ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লোকজীবনের ঐতিহ্য নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১২ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লোকজীবনের ঐতিহ্য নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘প্রতি বছর অপেক্ষায় থাকি, কবে পয়লা বৈশাখ আসবে। কবে শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্ব। শোভাযাত্রার কাজে নিজের অংশীদারিত্ব থাকলে ভালো লাগে। সবার সঙ্গে দেখা হয়, ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়।’ বলছিলেন এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজে অংশ নেওয়া জেসমিন জাহান ঝুমা। তিনি চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন জাপান অ্যাম্বাসি স্কুলে।

কেবল জেসমিন জাহান ঝুমা নয়, প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বে চারুকলার সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ভরে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণ। এই প্রস্তুতি পর্ব চলে একমাস ধরে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত থাকেন বাঙালির লোকজীবনের ঐতিহ্যের নিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা আয়োজিত ১৪২৫ বাংলা নববর্ষের প্রতিপাদ্য ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। বর্ষবরণের প্রথম দিনে থাকবে মঙ্গল শোভাযাত্রা র‌্যালি ও দ্বিতীয় দিন থাকছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ‘যাত্রাপালা’।



বাংলা নববর্ষ উদযাপন প্রস্তুতির শেষ পর্বে ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। জয়নুল আবেদীন গ্যালারিতে চলছে বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরির কাজ। আরেকটি কক্ষে চলছে যাত্রাপালা বাগদত্তার মহড়া। কেউ কেউ বাঙালির লোকজীবনের ঐতিহ্য নিয়ে দেয়ালচিত্র আকঁছে চারুকলার সামনের দেওয়ালে। অন্যদিকে বাঁশ ও কাগজের ব্যবহারে চাকাওয়ালা টেপা পুতুল, মা ও পাখি, মাছ ও বক, রাজা রানী তৈরি করছে নির্মাণ শ্রমিকদের দশ সদস্যের টিম, তাদের নির্দেশনা দিচ্ছে চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

চিত্রকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত ২০তম ব্যাচের ইফাত আরা নুজাত। তিনি জানান, এবারে শিল্পকর্মে প্রাধান্য পাচ্ছে কাগজের মুখোশ, রাজা-রানির মুখাবয়ব, পেঁচার মুখ, টেপা পুতুল, তুহিন পুতুল। শিল্পকর্মগুলো বিক্রি জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কারুপণ্যগুলোর দাম ৫০ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা। বিক্রিত অর্থ নববর্ষ উদযাপন কাজে ব্যয় করা হবে।

যাত্রাপালা বাগদত্তার মহড়ায় নির্দেশনা দিচ্ছিলেন চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী কমল কুমার দাশ ও সেতুদি। কমল কুমার রাইজিংবিডিকে বলেন, চারুকলায় নববর্ষে ১৯তম বারের মতো যাত্রাপালার আয়োজন করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রামে যাত্রার নামে যে নোংরামি হয়, তার বদলে আমরা যাত্রাপালাকে সুস্থ ধারায় নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করছি।’ এটাকে তিনি বাংলা থিয়েটারের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা বলে জানান।



কথা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাবির সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ নাজির হোসেন খানের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ ৮০% শেষ হয়েছে, বাকি কাজ ১৩ এপ্রিল শেষ হবে। তিনি জানান, পয়লা বৈশাখের দিন সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা র‌্যালিটি যাত্রা শুরু করে শাহবাগ, হোটেল কন্টিনেন্টাল হয়ে আবার শাহবাগ টিএসসি ঘুরে চারুকলায় ফিরবে। পরের দিন বিকেলে চারুকলার বটতলায় ঐতিহাসিক গল্প কাহিনি নিয়ে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে।

যেভাবে শুরু মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে আনন্দ শোভাযাত্রা নামে। এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে সর্বজনীন পয়লা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রা নামে, মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। সে বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীগণ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে।



শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ ও সাজসজ্জাসহ বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। পয়লা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।

১৯৯০ সালের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। ১৯৯২ সালে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রঙ বেরঙয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ সালে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। সময়ের বিবর্তনে আনন্দ শোভাযাত্রা, মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম ধারণ করে।

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনটেনজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ঐতিহাসিক মঙ্গল শোভাযাত্রা এ বছর তিন দশক অতিক্রম করছে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়