ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অলৌকিক || মাসউদ আহমাদ

মাসউদ আহমাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২৮ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অলৌকিক || মাসউদ আহমাদ

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

ধূসর-কালো বিড়ালের মতো মৃদু অন্ধকার ঘরজুড়ে।
বাইরে এপ্রিলের দুপুরের কড়া রোদ। এই রোদে জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বেরোয় কোন বেকুব? সংসারে, নিজেকে সময় দেয়ার চেয়ে আর কোনো জরুরি কাজ হয় নাকি মানুষের? অন্তত সুমন রহমানের কাছে তো নয়ই। 
ভরপেট ভাত খেয়ে সে একটা ঘুম দেয়ার কথা ভাবছে। দুপুরে ঘুমানোর অবকাশ তার সচরাচর হয় না। হঠাৎ হয়। আজ সেই হঠাৎ পাওয়া অবকাশ, একটু আলস্য উদযাপনের।
সুমনদের বাড়ি শহর থেকে বেশ দূরে। নাগরিক কোলাহল নেই, তবে নগরজীবনের সুবিধা ঢের পাওয়া যায়। অবিরাম গাড়ির হর্ন বেজে চলেছে, ক্ষতিকর কালো ধোঁয়ায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, বাথরুমে ঢুকে জলের হাহাকার-এসব সমস্যা সুমনদের এলাকাকে খুব একটা ছুঁতে পারে না। কিন্তু শব্দ যা আছে তা ট্রেনের। দুপুরে ঘুমের আমেজের সঙ্গে ট্রেনের চলে যাওয়ার শব্দটা দারুণ ঘোর তৈরি করে। সেই ঘোরে ঘুম আরো গাঢ় হয়ে নেমে আসে। কী যে মধুময় সেই স্বপ্নকল্পনা। বেশ লাগে সুমন রহমানের।
কিন্তু আজ সুমনের দুপুরে ঘুমানোর ভাবনাই সার হলো। অনেকটা সময় ধরে সাজানো ভাবনার ভেতরে ফুঁ দিয়ে আড়ালে কেউ হয়ত হাসছে। হাসিটা মোটেও সুন্দর নয়, বিদঘুটে। সে অন্তরগত উপলব্ধিতে টের পায়। কারণ এই অলস দুপুরে ডোরবেলটা বেরসিকের মতো ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দে বেজে উঠলো। এটা কোনো কথা হলো!
কে আসতে পারে এই অসময়ে?
ধুর। ডোরবেলটা জরুরিভিত্তিতে বদলাতে হবে। ভাবে সে। বাইরে কেউ সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে ডোরবেলের অদ্ভুত আওয়াজ বের হয়। বাবা খুব কৃপণ। আজকাল বাজারে কত সুরেলা ডোরবেল বেরিয়েছে। সুন্দর শুনতে এমন একটা কিনে আনলেই হয়। তা করবে না। এখন যেটা বাজছে, শুনে মনে হয়- একটা রামছাগলের গলা চেপে ধরেছে কেউ। 
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়ে সুমন। দরজা খুলতেই, একজন মেয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করলো- ভাইয়া, সাদিয়া কি বাসায় আছে?
সুমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জিজ্ঞাসা করে- কোন সাদিয়া?

মেয়েটি চিকন ঠোঁটে মৃদু কাঁপুনি তুলে স্নিগ্ধ চোখে তাকায়। মিষ্টি করে হাসে। হেসে বলে, ভাইয়া, আমি নীতু। সাদিয়ার বন্ধু। কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়ি। আজ সে কলেজে যায়নি।
আচ্ছা।
ও কি বাসায় আছে?
হ্যাঁ। আপনি আসুন।
ভাত খেয়ে ঘুম দেয়ার অবকাশে বিছানায় শুয়ে যে কথাটি ভাবতে ভাবতে সুমনের তন্দ্রার মতো এসেছিল-ধূসর বিড়ালের মতো মৃদু অন্ধকার ঘরজুড়ে-ডোরবেলের শব্দে সেই অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে।
নীতুকে চেয়ারে বসতে দিয়ে সুমন আড়মোড়া ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে ভাবে- আহা! ঘুমটা তাহলে গেল।
নীতু চেয়ারে বসে এদিক-ওদিক তাকায়।

সুমন জানালার কাছে যায়। হাট করে জানালার কপাট খুলে দেয়। বাইরে তখন চৈত্রের কড়া রোদ হাসছে। ফাল্গুনের রাতের আঁধারে বড় একা লাগে, কিন্তু এপ্রিলের দুপুরে? কথাটা মনে হতেই সুমন ফিক করে হেসে দেয়।
নীতু বলল, ভাইয়া, আপনি হাসছেন কেন?
না। ও কিছু না।
না-মনটা বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে ইদানিং। মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ছে। নিজেই নিজেকে বলে সে।
চা খাবেন? বলেই সুমন মেয়েটির দিকে তাকায়।
প্রথমে সে খেয়াল করেনি, মেয়েটি দেখতে কালো। কিন্তু মুখটা ভারি সুন্দর। লাবণ্যময়। তার চোখ হাসে। চোখ হাসা মেয়েরা ভারি দুষ্টু হয়। নীতুকে অবশ্য দুষ্টু মেয়ের মতো মনে হচ্ছে না। 
নীতু খানিকটা দ্বিধা মেশানো গলায় বলে, ভাইয়া, সাদিয়া আমার বন্ধু ঠিকই, কিন্তু সত্যি বলতে আমি এসেছি ওর বড়ভাই সুমন রহমানকে দেখতে।
সুমন সরু চোখে তাকায়। বলে, সুমন রহমান?
জি। তিনি লেখক। গল্প, উপন্যাস লেখেন। তার লেখা আমার খুব পছন্দ! একবার বইমেলায় আমি তার অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম।

ভেতরে সুমনের খুব খুশি খুশি লাগে। এমন মিষ্টি মেয়ে আমার লেখার ভক্তপাঠিকা-ভেবে সে পুলকিত হয়। আর কী আশ্চর্য, লেখকের সন্ধানে ঠিকানা খুঁজে সে বাড়িতে এসেছে। কিন্তু খুশির ভাবটা নীতুকে সে বুঝতে দেয় না। জীবনে কত অনুরাগী পাঠককে সুমন অটোগ্রাফ দিয়েছে, আলাদা করে সবাইকে মনেও নেই। নীতুকেও এখন ঠিক মনে করতে পারে না সে। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা সে দেখছে না। কখনো কখনো সুযোগ পেয়েও নিজেকে উন্মোচন না করার একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দের বিভা এত সহজে আলগা করা ঠিক হবে না। ভাবে সুমন রহমান।

নীতু বলে, গতরাতে সাদিয়ার ভাইটা মারা গেছে।
সাদিয়ার ভাই?
জি।
কী বলছেন?
মানে সুমন রহমান।
সুমন রহমান আড় চোখে নীতুর মুখে তাকায়- ওর চোখ ভিজে উঠেছে। নীতুর ফর্সা নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। সে খানিক বিব্রত ও বিপন্ন বোধ করে।
কী বলছে নীতু? সুমন বিস্মিত ও অসহায় মুখে নীতুকে দেখতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর; মেয়েটা দুঃখী চেহারা নিয়ে সুমন রহমানকে দেখে। সে কথা বলতে সময় নেয়। আবেগে হয়ত তার কথা থেমে গেছে। সে ভেতরে ভেতরে কথা সাজায়। কথা আটকে থাকে। কথা মুখ বাড়ায়। একসময় কথাগুলো ভাষা পায়। নীতু বলে, জানেন ভাইয়া, সাইলেন্টলি আই অ্যাম ইন লাভ উইথ হিম...
সুমন রহমান লাজুক ভঙিতে হাসে। তার মাথাটা নুয়ে আসে বুকের কাছে। ভাগ্যবতী মেয়েদের মতো সুমনের নাক ঘামতে থাকে-সে টের পায়।
কোনো সুন্দরী তরুণী এত কাছে এসে যদি একজন অবিবাহিত তরুণ লেখককে তার অনুরাগ এমনকি গোপন প্রেমের কথা বলে, লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকে না। সুমনেরও লজ্জা লাগে। লজ্জা এবং মুগ্ধতা-মেশানো-হাসি ছড়িয়ে পড়ে ওর  চোখেমুখে। এই ব্যাপারটা তার জীবনে কমই এসেছে।
কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সুমন রহমানর। কারণ নীতু এখন আর হাসছে না। তার ঠোঁট ভারি। চোখ ভেজা এবং নিচের ঠোঁট কাঁপছে। কথা বলার সময় নীতুর গলাটাও ভিজে আসছে।
সুমন রহমান প্রাণপণ নীতুকে বোঝানোর চেষ্টা করে, নীতু, আমিই সুমন রহমান...
কিন্তু সে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ করে না।
এমনকি সুমন রহমানের কোনো কথা সে শুনতেও পায় না। কী আশ্চর্য! 
ভাইয়া, সাদিয়া কী করছে? একটু ডাকুন না, প্লিজ। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। নীতু বলে।
সুমন রহমান টের পায়, কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তার একটা ছোটবোন আছে বটে, কিন্তু ওর নাম তো সাদিয়া নয়। তার নাম কুমকুম রহমান। কিন্তু সাদিয়াটা কে? কে সাদিয়া?
নীতু কি ভুল ঠিকানায় এসে ডোরবেল বাজিয়েছে? তাই সবকিছু এমন গড়বড় হয়েছে? দিনেদুপুরে ভাতঘুমের সময় মানুষের এমন সরল ভুলও কি হয়? হতে পারে? জানা নেই সুমন রহমানের।
কিন্তু সে-কথা নীতুকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না।

সদ্য তৈরি হওয়া কাঁচা ঘুম আলগা হয়ে গেলে যেমন অস্বস্তি পেয়ে বসে, নীতুকে সেই অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না সুমন রহমান।
ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুমন মিষ্টি করে তাকায়। বলে, সাদিয়া স্নানে ঢুকেছে। একটু দেরি হতে পারে... আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমি বরং আপনাকে এক কাপ চা করে দেই।
কথাগুলো বলতে বলতেই বাইরে মানুষের ভিড় ও মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায় সুমন রহমান।
সে দরজা খুলে দেয়। দেখে, বাড়ির সামনে মানুষের জটলা।
এ কীসের ভিড়?
একজন বলল, এত ভালো ছেলে। গতরাতে মারা গেছে।
সুমন রহমান এবার সত্যিই আকাশ থেকে পড়ে-এই বাড়িতে কে মারা গেছে? এখানে কেউ মারা গেছে, অথচ সে জানতে পারল না! এমনও হতে পারে?
প্রতিবেশী এক বয়স্কা মহিলা রিকসায় যাচ্ছিলেন। ভিড় দেখে তিনি রিকসা থামালেন। একজনকে ডেকে শুধালেন, এখানে কী হয়েছে?
সুমন রহমান গত রাতে মারা গেছে।
তিনি বললেন, কোন সুমন রহমান? ডাক্তার?
না, ওই যে তরুণ ছেলেটা, গল্প লিখতো।
চশমা ছাড়া সুমন রহমান ভালো মতো কিছুই দেখে না। তবুও লম্বা পা ফেলে সে মোড়ের দোকানে যায়। পত্রিকার দোকানে গিয়ে একটা পাঠকপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা কেনে। পত্রিকার ভেতরের পাতায়, সাদাকালো সিঙ্গেল কলামের ভেতরে খুঁজে পায় নিজেকে। তার মৃত্যুর খবর এবং সঙ্গে তারই ছবি ছাপা হয়েছে।
একদমই বিশ্বাস হয় না সুমন রহমানের। জলজ্যান্ত বেঁচে আছে সে। অথচ পত্রিকায় এ কী অদ্ভুত খবর! আশ্চর্য তো!
পত্রিকা হাতে সুমন রহমান বাড়ির সামনে আসে। দেখে, মানুষের জটলা এতটুকু কমেনি। বেড়েছে। সে প্রবলভাবে চিৎকার করে-দেখুন, আমিই সুমন রহমান। আমি বেঁচে আছি। এই যে আমি। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করুন, প্লিজ...
কিন্তু সুমন রহমানের কথা কেউ শুনতে পায় না।
হঠাৎ ভিড়ের ফিসফিসানি ও কানাঘুষা তার কানে আসে-আহা ছেলেটা বড় ভালো ছিল।
সুমন দড়াম করে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢোকে।
সে ঘরময় তাকায়। জানালা খোলা। ৩২ পাওয়ারের এনার্জি বাল্বটি দিব্বি জলছে। কিন্তু নীতু কোথায়?
সে ভেতরের ঘরে যায়। বারান্দায় যায়। বাথরুমে নক করে। না, নীতু নেই। কোথাও দেখতে পায় না তাকে। যেন এখানে কখনো ছিলও না সে।
এরপর সুমন কী ভেবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। না, বাইরেও কেউ নেই।
এতক্ষণ যে মানুষের জটলা ও হট্টগোল ছিল, কানাকানি ও ফিসফিসানি-কিছুই নেই। সবই কি তাহলে বিভ্রম?
কোথাও কি কোনো ভুল ছিল?
 

তখন, আড়চোখে সে খেয়াল করে, বাইরে জানালার ওপাশে নিঃশব্দে একটা কাঁঠাল পাতা ঝরে পড়ছে...

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়