ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমাদের আর্ট কলেজ, আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা

সাইদুল হক জুইস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৬ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের আর্ট কলেজ, আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা


১৯৭৬ সালে আমি ঢাকা আর্ট কলেজে (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হই; বঙ্গবন্ধু হত্যার এক বছর পর। তখন এক অনুজ্জ্বল সময় পার করছি আমরা। চারপাশ থমথমে, যা ছিলো অবরুদ্ধ সময়ের ইঙ্গিতবাহী। ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, এখানে ছাত্ররা মূলত দুই ধরনের মানসিকতায় বিভক্ত। আরো সহজেই বুঝে গেলাম কোন দিকের মানসিকতার সঙ্গে আমাদের মনের মিল ঘটবে। তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে আমি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডেলে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। এই গ্রুপের সিনিয়রদের সঙ্গে কবি, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালকদের দারুণ সখ্য ছিলো। এতে আমরা খুশি-ই হয়েছিলাম। কারণ শুধু আঁকা নয়, সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগটা তৈরি হতে লাগল। আমি মনে করি, ভাগ্যক্রমে সেদিন এই দলে ভিড়েছিলাম। আর্ট কলেজ বা চারুকলা ইনস্টিটিউটের জন্মলগ্ন থেকে যারা সংস্কৃতিমনা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রতিবাদী মানসিকতা ছিলো। তারা ভীষণভাবে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশের রাজনীতিতে যখনই কোনো অন্যায় হয়েছে, চারুকলা থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। চারুকলার শিল্পীরা নিজেদের ভঙিতে এই প্রতিবাদ করে এসেছে সবসময়, যা দেশের সংস্কৃতিতে ঐতিহাসিক স্বাক্ষর রেখেছে। তারই একটি বিশাল ঐতিহ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা।
আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন আর্ট কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন চলছে। প্যানেল তৈরি করে একটি দল যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমরাও সকলে মিলে প্যানেল তৈরির প্রস্তুতি নিলাম। ওই দলটির সঙ্গে আমাদের মানসিকতার বড়ো ধরনের বিভেদ ছিলো। আমরা কলিম শরাফীর ছেলে আজিজ শরাফীকে ভিপি পদে রেখে অন্যান্য পদ ভাগ করে প্যানেল দিলাম। ‘ভোট দিন’ এ জাতীয় কোনো স্লোগান এই নির্বাচনে আমরা ব্যবহার করি নি। আমাদের দলে কেউ কেউ গিটার, ড্রামসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র খুব ভালো বাজাতে পারত। ভালো মিউজিশিয়ানও ছিলো। এদের নিয়ে সকালবেলা কলেজের ভেতর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে শোভাযাত্রা করতাম। পুরো কলেজে ঘুরতাম। মুখে ভোট চাইতাম না। ওখান থেকে শুরু হলো ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা করা। মাথায় যে মুকুট পরে এই মুকুটও আমরা বানিয়েছিলাম। আমি তখন ব্যাচেলর বাসায় থাকি। আমার বাসায় কয়েকজন মিলে রাতে মুকুট তৈরি করতাম, দিনে সেগুলো পরে প্রচার করতাম। আমি কাগজ কেটে কাজ করি। এরপর কাগজ কেটে বাঘ, পেঁচার মুখোশও আমরা সবাই মিলে বানিয়েছিলাম। যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের চরিত্র অনুযায়ী কিছুটা ফান করে এসব মুখোশ তৈরি করা হয়েছিল। এভাবে আমরা পুরো নির্বাচনী প্রচারনাটা আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে করলাম। শেষের দিন শোভাযাত্রা আরো অলঙ্কৃত ও সমৃদ্ধ হলো। আমাদের ওই নির্বাচনী শোভাযাত্রার সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার একটা যোগসূত্র পাওয়া যায়।

আমি যে সময়ে আর্ট কলেজের ছাত্র তখন বাংলাদেশে সামরিক সরকারের শাসন। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে। এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আর্ট কলেজে নানা ধরনের উৎসব চলতো। আমরা একবার কলেজের বকুলতলায় যাত্রা অনুষ্ঠান করলাম; যা বাংলার ঐতিহ্যগুণে অনন্য সম্পদ। এটি কিন্তু এখনো চারুকলায় বৈশাখী উৎসবে অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে আর্ট কলেজে কিছু তরুণ উদ্যমী ছাত্র যশোরে চারুপীঠের আয়োজনে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা করলো। সম্ভবত ১৩৯৪ সনের প্রথম সকাল ছিলো সেটি। সেই শোভাযাত্রায় বাংলার ঐতিহ্যের প্রতিফলন দারুণভাবে ঘটেছিল। এই শোভাযাত্রার সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার যোগসূত্র রয়েছে।
এরপরই আর্ট কলেজে জয়নুল মেলা হলো। এটি পরবর্তী সময়ে উৎসবে রূপ নিলো। সেবার বিশেষ করে একটি বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা জয়নুল উৎসবে নিজেদের আয়োজনে শোভাযাত্রা বের করলো। সেই শোভাযাত্রাও লোকশিল্পের উপকরণে সমৃদ্ধ ছিলো। সত্যটা হলো এই, প্রতিকূলতার মধ্যেই মানুষ বেশি করে নিজেকে, নিজের দেশকে উপলদ্ধি করতে পারে। দেশ যখন স্বৈরাচার ও মৌলবাদীদের খপ্পরে, সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অনেক আন্দোলনের জন্ম হয়। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে আর্ট কলেজে আবির্ভূত হলো কিছু তরুণ ছাত্রছাত্রী, যাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ। সর্বোপরি মুক্তমনা মানুষের প্রবল উৎসাহে আর্ট কলেজ থেকে পহেলা বৈশাখে (১৯৮৯) বের হলো আনন্দ শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রাই পরবর্তী সময়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি পায়। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল, যা বাঙালির একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। যত দিন এগিয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এটি ভূগোল ভুলে বিশ্বের সকল বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। এপার বাংলা, ওপার বাংলা, প্রবাসী বাঙালি সকলেই তাদের মতো করে বাংলার ঐতিহ্যের রং, রসে মেতে উঠে এই দিনটিতে আনন্দ-আয়োজন করে। গর্বের বিষয় হলো নানা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এটি আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে।


লোকশিল্পের সঙ্গে জনসাধারণের যোগসূত্রের ছোটো একটা গল্প বলছি, বাকুরার লোকশিল্পীদের তৈরি একটি পেঁচা কলকাতা থেকে এনে একবার এক লোক তার সহকর্মীকে উপহার দিয়েছিল। উপহারটি সহকর্মীর পছন্দ না হওয়ায় সে ড্রয়ারে রেখে দিলো। এরপর হঠাৎ একদিন কলকাতার ‘সানন্দা’ পত্রিকায় ওই পেঁচার উপর একটি আর্টিকেল দেখে লোকটির উপহারের কথা মনে পড়ল। সে ড্রয়ার থেকে পেঁচাটা বের করে তখন টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলো।
মানুষ পুতুলকে শুধু পুতুল হিসেবে গণ্য করে। এটা আসলে আরো অনেক বড়ো কিছু। যখন বিভিন্ন মিডিয়াতে এসব উঠে আসে তখন মানুষ এর মর্ম উপলব্ধি করে। একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হয়েও এসবের আর্ট ভ্যালু কোথায় আগে বুঝতে পারেন না অনেকে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালি তার নিজের জিনিসটিকেই পুনরায় দেখছে। এই গর্বের জায়গাটা তৈরি করার জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা অনেক বড়ো প্ল্যাটফর্ম।

কলকাতা থেকে অনেক লোকজন এপারে আসত। রবীন্দ্রনাথ পরিচিতদের বলতেন, এ ধরনের জিনিস পেলে নিয়ে আসবে। কিন্তু এটা ভালো, এটা মন্দ এমন বিচার করে এনো না। যা পাবে সবই নিয়ে আসবে। কারণ তুমি যে বিচার করবে সেটা ভুল হতে পারে। তোমার বিচারে মূল্যহীন হলেও সেটা অনেক মূল্যবানও হতে পারে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা এরকমই একটি বিষয়। এর চেয়ে বড়ো আর কি হতে পারে? এজন্য বিষয়টি মানুষকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। এটা মানুষের ভেতরে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যে উপকরণ ব্যবহার হয় সেগুলো বৈশাখ উৎসবের উপকরণ হিসেবে সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় এখন বৈশাখী উৎসব পালিত হচ্ছে এবং এটি এখন ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যার উপর অনেকের জীবিকা নির্ভর করছে।
কয়েক বছর আগে আমি বৈশাখের কাজের জন্য কাপড় কিনতে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে পাইকারী দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানের মধ্যে দেখি, প্যাকেট করা অনেক পোশাক। কথা বলে জানতে পারলাম, এগুলো বৈশাখের পোশাক। পোশাকগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবে। প্রতিটি পোশাকের  নিজস্ব রং আছে। আমার ধারণাই ছিলো না, বৈশাখের এই উৎসব এতো বড়ো ব্যবসায়িক রূপ নিয়েছে। বৈশাখী উৎসব আজ সর্বজনীন। এর অনেক অবদানই আর্ট কলেজ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে উৎসারিত।

মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু উৎসব নয়, প্রতিবাদও। শোভাযাত্রার অনেক উপকরণ প্রতিবাদস্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। একবার মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন প্রায় শেষের দিকে। যে জিনিসগুলো তৈরি হলো তার মধ্যে কোনো প্রতিবাদী উপকরণ নেই। কিন্তু দেশে তখন একাত্তরের ঘাতকদের জয়জয়কার। ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। কলেজে আমাদের যে দল ছিলো অনেকে বাসায় এলো। টানা দুইদিন সবাই মিলে কিছু জিনিস তৈরি করলাম; যেগুলো ফোল্ডিং করা যেত। বাসা থেকে জিনিসগুলো হলে নিয়ে রাখা হলো। তারপর টিএসসির ওখান থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার ভেতরে সেগুলো নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে যেতে পারলে আর সমস্যা নেই। কারণ কে এটা বহন করছে খুঁজে বের করা সময়সাপেক্ষ। আমরা একাত্তরের ঘাতকের মুখোশ ডিজাইন করেছিলাম। সেদিন কিছু সময় চলার পর বুঝতে পেরে মুখোশগুলো শোভাযাত্রা থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে সাংবাদিকরা ছবি তুলে ফেললেন। কিন্তু পত্রিকায় ছাপানো হলো না। পরদিন শুধু ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোটো করে একটা নিউজ হলো। পরের বছর অবশ্য মুখোশগুলোর ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। জামায়াতের বিষয়ে এভাবে প্রতিবাদ করেছি, যে প্রতিবাদ এখনো চলমান। ইতোমধ্যে কিছু ফলও আমরা পেয়েছি। আরেকবার বিরাট একটি ড্রাগন বানানো হলো। সাপটির মুখের ভেতরে একটি মাইক ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। এটা লুকানো ছিল। একজনের কাছে মাইক্রোফোন রেখে তাকে বলেছিলাম এই কথাগুলো বলতে থাকো। এটিও মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহার করেছিলাম। একবার আমরা যারা পুরনো শিক্ষার্থী তারা আর্ট কলেজের শোভাযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হতে পারলাম না। সেই সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে স্বৈরাচার ও মৌলবাদবিরোধী সংস্কৃতিমনা সকলে মিলে দুইবার মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি। শোভাযাত্রা দুটি বাংলার উপকরণসহ বিশাল প্রতিবাদী শোভাযাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। শোভাযাত্রায় মৌলবাদী ও স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদী ও প্রতীকী উপস্থাপনা জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের বড়ো প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
 


মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতীকী উপস্থাপন বহুভাবে করা হয়েছে। যেমন মঙ্গল ঝাটা। একবার বাঁশের একটি বিশাল আকৃতির ঝাটা বানানো হলো, সব ধরনের অন্যায় অবিচার ঝেটিয়ে দূর করার জন্য। আরেকবার করা হলো দানবের নৃত্য। বড়ো আকৃতির একটি দানব। যার অনেকগুলো হাত ছিল। প্রতিটি হাতে এক একটা প্রতীক। যেমন সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, অর্থ, গ্রেনেড, অস্ত্র ইত্যাদির প্রতীকী রূপ; দেশের সব দখল করে নিচ্ছে। আবার প্রবাদ-প্রবচনের কথাও বলা যায়। এগুলো বাংলার সম্পদ, যা যুগযুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই প্রবাদ বা শ্লোক আমরা শোভাযাত্রায় ব্যবহার করেছি। বড়ো কাপড়ের পাখা বানিয়ে তার মধ্যে শ্লোকগুলো লিখেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়েছিল- চোরের মার বড়ো গলা। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কথাটা দারুণ মানিয়েছিল।

মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপকরণ ঢাক-ঢোল। ঢোলের শব্দ বাঙালির হৃদয়ে ও জিনের মধ্যে ঢুকে আছে। এই ঢাক যেন মঙ্গলের ডাক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ড্রাম বা ঢাক-ঢোল বিভিন্ন ধরনের। তার শব্দও আলাদা। কিন্তু ঢোল মানেই নাচ। নাচ মানেই আনন্দের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢোলের শব্দ বাঙালি এড়িয়ে যেতে পারে না। এই শব্দের সঙ্গে বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক। ঢোলের শব্দ পেলে বাঙালি উৎসাহী হয়ে ওঠে। একটা ঘটনা বলি, একবার আমরা শোভাযাত্রা নিয়ে যাচ্ছি। স্বাভাবিকভাবে উল্টো দিকের রাস্তা বন্ধ। মানুষজন, যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে। এক ভদ্রলোক মোটর সাইকেলে বসা, পেছনে তার স্ত্রী। আমরা যখন যাচ্ছি তখন ঢোলের তালে তালে ওই ভদ্রলোক মোটর সাইকেলের ওপরেই নাচতে শুরু করলেন। কিন্তু তার স্ত্রী লজ্জা পাচ্ছিলেন। স্বামী দাঁড়িয়ে শরীর দুলিয়ে নাচতে গেলেই স্ত্রী তাকে টেনে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আরেকবার ব্রাজিলের পুরনো একটি শহর ওরপোতোতে গেলাম। শহরটা পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এক সন্ধ্যায় বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। তখন ড্রাম বাজানোর শব্দ কানে এলো। ভেতরে গ্রাম থেকে শব্দ আসছিল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। গিয়ে দেখি সেখানে সাম্বা নাচের অনুশীলন হচ্ছে। জানতে পারলাম, কয়েকদিন পরে ওদের উৎসব। ড্রামের শব্দে আশপাশের লোকজন আসতে শুরু করেছে। ঢোলের শব্দও ঠিক তাই। এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ওদের নাচ, ড্রাম আর আমাদের নাচ ও ঢোল এক নয়। এখানে পার্থক্য হলো যার যার শেকড় তার তার। শুরুর দিকে শোভাযাত্রা শেষে প্রতিবারই কলেজের সামনে ঢাকের তালে নাচা হতো। সকলেই নাচে অংশগ্রহণ করতো। ওই সময় মনে আছে, অনেকে বলতো এসব করা যাবে না। মৌলবাদীরা সুযোগ পেয়ে যাবে, নানা কিছু বলবে। তারা বলেছে অনেক কিছুই কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। কিছুই করতে পারে নি। ঢাক বাজলে শরীর ও মন দোলা দিবেই।

আমরা যখন পহেলা বৈশাখ শুরু করি তখন নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছিলাম। সেটা রাজনৈতিক, মতাদর্শ বা ধর্মীয়- সব দিক থেকেই চাপ ছিল। মৌলবাদী মানসিকতার যারা ছিলো তারা বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছে। এর প্রতিবাদে আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় বেশ কিছু কাজও করেছি। বিশ্বে বিভিন্ন উৎসবে নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী এই প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরুর দিকে গুলশান থেকে অনেক বিদেশি অংশগ্রহণ করতো। ভালো লাগা থেকেই তারা আসত। কারণ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে তারা অভ্যস্ত। আমাদের কালারফুল এমন নতুন একটি উৎসব দেখে তারাও আগ্রহী হয়ে অংশ নিতো। বৈশাখের উৎসব বাঙালির পুরনো সংস্কৃতি। এরসঙ্গে কৃষিকাজ, গ্রামীণ মেলা, ব্যবসায়ীদের হালখাতার সম্পর্ক রয়েছে। তারসঙ্গে কিছু আচার অনুষ্ঠানও রয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সে অর্থে পুরনো নয়, কিন্তু এটি বৈশাখের উৎসবকে আরো রঙিন করেছে। নিজেদের জিনিস নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছি। এই কাজটি সম্ভব হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে এতে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ কিছুটা অগোছালো বলে মনে হয়। বলছি না অতি গোছানো ভালো। তবে আগে পরে একটা পরিকল্পনা থাকা ভালো। চারুকলার যেসব ছেলেমেয়েরা এখন কাজটি করছে তারা অনেক ছোটো। এখন যেটা হচ্ছে সেটা অনেকটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো। একধাপ এগিয়ে গিয়ে শোভাযাত্রার উপকরণগুলো বানানো যেত। তা হয়নি। যদিও এটা নিয়ে চিন্তিত নই। একসময় পরিবর্তন হবেই। আমি মনে করি, শুধু ছবি আঁকা শিখে ধনিদের বাড়ির ড্রয়িং রুম সাজানোই চারুকলার একমাত্র কাজ নয়। আর্ট কলেজ একটি চেতনার জায়গা, বাঙালির গর্বের জায়গা, একটি ধর্মনিরপেক্ষ আবাস। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব জিনিস ব্যবহার করেছি বা এসবের ধারণা আমাদের লোকভাণ্ডারের। এগুলো আমাদের আগে থেকেই আছে। তার সঙ্গে নতুন কিছু যোগ হচ্ছে। তবে কোনো আইডিয়া ফোকের বাইরে নয়। যেমন আমাদের পাখি আছে। যেকোনো একটা পাখির রূপ যদি একটু ভয়ঙ্কর করে দিই তাহলেই নতুন একটা রূপ নেবে। এগুলোর সঙ্গে আমাদের শেকড়ের একটা সম্পর্ক আছে। শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে পহেলা বৈশাখ এই জায়গায় যেত না।
 

লেখক: চিত্রশিল্পী



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়