ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যার রাজনীতি ছিল বিশ্ব শান্তির

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যার রাজনীতি ছিল বিশ্ব শান্তির

শাহ মতিন টিপু : তিনি অহিংস আন্দোলনের জনক। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ভারতের জাতির জনক। তাকে আমরা জানি মহাত্মা গান্ধী নামে । তিনি বাপু (বাবা) নামেও পরিচিত। আসলে তার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ও প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক এই নেতার জন্মদিন আজ। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর তিনি গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিন হওয়ায় ভারতে আজ জাতীয় ছুটির দিন । তার সম্মানার্থে ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী।তার রাজনীতি ছিল বিশ্ব শান্তির। তিনি তার অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রথম প্রয়োগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এর সবগুলোই ছিল ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। তিনি বেশ কয়েকবার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে কারাবরণ করেন।

১৯৩০ সালে লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দেন।তিনি ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) দীর্ঘ ডান্ডি লবণ কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন, যা ১৯৪২ সালে ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি ভারত ছাড়ো আন্দোলনেরও সূত্রপাত ঘটায়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)

১২ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে আহমেদাবাদ থেকে ডাণ্ডিতে পৌঁছান। হাজার হাজার ভারতীয়ও তার সঙ্গে হেঁটে সাগরের তীরে পৌঁছান। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার আন্যতম সফল প্রয়াস। ব্রিটিশরা এর বদলা নিতে ৬০,০০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। সরকার গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা করতে লর্ড এডওয়ার্ড আরউইনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। গান্ধী-আর উইন প্যাক্টস হয় ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে সরকার সকল গণ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের বিনিময় সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়। এ ছাড়াও গান্ধীকে গোল টেবিল বৈঠকের জন্য লণ্ডনে আমন্ত্রণ জাননো হয। সেখানে তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন।

তার জীবনযাপন ছিল অতি সাধারণ। একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ধুতি এবং শাল, তা আবার নিজেই চরকাতেই বোনা । নিরামিষ খাবার খেতেন। শেষ জীবনে ফলমূলই বেশি খেতেন। অবশ্য আন্দোলন ও ধর্মীয় কারণে বেশির ভাগ সময় উপবাসই থাকতেন। মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন।

জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস, পারস্পরিক সহিষ্ণুতা এর সবই শেখা তার মায়ের সংস্পর্শে।তার মা ছিলেন খুবই ধার্মিক। এছাড়া শৈশবে গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশও এসব গুণ অর্জনে তার সহায়ক ছিল।

তার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান (প্রধানমন্ত্রী)। গোত্র হিন্দু বৈশ্য । ১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা-মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন। ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে যান।

গান্ধীর প্রথম অর্জন আসে ১৯১৮ সালের চম্পারন বিক্ষোভ এবং খেদা সত্যাগ্রহের মাধ্যমে।  খেদায় ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতার সময় কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন সর্দার প্যাটেল। তিনি রেভিনিউ সংগ্রহ বন্ধ এবং সকল বন্দীদের মুক্তি দান করেন।  ফলে গান্ধীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশময়।

১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। রাজনীতিকে নিয়ে আসেন সাধারণ জনগণের কাতারে। গান্ধী তার অহিংস নীতির সঙ্গে স্বদেশি পলিসি যোগ করেন। সকল বিদেশি পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। ভারতীয়দের ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এতে নারীরাও আন্দোলনে যুক্ত হয়।

গান্ধীর‘অসহযোগ’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য লাভ করলেও অপ্রত্যাশিত ভাবে এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে উত্তর প্রদেশে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে।  আন্দোলনটি সহিংসতায় মোড় নিতে দেখে গান্ধী নিজেই গণ অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

দুঃখজনক সত্য এই যে, অহিংস নীতির এই ধারককে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি নতুন দিল্লির বিরলা ভবন মাঝে রাত্রিকালীন পথসভা করছিলেন। তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু মৌলবাদী, যার সঙ্গে চরমপন্থী হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ ছিল। হিন্দু মহাসভা পাকিস্তানিদের অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব করে ভারতকে দূর্বল করার জন্য গান্ধীকে দোষারোপ করে। গডসে এবং সহায়তাকারী নারায়ণ আপতেকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় এনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।

জওহরলাল নেহরু রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন: ‘বন্ধু ও সহযোদ্ধারা আমাদের জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে, এবং সেখানে শুধুই অন্ধকার এবং আমি ঠিক জানি না আপনাদের কি বলব কেমন করে বলব। আমাদের প্রেমময় নেতা যাকে আমরা বাপু বলে থাকি, আমাদের জাতির পিতা আর নেই। হয়ত এভাবে বলায় আমার ভুল হচ্ছে তবে আমরা আর তাকে দেখতে পাব না যাকে আমরা বহুদিন ধরে দেখেছি, আমরা আর উপদেশ কিংবা সান্ত্বনার জন্য তার কাছে ছুটে যাব না, এবং এটি এক ভয়াবহ আঘাত, শুধু আমার জন্যই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ২ অক্টোবর ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়