ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শহীদুল জহিরের সঙ্গে

মাহবুব মোর্শেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২৩ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদুল জহিরের সঙ্গে

আমি কখনো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দেখা পাইনি। তবু সাহিত্যজ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাকে শিক্ষক গণ্য করতাম। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার যেখানে যা প্রকাশিত হতো পড়ে শেখার চেষ্টা করতাম। কেউ তার সঙ্গে দেখা করেছেন শুনলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতাম- তিনি কেমন, কী বলেন, কীভাবে বলেন?
আমি যখন ঢাকা আসি তখন তিনি অসুস্থ, ক্যানসার-আক্রান্ত। সুযোগ পেলেও তার সঙ্গে দেখা করতে আর যাইনি। ১৯৯৪-৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিতে তার ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ ও ‘খোঁয়ারি’ এই দুই গল্পের বই পড়েছিলাম। সাইমন জাকারিয়ার কাছ থেকে নিয়ে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ও পড়েছিলাম। সাইমন জাকারিয়া কলেজে আমার দুই বছরের বড় ছিলেন। আগে পাশ করে উনি ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছাত্র হন। তার কাছ থেকে ইলিয়াসের গল্প শুনতাম। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতাম কথাসাহিত্য বিষয়ে তার মত।
সাইমন জাকারিয়া বলেছিলেন, আগামী দিনের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে ইলিয়াস কয়েকজনের নাম করেছেন। শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, ওয়াসি আহমেদ, মহীবুল আজিজ, মঞ্জু সরকার।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আশির দশকের গল্প’ বই থেকে এই গল্পকারদের লেখা পড়লাম। গল্পকার হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পরোক্ষে যাদের চিনিয়ে দিলেন তাদের মধ্যে শহীদুল জহির ও মামুন হুসাইনকে আলাদা করে মনে ধরলো। ঢাকা ও কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্রিকাগুলোতে তাদের লেখা প্রকাশিত হলে খুব মন দিয়ে পড়তাম।
কলেজে থাকতেই লাতিন আমেরিকার সাহিত্য আমার মন কেড়ে নিয়েছিল। তখন দুটি বিষয় নিয়ে খুব কথা হতো। উত্তর আধুনিকতা ও যাদুবাস্তবতা। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বেশ আসতো। কোনো এক রহস্যময় কারণে বইগুলো পাবলিক লাইব্রেরি ও গণগ্র্রন্থাগারে পাওয়া যেত। কিছু বই বইয়ের দোকান হতে আমাদের পরিচিত ক্রয়ক্ষমদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে চলে যেত। আমার সুযোগ ছিল সেগুলো চেয়ে পড়ার। অজান্তেই লাতিন আমেরিকার সাহিত্য আমার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমাদের আগের পরের অনেক সাহিত্যিক সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রভাবের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। যাদুবাস্তবতা নিয়ে আমরা অনেক ভাবতাম ও আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম।
আগের কোন কোন বাঙালি লেখকের মধ্যে যাদুবাস্তবতা আছে তা নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করতাম। তখন মনে হতো, শহীদুল জহির বাংলা ভাষায় যাদুবাস্তবতা আত্মস্থ করার কাজটি করতে পেরেছেন। ‘আমরা’ বহুবচনে তিনি গল্প বর্ণনা করতেন। বর্ণনার মধ্যে বাক্যসজ্জা একটা রহস্য তৈরি করতো। পুনরুক্তি ও অলীক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একটা ঘোর তৈরি হতো। সাথে ছিল তার বিস্ময়কর কল্পনাশক্তি। লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের ভক্ত হিসেবে আমাদের কাছে শহীদুল জহির জরুরি লেখক। কেননা, আমরা সকলে ওরকম করে লিখতে চেয়েছিলাম একটা দীর্ঘ সময়। শেষ পর্যন্ত পেরে উঠি নি। তিনি পেরে উঠে উঠেছিলেন।

প্রথম দিকের গল্পে আমি সরাসরি লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্য প্রভাবিত ছিলাম। পরে শহীদুল জহির আমাকে প্রভাবিত করেন। শহীদুল জহিরের প্রভাবে আমি যে গল্পগুলো লিখেছি তার কয়েকটা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে প্রথম বইয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো প্রশংসিতও হয়েছিল। বইটি পুরস্কারও পেয়েছিল। ঘটনাচক্রে পুরস্কার আনতে গিয়ে শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ দেখা হয়। সে বার কাগজ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন শহীদুল জহির। কাগজ তরুণ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলাম আমি। শহীদুল জহিরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন আমার বই তিনি পড়বেন।
পড়লে তিনি হতাশ হতেন। কেননা, আমার গল্পগুলো থেকে তিনি নতুন কিছুই পেতেন না। নিজের অদক্ষ ছায়া দেখতে পেয়ে একটু মুচকি হাসতেন।
পরে ধীরে ধীরে আমি শহীদুল জহিরের পথ থেকে সরে আসি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, গল্প মানে ভাষা ও ভঙ্গি নয়। স্টোরি গল্পের মূল। স্টোরিটেলিং গল্পের আসল মুন্সিয়ানা। শহীদুল জহির স্টোরিটেলার হিসেবে ভালো। তার স্টোরিও নতুন। কিন্তু গল্প ছাপিয়ে তার কথাসাহিত্য কখনো কখনো পরাবাস্তব একটা কাঠামোয় পর্যবসিত হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের গল্পেও কখনো কখনো স্টোরির চেয়ে প্রকরণ বড় হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
লোকে তখন আমাকে ‘শহীদুল জহির প্রভাবিত’ বলতো। তাতে আমার লজ্জা লাগতো। আমাকে দেখতে অন্যের মতো এটা খুব উপভোগ্য নয়। কিন্তু শহীদুল জহিরের হাত ছেড়ে দেওয়া খুব সহজ কাজি ছিল না। খুব সচেতনভাবে আমি শব্দ ও বাক্যের মারপ্যাঁচ ও কেরামতি থেকে সরে আসার চেষ্টা করি। সরল ও ঐতিহ্যবাহী গদ্যে লিখতে শুরু করি। স্টোরিটেলিং শেখার দিকে মন দেই। যারা আগে আমার গল্পের প্রশংসা করতেন তারা যখন প্রশংসা করা বন্ধ করলেন তখন আমি বুঝতে পারি, কাজ হয়েছে।
মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট নাকি বলেছিলেন, কবিতা তাই যা অনুবাদে হারিয়ে যায়। কথাটা আমরা বিশ্বাস করেছি। কেননা, একটি ভাষার নিজস্ব ইশারা ও না-বলা কথাকে কবিতা যেভাবে ধারন করে তা কখনোই অনুবাদ করা সম্ভব নয়। অন্যভাষার কবিতা মানুষের স্মৃতিতে খুব কমই থাকে। যৌথস্মৃতির অংশও হতে পারে না। ভিন্ন অর্থ তৈরি করার রহস্যময় ক্ষমতা ছাড়া কবিতা কার্যকর হয় না। কিন্তু কথাসাহিত্যের বাস্তবতা ভিন্ন। গল্পের সর্বজনীনতা অনুবাদে অক্ষুণ্ন থাকে। ভিন্নভাষার গল্প অনুবাদের পর অন্যভাষার কল্পনায় পুনর্নিমিত হতে পারে কাহিনির সর্বজনীনতার গুণে। অন্য কথায়, অনুবাদে কথাসাহিত্য অক্ষুণ্ন থাকে। যদি না থাকে তবে তাতে হয় কবিতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, নয়তো প্রকরণ গল্পের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।

শহীদুল জহির নিয়ে বলতে গিয়ে এসব কথা বলা হয়তো ঠিক হলো না। তিনি আমাদের সাহিত্যস্মৃতির অংশ হয়ে গেছেন।
এইটিজে আমাদের সাহিত্যে বাঁকবদলের চিন্তাটা কোথা থেকে সঞ্চারিত হয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু বাঁকবদলের চেষ্টায় বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছ থেকে কথাসাহিত্য সরে গিয়েছে। জাতীয় কল্পনার যে ছবি কথাসাহিত্যে ফুটে ওঠার কথা ছিল তা আর হয়নি। কথাসাহিত্য যতটা সাহিত্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে, যতটা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে এর আগে তা হয়নি। শহীদুল জহির এই প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন। ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’তে এসে আমার মনে হয়েছিল তিনি যেন সরে আসছেন। আমাদের সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তিকে অন্যভাষার সাহিত্যের রেফারেন্সে বিবেচনা করা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। কিন্তু তা-ই করতে হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘কান্না’ ও ‘রেইনকোট’ পড়ে মনে হয়েছিল, আমাদের সেরা লেখক অবশেষে সেরা ভাষার খোঁজ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মরে গেলেন। শহীদুল জহিরও শেষ পর্যন্ত মীথ হয়ে রইলেন। শহীদুল জহির আমাদের স্মৃতির মধ্যে বহুকাল থাকবেন। তাকে নিয়ে সত্য কথাগুলো আলোচনা করার মতো যোগ্যতা এখনও আমাদের হয়নি। সময় লাগবে। সে পর্যন্ত আলোচনা তোলা থাকুক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়