ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নাসিরুদ্দীন হোজ্জার ঈদের প্রস্তুতি

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাসিরুদ্দীন হোজ্জার ঈদের প্রস্তুতি

হোজ্জার ধারণা গাধার পিঠে উল্টো হয়ে বসলে অনেক বেশি মানুষ দেখা যায়

তাপস রায় : নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল খোয়ির নাম বললে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট উল্টে বলবেন- এ আবার কে? এ নামে তো কাউকে চিনি না! কিন্তু যদি বলা হয় হোজ্জার কথা? তাহলে এক বাক্যে সবাই তাকে চিনবেন। আসলে হোজ্জার পুরো নামটাই শুরুতে বলা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী তিনি কি শুধু ‘হোজ্জা’ নামেই পরিচিত? না। ওটা তার পদবি। কখনও তিনি নসরুদ্দীন, কখনও নাসিরুদ্দীন এবং এর সঙ্গে মোল্লা, খোজা, আফেন্দি, হোজ্জা অনেক কিছুই যুক্ত হয়েছে।


নাসিরুদ্দীন হোজ্জার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। জন্মতারিখও সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কে তার জন্ম। কিন্তু হলে কী হবে? অনেক দেশই দাবি করে হোজ্জা তাদের সন্তান। এই তালিকায় রয়েছে ইরান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান এবং আফগানিস্তান। তবে বিভিন্ন দেশ হোজ্জাকে তাদের লোক দাবি করলেও তুরস্কের আকসেহির শহরে প্রতিবছর জুলাইয়ের ৫ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জা উৎসব’ পালন করা হয়। ধারণা হরা হয় তিনি ১২৭৫ অথবা ১২৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তুরস্কে তার সমাধি রয়েছে। সেই সমাধি ঘিরে প্রতি বছর হয় হোজ্জা উৎসব।


এতদিনে আমরা সবাই জানি রসবোধের কারণে হোজ্জা ভীষণভাবে সমাদৃত এবং জনপ্রিয় চরিত্র। ছোটখাটো বেঁটে একটা মানুষ, মাথায় পাগড়ি, গায়ে জোব্বা আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী একটা গাধা- এই হলো নাসিরুদ্দীন হোজ্জা। হোজ্জার এমন ভাস্কর্য তুরস্কে দেখা যায়। হোজ্জাকে নিয়ে যে গল্পগুলো শোনা যায় তার সবকটিতে তাকে বুদ্ধিমান বলে মনে হয় না। অনেক গল্পে তাকে বোকার মতো কাজ করতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে হোজ্জার বিবেচনা হলো: মানুষ নিজে কখনও বোকা হতে রাজি নয়। অথচ সে অন্যের বোকামি চিরকাল উপভোগ করে। ফলে সমাজে বোকা সেজে বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ। হোজ্জার বোকামি নিয়ে অনেক গল্প আছে।


হোজ্জা রসবোধের মাধ্যমে সমাজের অব্যবস্থাপনা, বিচার ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। কখনও তার কথায় পাণ্ডিত্য, কখনও হেঁয়ালিপনা আবার কখনও চরম বোকামি প্রকাশ পেয়েছে। তারপরও হোজ্জা মুসলিম বিশ্বে আজও সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তার গল্পগুলো লিখিত আকারে, কখনও মুখে মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় এখনও প্রচলিত। আর এভাবেই হোজ্জা আজও ফার্সি, আরবি, উর্দু, আফগানি, আলবেনীয়, আর্মেনীয়, বাংলা, বসনীয়, বুলগেরীয়, গুজরাটি, হিন্দি, কুর্দিশ, রুশ ও চৈনিক সংস্কৃতির একান্ত আপনজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন।


একবার রজব মাসে নাসিরুদ্দীন হোজ্জা সফরে বের হয়েছেন। ইচ্ছে রজব আর শাবান সফর করে রমজানে কোথাও গিয়ে ইমামতি করবেন। তাতে ঈদের আগে দুই পয়সা উপার্জন হবে। কিন্তু রমজানে অনেক চেষ্টা করেও সে কোনো কাজ পেল না। সবাই ফিরিয়ে দিলো। ফলে না খেয়ে মোল্লার মরার উপক্রম!

একদিন এক স্থানে খুব ভিড় লক্ষ্য করে সে এগিয়ে গেল। স্থানীয়রা একটি শিয়াল ধরেছে। কিছুদিন হলো শিয়ালের উৎপাতে নাকি সবাই অতিষ্ঠ। এবার যখন ধরা পড়েছে আচ্ছা শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু কী ধরনের শাস্তি দেয়া যায় কেউ স্থির করতে পারছিল না। তখন মোল্লাকে দেখে সবাই বলল, মোল্লাসাহেব এর বিচার আপনিই করুন।

বেশ তো, বলেই মোল্লা শিয়ালটাকে ধরে ওর গায়ে তার আলখেল্লা ও মাথার পাগড়ি পরিয়ে ছেড়ে দিলো।

এমন কাণ্ডে উপস্থিত সবাই হইহই করে উঠল- মোল্লাসাহেব, আপনি শিয়ালটাকে ছেড়ে দিলেন! তাও আবার জামাকাপড় পরিয়ে!

ঠিকই করেছি। মোল্লা বলল, এখন এই শিয়ালটাকে দেখে সবাই  মোল্লা ভাববে। এবং কোথাও ঠাঁই হবে না। ফলে অনাহারে মৃত্যু ছাড়া ওর আর উপায় থাকবে না। আপনারাই বলুন, এরচেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে!

কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে পেরে উপস্থিত বিজ্ঞজনেরা মোল্লাকে সেবার ইমামতির কাজ দিয়েছিল।

 


তুরস্কে হোজ্জার প্রতিকৃতি

আরেকবারের ঘটনা। রমজান প্রায় শেষ। ফেতরা ও জাকাত আদায়ের সময়। মোল্লা এসে উঠেছে এক ধনী লোকের বাড়ি কিছু পাবার আশায়। লোকটি মোল্লার যত্নের ত্রুটি রাখল না। ভোরে ঘুম থেকে তুলে কোরআন পড়তে দিলো। মোল্লার একটি সুরা পড়া হলে সে নিজেও সেই সুরা পড়ল। সকালে মোল্লাকে চিঠি লিখতে দিলো। লেখা শেষ হলে সেও লিখে মোল্লাকে পড়ার জন্য বলল। মোল্লা পড়ে দেখল সবই ঠিক আছে।

তখন ধনী লোকটি বলল, দেখুন মোল্লাসাহেব, আপনার মতো আমিও লিখতে পড়তে পারি। তাহলে আপনি আমার কাছ থেকে কিছু আশা করছেন কেন? কারণ দুজনেই যখন আমরা সমান।

মোল্লা বলল, আপনার কথা স্বীকার করছি। কিন্তু তাই বলে আমরা দুজন সমান এ কথা মানতে পারছি না।

কেন?

যখন আপনি ত্রিশ মাইল হেঁটে কিছু পাওয়ার আশায় কোথাও যাবেন, গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এবং অপদস্থ হয়ে কিছু না পেয়েই রিক্ত হস্তে বাড়ি ফিরবেন, তখনই শুধু আমার সমান হবেন। তার আগে নয়। মোল্লা বলল।

মোল্লার কথা শুনে সেই ধনী লোকটি তার ভুল বুঝতে পারল এবং তাকে পুরস্কৃত করল। 


হোজ্জার উপরের গল্প দুটিতে যেমন উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়, এই গল্পটি ঠিক তার উল্টো। রমজান মাস। হোজ্জা দিনের হিসাব রাখার জন্য একটা থলেতে প্রতিদিন একটা করে পাথর জমা করতে লাগল। সে কেন এভাবে পাথর রাখছে বাড়ির কেউ জানত না। তার ছোট্ট মেয়ে ভাবল, বাবার কাজে সাহায্য করা যাক। সে সুযোগ পেলেই থলেতে পাথর রেখে দিত।

একদিন এক লোক এসে বলল, মোল্লাসাহেব আজ কয় রোজা বলতে পারেন?

হ্যাঁ, কেন পারব না? একটু দাঁড়াও। বলেই হোজ্জা ঘরের ভেতর গিয়ে থলে থেকে পাথরগুলো বের করে গুণে দেখল সেখানে একশ বিশটা পাথর রয়েছে। কিন্তু এতগুলো পাথরের কথা বলা যাবে না। হোজ্জা ভাবল, একটু বিবেচনা করে বলতে হবে। সে বাইরে বের হয়ে এসে বলল, আজ ছাপ্পান্ন রোজা চলছে।

কি! লোকটি বলল, মাস তো ত্রিশ দিনের।

এতো অল্পেই তুমি অবিশ্বাস করছ! হোজ্জা বলল, আর আমি যদি বলতাম একশ বিশ তাহলে তুমি কী বলতে?


এই হোজ্জাকেই আবার আমরা দেখি ঈদ আসতে না আসতেই তালিকা তৈরি করতে। একবার এক প্রতিবেশী এসে জানতে চাইল মোল্লাসাহেব, কিসের তালিকা করছেন?

হোজ্জা হাসতে হাসতে বলল, আর বলবেন না। ঈদ আসছে। কাজের ভিড়ে হয়তো অনেক কিছুই ভুলে যাব। তাই আগেভাগেই কোথায় কোথায় যাব তার একটা তালিকা করে রাখছি। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়