অবিস্মরণীয় কমরেড
শাহ মতিন টিপু : উপমহাদেশের কিংবদন্তী আজীবন বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে। জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরনোত্তর) ভূষিত হন।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। বহুল আলোচিত টংক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে তার অবিস্মরণীয় অবদান। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
কমরেড মণি সিংহ’র জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতায়। বাবা কালী কুমার সিংহ’র মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী সাত বছরের মণিকে নিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন।
স্কুলের শিক্ষা গ্রহণকালেই মণি সিংহ’র মাঝে বিপ্লবের স্ফুরণ ঘটে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতি সম্পর্কে তার মনে সংশয় দেখা দেয়।
ফলে তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২৫ সালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেন। ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন।
১৯৩০ সালের ৯ মে গ্রেফতার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি দিলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-খেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তার দেড় বছরের জেল হয়।
১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাপুরের মুসলমান কৃষক ও গাড়ো হাজংদের পক্ষে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এরপর মণি সিংহ টংক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৪১ সালে আবার গ্রেফতার হন। ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৪৪ সালে সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি নেত্রকোনায় নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে অসংখ্যবার জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালেও একই পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছরের জুলাইতে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে নির্বাচিত করা হয়। স্বাধীনতার পর ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসে মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৮৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ’৭৭ সালে ৭৭ বছরের মণি সিংহ আবার গ্রেফতার হন। জিয়ার শাসনামলে তাকে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের শেষদিনে তার জীবনাবসান হয়।
কমরেড মণি সিংহ স্মরণে নেত্রকোনার সুসঙ্গ দুর্গাপুরের টংক শহীদ স্মৃতিস্মম্ভের পাদদেশে ৭ দিন ব্যাপী কমরেড মণি সিংহ মেলার উদ্বোধন হচ্ছে আজ। এবারও মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিদিন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। উদ্বোধনী দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। তার স্মরণে নতুন বছরের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ ডিসেম্বর ২০১৭/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন