ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষকের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা কবি

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষকের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা কবি

শাহ মতিন টিপু : বাদশাহ আলমগীর/কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।/একদা প্রভাতে গিয়া/দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া/ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে/পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,/শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি/ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।

-‘শিক্ষকের মর্যাদা’ শিরোনামের এই কবিতাটি জানেন না, এমন পাঠক বিরল। কবিতাটির রচয়িতা কবি কাজী কাদের নেওয়াজ । এই শিশু সাহিত্যিকের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি মাগুরা জেলার মুজদিয়া গ্রামে মত্যুবরণ করেন। 

কবিতার গল্পটি এরকম- দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়ানোর দায়িত্ব ছিল একজন মৌলভীর ওপরে। একদিন বাদশাহ দেখতে গেলেন 'পুত্র কেমন শিক্ষা লাভ করছে?' দেখলেন, বাদশাহ-পুত্র শিক্ষকের চরণে পানি ঢালছে। শিক্ষক তার চরণ ধুয়ে মুছে সাফ করছেন নিজ হাতে। বাদশাহকে দেখে শিক্ষক ভাবলেন, দিল্লীপতির পুত্রের হাতে সেবা নিয়েছি - আজ আর তার নিস্তার নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই শিক্ষকের মনে হলো :

‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার/দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার,/ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল/বাদশাহ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।’

তা আর শোনাতে হয়নি । বরং বাদশাহ তাকে অনেক বড় সম্মানে ভূষিত করেছেন। বাদশাহ-পুত্র শিক্ষাগুরুর চরণে পানি ঢেলেছে, কিন্তু নিজ হাতে চরণ ধুয়ে দেয়নি বলে বাদশাহ কষ্ট পেয়েছেন। শিক্ষক উচ্ছ্বাসভরে বলেছেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির / সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

এই কবিতার মাধ্যমে কবি কাদের নেওয়াজ শিক্ষকের মর্যাদাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কবি নিজেও একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। অবসর গ্রহণের আগে শেষ সময়ে এসে ১৯৫১ তে দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।  এখান থেকেই ১৯৬৬ তে অবসর নিয়ে মাগুরার মুজদিয়া গ্রামে সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

এই কবির প্রায় সব কবিতাই অনুপ্রাণীত হওয়ার, উজ্জীবিত হওয়ার। শিশুমনে আদর্শের বীজ বপনের। যেমন তার আরেকটি শিশুতোষ জনপ্রিয় কবিতা- ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু জেনো ভাই,/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর/তিন ভুবনে নাই।/সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক/মাথার 'পরে আজি,/অন্তরে মা থাকুন মম/ঝরুক স্নেহরাজি।/রোগ বিছানায় শুয়ে শুয়ে/যন্ত্রণাতে মরি,/সান্তনা পাই মায়ের মধু/নামটি হৃদে স্মরি।/বিদেশ গেলে ঐ মধু নাম/জপ করি অন্তরে,/মন যে কেমন করে/আমার প্রাণ যে কেমন করে।’

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের জন্ম ১৯০৯ এর ১৫ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদে মামার বাড়িতে । পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের মঙ্গলকোট গ্রামে। বহরমপুর কলেজ থেকে ইংরেজিতে সম্মানসহ বি.এ পাস করেছেন তিনি। কিছুদিন এম.এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩২ এ বি.টি পাস করে কর্মজীবনের শুরু। কিছুদিন স্কুল সাব-ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পালনের পর তিনি শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন। দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন।

সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেছেন।

কাজী কাদের নেওয়াজ সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন অল্প বয়সেই। বিকাশ, শিশুসাথী,  ভারতবর্ষ,  বসুমতী, শুকতারা, পাঠশালা, রামধনু, শীশমহল, মৌচাক,  প্রবাসী,  সওগাত প্রভৃতি পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যের সব শাখায়ই তার বিচরণ ছিল, তবে কবিতাই ছিল তার প্রধান চর্চা । কবিতায় তিনি সত্য, সুন্দর আর সুনীতিকে ধারণ করতেন । ছান্দসিক কবি হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। সহজ-সরল ভাবমাধুর্যে রচিত তার কাহিনীধর্মী ও নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অনেক।

তার গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলি হলো: মরাল (১৯৩৬), দাদুর বৈঠক (১৯৪৭), নীল কুমুদী (১৯৬০), মণিদীপ, কালের হাওয়া, মরুচন্দ্রিকা, দুটি পাখি দুটি তারা (১৯৬৬), উতলা সন্ধ্যা ইত্যাদি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জানুয়ারি ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়