ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কিছু বিষয়ে কথা বললে নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে : কচি

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৮ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কিছু বিষয়ে কথা বললে নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে : কচি

কচি খন্দকার

আমিনুল ইসলাম শান্ত : গুণী অভিনেতা-নির্মাতা কচি খন্দকার। কৈশোর বয়সেই শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই পথচলা এখনো বিদ্যমান। অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রায় ছয় শ নাটকে অভিনয় করেছেন। ‘কেরাম’ ও ‘কবি’-এর মতো জনপ্রিয় টিভি নাটকের রচয়িতাও তিনি। তবে নীরিক্ষাধর্মী নাটক নির্মাণে বেশি আগ্রহী কচি খন্দকার।

সম্প্রতি টেলিভিশ নাটকের বিভিন্ন বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন এই অভিনেতা। এ আলাপচারিতার বিশেষ অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

রাইজিংবিডি : নব্বই দশকের টিভি নাটক নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
কচি খন্দকার :
নব্বই দশকে হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস লেখার পাশাপাশি গান ও নাটকও রচনা করলেন। সর্বশেষ নাটক পরিচালনা শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদের টিভি নাটক তখন ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। হুমায়ূন আহমেদ যে শক্তির মাধ্যমে মানুষকে টিভি নাটকের প্রতি আগ্রহী করে তুললেন তা ছিল তার গল্প ও লেখনি। গল্পই প্রধান। সেক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বড় একটি ভূমিকা রাখেন। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের মতো করে এ কাজগুলো করেন।

হুমায়ূন আহমেদের পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নতুন একটি ধারা তৈরি করেন। এই ধারাটিকে ক্যাজুয়াল বলা যায়। যা অনেক বেশি সহজবোধ্য ছিল। অনেকটা অভিনয় না করেও অভিনয় করে যাওয়া। অর্থাৎ খুব সাধারণভাবে অভিনয় করা। এই ধারাটি বিস্তৃত মানুষকে টেলিভিশনের মধ্যে নিয়ে আসে। নব্বই দশকে এটি একটি বিপ্লব। ক্যাজুয়াল অভিনেতা, ক্যাজুয়াল সংলাপের মাধ্যমে আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা এই ক্যাজুয়াল নাটকে বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। নাটক মানে এরকম হতে পারে দর্শক সেটা বিশ্বাস করল এবং এ নাটকগুলো সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। 

নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বৃন্দাবন দা নতুন আরেকটি ধারায় নাটক নির্মাণ শুরু করলেন। তার নাটকে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল উঠে আসতে লাগল। ফারুকী বা আমরা শহুরে কিংবা মফস্বলের বিষয় নিয়ে নাটক নির্মাণ করলাম। আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। কিন্তু দেশের তৃণমূল পর্যায়ে যাইনি। বৃন্দাবন দা তার নাটকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের খুব সাধারণ মানুষের জীবনযাপন তুলে আনলেন। লাভলু ভাইও তখন তৃণমূলে চলে গেলেন। নতুন একটি রূপ দিলেন। এই নাটকের ধারাটা আরেকটু মাখামাখি হলো। এ ধারাকে ঠিক কমেডি বলব না, বলা যায় কৌতুক। মানে অতিমাত্রায় ভাঁড়ামি বা ‘খচ্চরিপনা’ শুরু হলো। এটা এখনো চলছে। আমি বলছি না এটা বৃন্দাবন দা করেছেন। বরং ওনাদের কাছ থেকে নিয়ে অন্যরা এই ধারা তৈরি করেছেন। বৃন্দাবন দাস তার লেখনির শক্তি দিয়ে নিজস্ব দর্শক তৈরি করেছেন। আমার জায়গায় থেকে তাকে আমি সম্মান করি। আমি মনে করি, তিনি বাংলা নাটকে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

রাইজিংবিডি : নব্বই দশকে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী নির্মিত নাটকের ভাষাগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল-
কচি খন্দকার :
হ্যাঁ, এসব নাটকে কিছু ভাষাগত সমস্যা ছিল। আসলে কোনো পরীক্ষা চালাতে গেলে কিংবা গবেষণা করতে গেলে তার মধ্যে সবকিছু পরিশুদ্ধ থাকবে তা কিন্তু হয় না। একজন ব্যক্তি একটি জাতির ভাষাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ভাষা জনপদ গ্রহণ করবে কিংবা করবে না সেটা তার ব্যাপার। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ ওই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলবে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের লোক কুষ্টিয়া অঞ্চলের মতো করেই কথা বলবে। এটা হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে। আবার পরিবর্তনও হবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু ধ্বংস হবে সেটা হয় না। ধরুণ, ‘মা’ শব্দটির কথা। এই ‘মা’ শব্দের পরিবর্তে ‘আম্মু’, ‘আম্মা’ এসেছে। হয়তো আরো নতুন কোনো শব্দ আসবে। কিন্তু ‘মা’ শব্দটিকে কেউ ধ্বংস করে দিতে পারবে না। এই ‘মা’ শব্দটি থেকেই যাবে। ফারুকী ভাষাটা শেষ করেছে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। শুধু সে কেন পৃথিবীর সব মানুষ চেষ্টা করলেও তা পারবে না। কারণ টাঙ্গাইলের কোনো লোককে যদি বলা হয় আপনি আপনার অঞ্চলের মতো করে কথা বলবেন না, ওই অঞ্চলের মানুষ কি এটা শোনবে?  

রাইজিংবিডি : শূন্য দশক থেকে বর্তমান সময়ের নাটক নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
কচি খন্দকার :
বর্তমান সময়ে আমরা যে নাটক নির্মাণ করতে যাচ্ছি তার চেয়ে আমরা বোঝাপড়াটা বেশি করতে যাচ্ছি। কি কি বিষয়ের উপর নাটক নির্মিত হলে চ্যানেল কিনবে তার একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। কিছু কমেডি বা ভাঁড়ামি নাটক বানালে টেলিভিশন কিনবে। কারণ এখানে দর্শক অর্থাৎ টিআরপি যুক্ত। যত বেশি ভাঁড়ামি তত বেশি টিআরপি। যত বেশি অনাটক তত বেশি নাটকের পর্যায়ে উঠে আসছে। কিছু পরিচালক আছে যাদের সঙ্গে সাহিত্যের দূরত্ব হাজার হাজার মাইলের। কিন্তু তারাই পরিচালনা করছে এবং মর্যাদার সঙ্গে করছে। তাদের গাড়ি-বাড়ি করে দেয়া হয়েছে। এখানেই নীতি নির্ধারকদের একটা পাপ আছে। টেলিভিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, কাজটি কাকে দিলে সঠিকভাবে শেষ হবে তাকে দেয়া।

রাইজিংবিডি : তবে কী ভালো নাটক নির্মিত হচ্ছে না?
কচি খন্দকার :
ভালো নাটক নির্মিত হচ্ছে না, এটা বললে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হবে। এর মধ্যেও অবশ্যই ভালো নাটক নির্মিত হচ্ছে। তবে ভালো কাজের জন্য মানুষের যে মানসিকতা সেটা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে আছে। যারা ভালো চিন্তা করছে কিন্তু তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে না। এই মেধাবী ছেলে-মেয়েদের সুযোগ দেয়া উচিৎ।

রাইজিংবিডি : নব্বই দশকের চেয়ে বর্তমান সময়ে টিভি নাটকের মান কী খারাপ হয়েছে?
কচি খন্দকার :
হ্যাঁ, খারাপ হয়েছে। কারণ টিআরপি। যে নাটকটি টিআরপির এক নম্বরে রয়েছে সে নাটকটি দেখলেই বোঝা যায় নাটকের কতটা অধঃপতন হয়েছে। আসলে টিআরপির বিচার কে করছে সেটা আমরা জানি না। কিন্তু টিআরপির এক নম্বরে থাকা নাটকটি যখন এই নাগরিক সমাজ বিচার করবে তখন ওই নাটকটি কোনো নম্বর পাবে না, এটা আমি কনফার্ম। এক্ষেত্রে টেলিভিশন চ্যানেলের নীতি নির্ধারকদের কথা বলব। যারা প্রিভিউ কমিটিতে রয়েছেন তারাই প্রধান। নাটকের মান কমে যাচ্ছে, মান বাড়াতে হবে এ দায়িত্ব তাদের। এটার সমাধান তারাই করতে পারেন। মেধাবী লোক তারাই যুক্ত করতে পারেন। সুন্দর কাজের ক্ষেত্র তারাই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে গলদ আছে। ওখানে বোঝাপড়া আছে। ওখানে সিন্ডিকেট আছে। ওখানে অনেকগুলো ব্যাপার আছে। যেগুলো নিয়ে কথা বললে আমার নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা আন্দোলনও করেছি কিন্তু সফল হতে পারিনি। কারণ সংগঠন অনেক কঠিন জায়গা। এখানে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিও ঢুকে গেছে। যারা শিল্পী নন তারাও সংগঠনের সদস্য। আসলে এমন দৃশ্য যখন দেখি তখন সংগঠন করাটা অযৌক্তিক মনে হয়।

রাইজিংবিডি : বর্তমান সময়ে প্রচুর নাটক নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু ‘অয়োময়’, ‘রূপনগর’, নাটকের মতো কটা নাটক মানুষের মনে গেঁথে থাকে বলে আপনি মনে করেন?
কচি খন্দকার :
এ বিষয়টি আমি ভিন্নভাবে বলব। ‘অয়োময়’ বা ‘কোথাও কেউ নেই’ কিংবা ‘রূপনগর’ নাটক যখন প্রচারিত হয়েছে তখন একটি টিভি চ্যানেল ছিল। তখন আমার পুরো মনোযোগ ওই দিকে ছিল। এতটা মনোযোগ দিয়ে তখন যাই দেখতাম তাই ভালো লাগত। কারণ আমার ভালো লাগার আর কোনো অপশন ছিল না। এটা হলো প্রধান কারণ। বলছি না, ওই নাটকগুলোর মান খারাপ। কিন্তু এই সময়ে নির্মিত ‘সিনেমা হল’ নাটকটি ততটা মনোযোগ দিয়ে দেখছি না। তা ছাড়া আমাদের মনোজগতেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা অনেকটা অস্থির হয়ে গেছি। অনেক টিভি চ্যানেল হয়েছে, নানা দিকে মনসংযোগ চলে গেছে। এ ছাড়া একটি ভালো নাটক নির্মাণের জন্য যে বাজেট দরকার সেখানে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

রাইজিংবিডি : মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, চঞ্চল, নিশোর মতো কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে দর্শক ও নির্মাতারা আটকে আছেন। এটা কেন?
কচি খন্দকার :
আমি মনে করি, বাংলাদেশে মোশাররফ করিম ও জাহিদ হাসান এই দুই শিল্পী সমস্ত চরিত্রে অভিনয় করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এরা চরিত্রাভিনেতা। যে কোনো চরিত্র তারা প্লে করতে পারেন। এই যোগ্যতাটা অন্য আর্টিস্টদের মধ্যে খুব একটা নাই। এ জন্য নির্মাতারা কোনো চরিত্র নিয়ে ভাবতে গেলে চিন্তা করেন এই যোগ্যতা কার আছে। এই ক্ষেত্রে আমি এক নম্বরে রাখব মোশাররফ করিমকে। এই যোগ্যতার কারণে আমরা মোশাররফের উপর নির্ভর করছি। কিন্তু ইদানিং যারা আসছে তারা কোনো কোনো চরিত্রের জন্য ঠিক আছেন, সব চরিত্রের জন্য পারফেক্ট হয়ে উঠেননি।

রাইজিংবিডি : তবে কী নতুন করে শিল্পী তৈরি হচ্ছে না?
কচি খন্দকার :
এই যে নতুনরা তৈরি হয়নি কিংবা হচ্ছে না- এর জন্য টেলিভিশন চ্যানেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাতা মোশাররফ, চঞ্চল কিংবা জাহিদকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো আর্টিস্টকে নির্বাচন করল কিন্তু টেলিভিশন এটা নিয়ে আপত্তি করে। কারণ তারা ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আমাদের বিজ্ঞাপনদাতা থেকে শুরু করে কেউ-ই নতুন ছেলেকে চান না। তখন একজন পরিচালক কীভাবে নতুন ছেলেটিকে বেছে নিবেন? তবে দুই একটা ঝুঁকি যে নেয় না তা কিন্তু নয়। তা ছাড়া দর্শকও নতুন কাউকে গ্রহণ করতে চায় না। কারণ তার মাইন্ড সেটআপ মোশাররফকে ঘিরে। এই সমস্যার জন্য প্রথমত টেলিভিশন দায়ী। তারপর নির্মাতা। সর্বশেষ দর্শক। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা টিভি চ্যানেলকে বেশি নিতে হবে। নতুনদেরকে একাধিকবার কাজের সুযোগ দিতে হবে। তবেই এর সমাধান।     

রাইজিংবিডি : বাজেট, গল্প, অভিনেতা, নির্মাতা কোনটি বর্তমান সময়ে ভালো নাটক নির্মাণে প্রধান অন্তরায়?
কচি খন্দকার :
এক নম্বর গল্প। দ্বিতীয় বাজেট। ভালো গল্প নিয়ে ভালো নির্মাণ চাইলে অবশ্যই ভালো বাজেট লাগবে।

 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৮/শান্ত/ফিরোজ                            

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়