যে, মানুষের জীবনে কি আর কোন মূল্যবোধই অবশিষ্ট থাকবে না...’

[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস/পৃষ্ঠা-১১৯]

জহিরের বয়ানে- সাদা তরমুজের ভেতরও সাদা। লাল রং এবং চিনির পানি ইঞ্জেকশনের পানি পুষ না করিলে ইহার ভেতর লাল হয় না। তরমুজ বা মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তরঙ্গ আর বহিরঙ্গ দুই বিবেচনা করিলে জহির এক নাগরিক মূল্যবোধ পুষ করিয়াছেন। বাজার ব্যবস্থাপনার নতুন রঙের বিশ্বাস ম্যানচেস্টারের নতুন কলে কায়দায় হাজির করিয়াছেন। আপনি নিজেই বাজার, কিন্তু আপনি টের পাইবেন না। শুধু জহিরের মতো নতুন রং খুঁজিবেন। আর ক্ষুব্ধ হইবেন। জহিরের আগে, যাহারা মধ্যবিত্তের তথাকথিত মূল্যবোধের কলে গল্প বানাইতে চাহিয়াছেন তাহারা মোটেও কামিয়াব হয়েন নাই। রাষ্ট্র নায়ক হইতে ডাহা ডাহা গল্পকার পর্যন্ত এ বেলায় ঢের উদাহরণ টানা যাইবে। তাহা টানিয়া উদাহরণের প্রশস্তি বাড়াইবো না আর। তবে যুক্তি না টানিলে মুক্তি ঘটিবে কিনা সংশয় আছে। রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ‘লেভ তলস্তয় এজ দা মিরর অব দা রাশান রেভ্যুলেশন’ রচনায় বলিয়াছেন: ‘উদার নৈতিকদের কপটতা অনেক বেশি পরিশীলিত। এই কারণে ইহা অনেক গুণ বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক।’

শহীদুল জহির অনেক বেশি পরিশীলিত লেখক। ভাষা টানটান। গ্রাম আর নগর মিশ্রিত ভাষার কোলাজ করেন। গল্পের বয়ানে সিদ্ধহস্ত। প্রয়াণের পর কেহ কেহ লেখায় তাহাকে নিভৃতচারী বলিয়া দাবি করিয়াছেন। তাহারা কারণ হিসেবে জানাইতেছেন, সাহিত্যিক কোলাহল হইতে তিনি দূরে থাকিতেন। কথাখানি সর্বাঙ্গে সত্য নহে। কারণ সাহিত্য প্রকাশের ধর্মই  চেতনাগত মত বা দল সৃষ্টি করা। ইহাকে আপাত ‘কোলাহল’ মনে না হইলেও মত বা দল কম কোলাহলের জিনিস? কারণ মতের উপস্থিতি শরীরী অনুপস্থিতির চাইতে কম শক্তিমান নহে। বরং চেতনার সংগঠিত রূপ বেশি। এহেন প্রশ্নের উত্তরে তাহার সুরাহা হইবে নিশ্চয়ই। তিনি নিভৃতচারী নহেন। তবে তিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম প্রতীক- ইহাই সত্য।

ইহলোকে শহীদুল জহিরের দেহ নাই, একদা ছিল। তবে তাহার গল্প আছে। উপন্যাস আছে। সাহিত্য আছে। আছে, কী রূপে আছে, তাহার ভবিষ্যতের উত্তর উত্তরেই রহিল। তিনি শ্রেণী নিয়া চিন্তিত নহেন। চিন্তিত জনসংস্কৃতির বাহুল্য বিশ্বাস নিয়ে। তো বাংলাদেশের সাহিত্যে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক সংস্কৃতির হাল-হকিকত বুঝিতে শহীদুল জহিরের তুলনা মেলা ভার। আর শহীদুল জহির আমার পছন্দ। কারণ মধ্যবিত্ত সমাজকে তাহার আয়নায় স্পষ্ট দেখিতে পাই। পাঠক, এই সত্য অনুধাবন করিবেন নিশ্চয়ই।

তালাশ:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুর মা’র ঝুলির ভূমিকা [১৩১০], বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত; অবসর প্রকাশনী, ঢাকা ২০০৭

২. রস্তিস্লাভ উইলিয়ানভস্কি: এশীয় ও আফ্রিকার সমকালীন সমস্যা; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৬

৩. আজফার হোসেস: জাদুবাস্তবতার সাংস্কৃতিক রাজনীতি; দৈনিক সমকাল, ঢাকা, ২০০৮

৪. সলিমুল্লাহ খান: আমি তুমি ও সে; সংবেদ প্রকাশনী, ঢাকা ২০০৮

৫. শহীদুল জহির: ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯

৬. শহীদুল জহির: ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৪

৭. V.I. Lenin: Leo Tolstoy as the mirror of the Russian Revolution, Lenin collected Works, Progress Publishers, Moscow, 1973

 

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও তাত্ত্বিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়