ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মেঘনা তাদের বাঁচায়, মেঘনাই ভাসায়

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০০, ১৪ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘনা তাদের বাঁচায়, মেঘনাই ভাসায়

খায়রুল বাশার আশিক: ‘আল্লাহ কপালে যা লেখছে তেমনি হইবো। খাইয়া পইরা বাইচা থাকোন পারলেই হইবো। আমগো মতো মাইনষের জীবন এমনেই যায়। মইরা গেলে লাশটারে মাটি দেওনের জমিন যাগোর নাই, তাগোরে আবার দেশ কি অধিকার দিবো?’

ভাগ্যদোষের ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়ায় মেঘনা পাড়ে নৌকায় ভাসমান পরিবারের নারী সদস্য আমেনা খাতুন। গত বছর স্বামীর ভিটে হারিয়েছেন নদী ভাঙনে। এখন সংসার পেতেছেন নৌকায়। এই নৌকায় স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তার ভাসমান সংসার। চারজনের পরিবার নিয়ে আজ এক চরে তো কাল অন্য চরে নৌকা ভেড়ান আমেনা; একটি ঘর তোলার আশায়। দখল হওয়া সেই চরে ভূমিহীন আমেনার জন্য থাকার জায়গা মেলে না।

মেঘনা পাড়ে এমন আমেনার সংখ্যা কম নয়। সবার জীবন তছনছ করে দিয়েছে নদী ভাঙন। কেউ জীবন বাঁচাতে সংসার নিয়ে উঠেছেন নৌকায়, কেউ সব হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে বসতি গড়েছেন শহরের কোনো বস্তিতে। যারা এলাকা ত্যাগ করেছেন তারা হয়তো আর ফিরবেন না এলাকায়। কিন্তু যারা ভাসমান অবস্থায় রয়ে গেছেন তারা লড়ছেন জীবনের ভাগ্য ফেরাতে। তাদের সকাল-দুপুর-রাত কাটে নৌকায়। রান্না-খাওয়া, সন্তান লালন-পালন সব কিছুই হয় নৌকার মধ্যে। এমন অসংখ্য পরিবার আছে মেঘনা নদীর বুকে, যাদের কোনো ভিটে নেই, নেই ঘর।
 


বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানীয়া মেঘনা পাড়, ভোলা জেলা সদরের তুলাতলী মেঘনা পাড়, ইলিশা লঞ্চঘাট, ভোলা তজুমদ্দিন উপজেলার সুলিজঘাট মেঘনা পাড়, মনপুরা, পটুয়াখালী রাঙ্গাবালী উপজেলার চর জব্বার, চর মোন্তাজসহ বরিশাল বিভাগের কোলঘেঁষা মেঘনা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নৌকায় ভাসমান এসব পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত দুর্যোগ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাত কাটাচ্ছে। শিশু সুরক্ষার কথা বোঝেন না পরিবারের কেউ। স্বাস্থ্য সচেতনতা বলতে পাড়ের কোনো ফার্মেসি থেকে সামান্য ওষুধ কিনে খাওয়া। জন্মনিয়ন্ত্রণ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিক সেবা গ্রহণ, শিক্ষা সেবা, নাগরিক অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হাস্যকর এই পরিবারগুলোতে।

নদীর বুকে ভাসমান এই পরিবারগুলো নিজেরাই তৈরি করেছে নতুন সমাজ। প্রয়োজন হলে তারা তীরে নৌকা ভেড়ায়, আবার প্রয়োজনে ভেসে বেড়ায়। তাদের বিশ্বাস মেঘনা তাদের বাঁচায় আর মেঘনাই তাদের ভাসায়। দূর থেকে মনে হদে পারে, এরা জিপসি বা বেদে। কিন্তু তা নয়। সাধারণ বাঙালি হয়েও এরা বেদের মতো ভ্রাম্যমাণ। নৌকায় বেড়ে ওঠা এসব পরিবারের একটি শিশু আরেক নৌকার শিশুটিকে বন্ধু করে নেয়। এক নৌকার গৃহিণী খবর রাখে অন্য নৌকার ভাবী কি মাছ রান্না করেছে তার। নৌকায় ভাসমান এই পরিবারগুলো একে অপরের সঙ্গী, প্রতিবেশী আর সুখ-দুঃখের সাথী। দুটি আলাদা নৌকায় জন্ম নেয়া দুটি ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে নতুন আরো একটি ভাসমান নৌকার জন্ম হয় এভাবেই।  অশিক্ষা কুশিক্ষার মাঝে বেড়ে ওঠা শিশুগুলোর শিক্ষা বলতে শুধু বৈঠা চালানো আর জাল টেনে বা বড়শিতে মাছ ধরা।
 


প্রতিদিন এসব পরিবারে রান্না-খাওয়া আর গোসলে ব্যবহার হয় নদীর পানি। তাদের জীবিকার উৎস মাছ ধরা। প্রতিদিন চাতক পাখির মতোই এরা মাছের জন্য মেঘনার বুকে জাল বা বড়শি ফেলে ভেসে থাকে। বড়শিতে বড় মাছ ধরার কৌশল তারা জানে। শিশুদেরও বড়শিতে ছোট পুটি মাছ গেঁথে বোয়াল, আইর বা চিতল ধরার কৌশল জানা। বড় মাছ পেলেই বিক্রি হয় স্থানীয় কোনো বাজারে। সেই টাকায় হয় সংসারের প্রয়োজনে বাজার। প্রতিটি নৌকায় কমপক্ষে দুই দিনের চাল-ডাল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত থাকে। রান্নার চুলা, কাঠ, হাড়ি-পাতিলসহ সব প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থাকে নৌকায়।
 


ভাঙনে সব হারিয়ে নৌকায় বসত গড়েছে আমির মিয়ার পরিবার। ভোলার ইলিশা ঘাটের আশপাশেই নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরে জীবিকা চালান তিনি। নৌকায় ভাসমান জীবনযাত্রা নিয়ে আমির মিয়া বলেন, ‘গত দুই বছর যাবৎ আমি নদীতেই থাকি। নদীর ভাঙনে ঘর হারানোর পর নতুন ঘর উঠানোর জন্য জমির ব্যবস্থা করতে পারি নাই। নতুন চর জাগলে বড়লোকদের দখলে চলে যায়। আমাদের মতো মানুষগুলা তখন ভাইসা বেড়ায়।’ এমন আরো একটি ভাসমান পরিবারের জেলে রফিক জানান, তাদের মতো এমন অনেক পরিবার আছে মেঘনায়, যাদের জীবন শুধুই মাছ নির্ভর। মাছ ধরে চলে সংসারের খরচ। আবার অনেকেরই ছোট ভিটের ব্যবস্থা থাকলেও, এই পেশায় জড়িয়ে যাওয়ায় ও কর্মের তাগিদে ভিটেতে ফিরতে পারে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, উপকূলীয় মেঘনা তীরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া না হলে প্রতিনিয়ত বাড়বে উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে শিশুমৃত্যু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির হার। আর সাধারণ জনগণ বলছেন, নতুন চর জাগলে ভূমিহীনদের থাকার ব্যবস্থা করা হলে কমে আসবে ভ্রাম্যমাণ পরিবারের সংখ্যা। পাশাপাশি সরকারি খাস জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে এসব ভূমিহীন পরিবারকে অগ্রাধিকার দিলে দেশে কমে আসবে ভাসমান এমন জনগোষ্ঠী।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়