ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বৈশাখীদের বন্ধুত্ব

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৮ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখীদের বন্ধুত্ব

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর : সন্ধ্যার আবছা আলোয় একটা রাজবর্গীয় পাগড়ি পরে যখন মেয়েটাকে আমাদের দিকে আসতে দেখেছিলাম, তখন আমিও আমার পাশের বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলেছিলাম, ‘মেয়েটা কি আমার দিকেই আসছে?’

কিন্তু সে কাছে আসতেই যখন চেহারাটা পরিষ্কার হলো, তখন আমাদের তিনজনেরই চিন্তা, কীভাবে তার থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা যায়! অথচ মেয়েটা আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো হলে অবশ্যই আমরা তা ভাবতাম না, যা ভেবেছি বৈশাখী ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ বলে।

ভারি মেকআপ, রঙ-বেরঙের পোশাক, শালীনতার অভাব আর কেমন যেন মুখভঙ্গি! পারফিউমের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। হতে পারে বাসে কিংবা রিকশায় আপনাকে জেঁকে ধরল, ভাইয়া সাহায্য করেন। সাহায্য না করলে নোংরা কথা শুনতে হতে পারে, মান-সম্মানের ব্যাপার। তাই যে যেমন পারে, কিছু সাহায্য দিয়ে বিদায় করে ওদের। ওই টুকুই ওদের জীবনযাপনের একমাত্র সম্বল। মাঝে মাঝে কোনো বাড়িতে শিশু জন্মগ্রহণ করলে সখানে নাচ-গান করে কিছু উপার্জন করে ওরা। ভাত, কাপড়ের কোনো নিশ্চয়তা না থাকাই প্রায় সব সময়ই তাদের থাকতে হয় অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে। সুস্থ মানুষের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য নেই ওদের। তবুও সমাজে এরা চরমভাবে অবহেলিত। সুধী সমাজ দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়। মানুষ হয়েও যেন মানুষ না।

আর এই মানুষগুলোর সঙ্গে মিশতে বা তাদের সংস্পর্শে আসতেই আমাদের সাধারণ মানুষের যত ভয়, যত অনাগ্রহ। অথচ তাদেরও আছে একটি আবেগময় সুন্দর জীবন, মন ও বন্ধুত্বের আগ্রহ। তবে তা সাধারণ মানুষের পরিবর্তে শুধু তাদের গোত্রের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত।

হিজড়াদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই আমাদের যত লজ্জা। এই ব্যাপারে রাইজিংবিডিকে বৈশাখী বলে, ‘ইচ্ছে তো করে! কিন্তু আমাদের সাথে কেউ কখনো রিকশায় ঘুরবে না। আবার কেউ ঘুরলেও সমাজের মানুষ বা তার অন্যান্য বন্ধুরা তাকে অন্য চোখে দেখবে। তাই আমি বা আমরাও আর সেভাবে কাউকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না। তবে ইচ্ছে থাকে একটা ভালো বন্ধু থাকার।’

এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কেন তাদের বনবাসে রাখি আমরা? দুমুঠো ভাত, কাপড়ের কোনো নিশ্চয়তা এদের নেই। সে কারণেই এরা বিপথগামী। ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজির মতো নিকৃষ্ট কাজ করছে তারা। সব ধরনের নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও একটি গ্লানিময় জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জুবাইদা খানমের সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সহচার্য পায় না বলেই এরা আসলে একটু অন্য রকম। একটু ছন্নছাড়া প্রকৃতির। তবে বন্ধু হিসেবে সাধারণ মানুষের সহচার্য পেলে তারাও আমাদের মতো সাধারণ আচরণ করতে পারে। ওদের লোভ, চাওয়া-পাওয়া খুব সীমিত। তবে তাদের উন্নয়নে কেন পিছিয়ে থাকব আমরা! ওদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে শুধু প্রয়োজন একটু সহানুভূতি আর ভালোবাসা। তাহলেই বদলে যেতে পারে ওদের জীবন। ওরাও তো আমাদের মতোই একজন মানুষ।’

‘আমিই সারা দিন না খেয়ে আছি, আপনাকে কী দেব?’ কথাটার পর নিশ্চয়ই সাহায্যপ্রার্থী বিপরীত মানুষটার থেকে কোনো উত্তর আশা না করে তার প্রস্থানটাই আমাদের কাছে মুখ্য হয়। কিন্তু বিষয়টির রেশ কাটিয়ে যখন ওপাশ থেকে উত্তর আসে, ‘সে কি বলিস ভাই! এই নে, টাকা ধর; ক্ষুধায় কষ্ট করিস না, কিছু খেয়ে আয়।’ তখন আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ছাড়া আমাদের মুখে আর কিছু আসে না। অন্তত আমার তো আসেনি! তার সেই ‘আমার একটা আলাদা পরিচয় আছে বলে আমি ভিক্ষা করতে পারব, তোরা তো তা পারবি না। পেটে পাথর বেঁধে মরে গেলেও লজ্জায় মুখ খুলবি না।’ কথাটার মধ্যে যে কতটা মহত্ব রয়েছে, তার তুলনা হয় না। অথচ এই মানুষগুলোই সময়ের প্রত্যেকটা স্তরে লজ্জার সঙ্গে নির্লজ্জতায় ঘর করছে, তা আগে একটিবারের জন্যও ভাবা হয়নি। এক্ষেত্রে সে বা তারা যখন আমাদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ, তখন আমরা কেন তাদের জন্য বন্ধু হব না!

তাকে প্রত্যাশা করেও যে তার থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছি, ভাবিনি এর মধ্যে তার জন্য কতটা লজ্জা লুকিয়ে আছে! তাই তো বলতে চাই, হিজড়ারা তো আমাদেরই একজন। আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন। এদের দেখে মুখ ফিরিয়ে না থেকে, আসুন ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিই। ছোট্ট একটু উপকারের মধ্য দিয়ে হলেও আমাদের উচিত তাদের মুক্ত করা ওই গ্লানিময় লজ্জার জীবন থেকে।

আমি বৈশাখীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে রিকশায় ঘুরেছি। তার সঙ্গে খেয়েছি। রাতে ঘুরেছি দুজন শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে। আর তাতে যা অনুভব করেছি, তা হলো তার একজন বন্ধু দরকার। সেটা আমি হোক বা অন্য কেউ। তবেই তো তাদের জীবনবোধ সম্পর্কে আমরা জানতে পারব। তাদের করে তুলতে পারো আরো গৌরবময়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ আগস্ট ২০১৭/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়