ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কুত্তা গাড়ি

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৮ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুত্তা গাড়ি

পাবনায় এই গাড়ি কুত্তা গাড়ি নামেই পরিচিত (ছবি : রাইজিংবিডি)

তাপস রায় : গ্রামগঞ্জের স্যালো মেশিনের সঙ্গে আলুর যথেষ্ট মিল রয়েছে! ভাবছেন, মিলটা কোথায়? একটি যন্ত্র অন্যটি খাদ্য; তাও আবার এমন একটি খাদ্য যাকে প্রায় ভাতের বিকল্প হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বাঙালির ভাত ছাড়া কি চলে? চলে না। সুতরাং আলু এ যাত্রা রক্ষা পেলেও স্যালো মেশিনগুলোর বাঙালি উদ্ভাবকের হাত থেকে নিস্তার নেই। অল্প বিদ্যা যে সব সময় ভয়ঙ্করী নয়, এর প্রমাণ রাখতে তারা ওই স্যালো মেশিনকেই বেছে নিয়েছেন এবং জগতের বাঘা বাঘা প্রকৌশলীর মুখে ঝামা ঘষে দিব্যি প্রলয়ঙ্করী আবিষ্কার করে চলেছেন। 

একবার ভাবুন তো, নসিমন, করিমন বা ভটভটির কথা। শহর হতে দুই পা ফেলিয়া পাতি শহরগুলোতে চোখ ফেলতেই এই গাড়িগুলো দেদার চোখে পড়ে এবং চোখ পোড়ায়। সে জন্য তাকে ঠিক দায়ী করা চলে না, দায়ী ওর কালো ধোঁয়া। কর্তৃপক্ষের অবশ্য এ ব্যাপারে যথেষ্ট হুঁশিয়ারি আছে, কিন্তু হুঁশ রাখছে কে? মহাসড়কে গাড়িগুলো নিষিদ্ধ। তারপরও মহাসমারোহে তারা পাল্লা দিয়ে ছুটছে সড়কের অন্য যানগুলোর সঙ্গে। ফলে মাঝেমধ্যে জানের হানি ঘটছে কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় ওটা নয়। আমরা শুধু বলতে চাই, সড়কে অনাহুত এই গাড়িগুলোর প্রাণ ভোমরা ওই স্যালো মেশিন।

আনন্দ অথবা আতঙ্কের বিষয় এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ‘কুত্তা গাড়ি’। পাঠক, আপনি ঠিকই পড়েছেন, স্যালো মেশিন মূল যন্ত্র ধরে শুধুমাত্র লোহার বডি, বাস বা ট্রাকের গিয়ার বক্স, চাকা এবং স্টিয়ারিং দিয়ে দিব্যি মিনি ট্রাক তৈরি করে রাস্তায় চালাচ্ছেন অনেকে। তৈরি খরচ কম, সে তুলনায় ৩ টনি ট্রাকের প্রায় সমান ওজন বহন করা যায়, এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা গ্রামের ভাঙা, উঁচু-নিচু রাস্তায় মালামাল নিয়ে যেখানে কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারে না, সেখানেও এই কুত্তা গাড়ি দিব্যি গড়গড়িয়ে চলে। ছোটখাটো এই ট্রাকগুলোকে যে কারণে শুরুতে বলা হতো ‘কুতুব গাড়ি’। লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে শেষ পর্যন্ত এর নাম দাঁড়ায় কুত্তা গাড়ি।

পাবনা নগরবাড়ি মহাসড়কে মোটর সাইকেলে ফিরছিলাম। বাঘাবাড়িতে পরপর কয়েকটি এমন অদ্ভুত দর্শন গাড়ি চোখে পড়ল। সামনের চাকা দুটো খরগোশের কানের মতো দূর থেকে আগে চোখে পড়ে। প্রথম দেখায় মনে হয় হা করে গিলতে আসছে কোনো জান্তব মুখ। বনেটের জায়গাটিতে স্যালো মেশিন বসানো। তার উপরে চৌকোণা কাচ। ওপারে বসে ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন ভট ভট ভট ভট শব্দে। আমি সশব্দে বার কয়েক তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা কললাম। লাভ হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে পিছু নিলাম। পাশাপাশি আসতেই হাতের ইশারায় থামতে বললাম। এবার কাজ হলো। গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন ড্রাইভার সবুজ মিয়া। মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন পুলিশ সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা নয় তখন ঝামা ঘষা চেহারায় যেন লাবণ্য ফিরে এলো।  

কথা হলো তার সঙ্গে। মাত্র এক লাখ টাকায় তিনি কুত্তা গাড়ি তৈরি করেছেন। আগে নসিমন চালাতেন। কিন্তু মহাসড়কে নসিমন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার কাছ থেকেই জানা গেল পাবনা এবং এর আশপাশের এলাকাগুলোতে এ ধরনের প্রায় শ তিনেক  গাড়ি রয়েছে। তিনি পার্শ্ববর্তী জেলা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর যাচ্ছিলেন ইট পৌঁছে দিতে। বললেন, ‘অনেক রাস্তায় ট্রাক যেইখানে ফেল, কুত্তা গাড়ি সেইখানে একদমে চইল্যা যায়। টান আছে, মালও টানতে পারে সেই রকম!’

কোথা থেকে তৈরি করেছেন প্রশ্ন করতেই জানালেন, গাড়ির গ্যারেজের মেকাররাই এসব তৈরি করে। লাইসেন্সের বালাই নেই। পুলিশও তেমন ঝামেলা করে না। কারণ তারা তো নসিমন, করিমন ঠেকাতেই ব্যস্ত। কিন্তু তারা জানেন না, ওই এলাকার সংশ্লিষ্টরা নসিমন রেখে ঝুঁকছেন কুত্তা গাড়ির দিকে। সবুজ গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার আগে জানিয়ে গেল সেকথা। কিন্তু আমার জানা হলো না, কুত্তা গাড়ির হর্ন কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে কিনা!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৭/তারা/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়