ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একাত্তরের সাক্ষী পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের সাক্ষী পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের নাম। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের নামও উঠে আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তারা। বাঙালি পুলিশের সেই গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ২০১৩ সালে ২৪ মার্চ রাজধানীর রাজারবাগে যাত্রা শুরু করে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। সেই থেকে ইতিহাসপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই জাদুঘর।

জাদুঘর ভবনটি রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই অবস্থিত। জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। ভেতরে ঢুকলেই দুপাশের দেয়ালজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ২০টি বাণী। গ্যালারির মাঝ দিয়ে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। সেখানে একপাশে স্থান পেয়েছে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বেতার যন্ত্র, পাগলা ঘণ্টা, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম। রয়েছে বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, ব্যাজসহ টিউনিক সেট (বিশেষ পোশাক), ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট।

 


আরেক পাশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত এমএম রাইফেল, মর্টার, মর্টার শেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, এলএমজি, মেশিনগান, এমএম এলএমজি, বোর রিভলবার, রাইফেল, বোর শটগান, এমএম এসএমজিসহ আরো অনেক অস্ত্র।

দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এছাড়া ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম স্থান পেয়েছে জাদুঘরে। এছাড়াও সেখানে দেখা যাবে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও দেশিয় অস্ত্র। রয়েছে তৎকালীন পুলিশ প্রধানকে ভাওয়াল রাজার দেওয়া উপহার ‘ঘোড়ার গাড়ি’। রয়েছে ১৮৬৩ সালে পুলিশের ব্যবহৃত ‘লেটার বক্স’।

 


জাদুঘরের দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রামের ১০ মিনিটের ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সংগ্রামী ইতিহাস জানতে প্রতিদিন জাদুঘরে ভিড় জমায় অসংখ্য দর্শনার্থী। জাদুঘর দেখতে দুই বছরের কন্যা ও স্ত্রীসহ এসেছিলেন রাজধানীর শহীদবাগ জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আহমেদ ওসামা (৩৭)। আসার কারণ জানতে চাইলে আহমেদ ওসামা রাইজিংবিডিকে জানান, মুক্তিযুদ্ধে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা গড়ে তুলেছিলেন প্রথম প্রতিরোধ। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান সম্পর্কে জানতে তিনি এসেছেন।

জাদুঘর দেখতে এসেছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এক পুলিশ সদস্য রুবেল মাহমুদ (২৭)। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনেক গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে। যা আমরা অনেকে জানি না। শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরী হিসেবে এই ইতিহাস আমাদের জানা উচিত। তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে অনুপ্রাণিত করবে।’

 


পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ইতিহাস একেবারেই অবহেলিত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ থেকেই প্রথম প্রতিরোধ হয়েছে। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে পুলিশ ব্যাপক প্রতিরোধ করেছে। এই জন্য তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম নির্যাতন। কিন্তু এ ঘটনাগুলো অনেকটা আড়ালেই থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের বীরত্বের কথা মানুষ ভুলতে বসেছে। তাদের অবদান, স্মৃতি ধরে রাখতেই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ। মাত্র ১০ টাকা টিকিটের বিনিময়ে যে কেউ দেখে আসতে পারেন আমাদের সেই গৌরবময় ইতিহাস।

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৭/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ