ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

এক দিনের প্রধানমন্ত্রী

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ২১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক দিনের প্রধানমন্ত্রী

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: ‘প্রথম যখন মাননীয় স্পিকার বক্তব্য দেয়ার জন্য আমার নাম ঘোষণা করলেন তখন এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল। তারপর কেমন যেন চরিত্রে ঢুকে গেলাম। এক দিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মূল যে বিষয়টি গর্বের সেটা হলো, যখন আপনাকে সম্বোধন করার আগে কেউ ‘মাননীয়’ শব্দটি ব্যবহার করবে। দূর থেকে দেখে আমরা ভাবি, সংসদে কথা বলা কতো সহজ! কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন আমি দাঁড়াচ্ছি, আমাকে ঠিক সেভাবেই কথা বলতে হয়েছে যেভাবে একটা দেশের কর্ণধার কথা বলেন।’ কথাগুলো বলছিলেন ইয়ুথ এগেইনস্ট হাঙ্গার আয়োজিত ৩য় যুব ছায়া সংসদের প্রধানমন্ত্রী শেখ কান্তা রেজা।

শুধু এক দিনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে নয় বরং কান্তা রেজার এগিয়ে চলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, সমাজ সচেতনতা, নেতৃত্বগুণ, সাংগঠনিক দক্ষতা বর্তমান শতাব্দীতে নারী সমাজের শেকল ভাঙার যে বিপ্লব চলছে, সে বিপ্লবে তিনি যেন আরেক অগ্নিকন্যা। শেখ কান্তা রেজা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই অন্যায় দেখলে তার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। তার জন্য প্রচুর নিন্দা কথা শুনতে হতো- ‘অমুক মেয়েটা বড্ড বেফাঁস কথা বলে’, ‘মেয়েদের অত সবখানে কথা বলতে নেই’, কিংবা ‘ছেলেদের মতো হতে চাইলেও তো আর ছেলে হওয়া যায় না’ এমন বহু কথা শুনতে হয়েছে।’

কান্তা রেজা বলেন, ‘আমাদের কলারোয়া গার্লস স্কুলে প্রথম সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার সাইকেল চালানো দেখে লোকজন খুব হাসাহাসি করতো। কিন্তু এখন প্রায় প্রত্যেক ক্লাসের বহু মেয়ে সাইকেলে যাতায়াত করে, আমার গর্ব হয়।’

শেখ কান্তা রেজার জন্ম সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার তুলসি ডাঙ্গা গ্রামে। বাবা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ হাসান রেজা ও মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তহমিনা পারভীন। দুই বোনের মাঝে কান্তা বড়। পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহের মাঝে কান্তার বড় হয়ে ওঠা। মা গান করেন, বাবা অনুষ্ঠান-উপস্থাপক। বাবা-মা চাইতেন মেয়েও সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনা ধারণ করে বড় হোক।

শেখ কান্তা রেজা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তখন আমার বয়স কেবল মাত্র পাঁচ। বাবা গ্রামের আইসক্রিম বিক্রেতার হ্যান্ড মাইক ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া করে দিতো। আমি হ্যান্ড মাইকে গান গাইতাম, ছড়া বলতাম, গল্প বলতাম, গ্রামের উৎসুক মানুষ জড়ো হয়ে আমার বকবক শুনতো। শৈশব কৈশোরে আমি কখনো মেয়েলি খেলা খেলিনি। ক্রিকেট, ফুটবল, হ্যান্ডবল খেলতাম। বাবা আমাকে মেয়ে হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে দেখতে চাইতো। গান করতাম বলে গ্রাম্য মৌলভী ফতোয়া দেয়, গান গাওয়া হারাম, ওরা গান গায়, ওদের সাথে মেলামেশা করা যাবে না। তাই শৈশব-কৈশোরে গ্রামে কারো সাথে আমার তেমন বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি। আমার জগৎ ছিলো বই, গান আর বাবা।’
 


শেখ কান্তা রেজা মাত্র পাঁচ বছর বয়সে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তখনো সে কোনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। নিয়ম অনুয়ায়ী তাকে কোনো একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হিসেবে দেখানো হতো। এতো অল্প বয়সে কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতাটি আবৃত্তি করে উপজেলায় প্রথম, জেলায় প্রথম ও বিভাগীয় পর্যায়ে ২য় স্থান লাভ করেন তিনি। সেই থেকে শুরু। ২০০৪ সালে মিনা দিবসে জাতীয় পর্যায়েও তিনি প্রথম পুরস্কারে ভূষিত হন।

কান্তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় শ্রীপুতিপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কেবল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নয়, পড়ালেখাতে কান্তা মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০০৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে উপজেলায় ফার্স্ট হন। ২০০৯ সালে কলারোয়া গার্লস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। ২০১২ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন-এ প্লাস পান এবং যশোর বোর্ড থেকে বৃত্তি লাভ করেন। কলারোয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এবার উচ্চশিক্ষার পালা। বাবার ইচ্ছা মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, মায়ের ইচ্ছা মেয়ে মেডিক্যালে পড়ুক। কিন্তু সব ইচ্ছা পাশ কাটিয়ে কান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়। বর্তমানে তিনি ৩য় বর্ষে পড়ছেন।

সামাজিক নানা সংগঠনেও জড়িত রয়েছেন কান্তা রেজা। তিনি ২০১৫-তে অনুষ্ঠিত যুব ছায়া সংসদের ২য় অধিবেশনে বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন এবং ২০১৬ সালের ৩য় অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ইয়ুথ এগেইনস্ট হাংগার, স্বেচ্ছা রক্তদাতা সংগঠন বাঁধন, রেজিলিয়েন্স টু ডিজাস্টারের মতো সংগঠনগুলোতে সভাপতি, সহ-সচিব, সাধারণ সদ্যসের মতো পদগুলোতে ভূমিকা পালনে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি চলমান নানা ইস্যু নিয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কান্তা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও উৎসবে আবৃত্তি করেন। তুখোড় এ বিতার্কিক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১২তম নাফিয়া গাজী আন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নিজ বিভাগ থেকে শিরোপা অর্জন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসি শাখার ক্যাডেট করপোরাল কান্তা রেজা স্কাউটিংয়ে সেরা পারফরমেন্সের জন্য পেয়েছেন শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড। এই পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী নিজে তার হাতে তুলে দেন। এ ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

এবার ভারতের ভুবনেশ্বরে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ সামিট-২০১৭ বাংলাদেশী তরুণ ডেলিগেট হিসেবে কান্তা রেজা অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। সার্কের যুব সংগঠন সার্কভুক্ত আটটা দেশের তরুণদের নিয়ে এবারই প্রথম এই যুব অংশের সম্মেলন করতে যাচ্ছে। শেখ কান্তা রেজা তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে রাইজংবিডিকে বলেন, ‘দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের মেয়ে আমি। পড়ছি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। পড়ালেখা শেষ করে জাতিসংঘের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বড় কর্মকর্তা হতে চাই। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়