ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পীরগঞ্জ গণহত্যা দিবস

৪৭ বছরেও স্বীকৃতি মিলেনি

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৪৭ বছরেও স্বীকৃতি মিলেনি

আমিনুর রহমান হৃদয় : মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বাঙালিদের সংগঠিত করার কাজ করতেন ঠাকুরগাঁও জেলার ডা. সুজাউদ্দিন আহমদ। সবাই তাকে সুজা ডাক্তার হিসেবেই তখন চিনতেন। তার বাড়ি জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বীরহলী গ্রামে। তিনি তৎকালীন দিনাজপুর জেলার পীরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল নিজ চেম্বার থেকে তুলে নিয়ে ডা. সুজাউদ্দিন আহমদ ও তার বড় ভাইসহ ৭ জনের এর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তির সংগ্রামে ডা. সুজাউদ্দিনসহ ৭ জন একই সঙ্গে প্রাণ দিলেও স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও তাদের পরিবার পায়নি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার কোনো সরকারি স্বীকৃতি। আর অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সহ শহীদদের সমাধি স্মৃতি চিহৃ।

সম্প্রতি কথা হয় শহিদ ডা. সুজাউদ্দিন এর সন্তান ও পীরগঞ্জ সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বদরুল হুদার সঙ্গে। বদরুল হুদা বলেন, ‘মায়ের মুখে শুনেছি- ‘আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় এনিয়ে এলাকার মানুষদের নিয়ে সভা করতেন। আর এলাকার মানুষকে যুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করার কাজও করতেন তিনি। বাবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে এ খবর পাকিস্তানিরা পেলে ১৭ এপ্রিল বাবাসহ আরো কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। আর সেদিনই আমার বাবা ডা. সুজাউদ্দিন, আমার চাচা মোজ্জাফর হোসেন সহ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, আতিউর রহমান ও নাম না জানা আরো দু’জনকে শিবগঞ্জের জামালপুর ভাতারমারী ফার্মে বেয়োনেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর আমার বাবা ও চাচার লাশ গোপনে এনে বীরহলী গ্রামে দাফন করা হয়।’

এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের সন্তান আক্ষেপ করে আরো বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্যই জীবন হারিয়েছেন পাকিস্তানিদের হাতে। কিন্তু আমরা এখনো ভাই-বোনেরা শহীদ সন্তানের এবং আমার মা শহীদের স্ত্রীর সরকারি কোন স্বীকৃতি পায়নি। আর বাবার কবর তো হারিয়ে যেতে বসেছে। বাবার কবরটিও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০১৪ সালে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেছি বাবার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের স্বীকৃতি পাওয়া জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বীকৃতির কোনো খবর নেই। আমার মায়ের বয়স ৭৮ বছর। শেষ বয়সেও যদি মা শহীদ/শহীদ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেত তাহলে এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া হতো। আর কতদিন অপেক্ষা করবো স্বীকৃতির জন্য।’

প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শহীদ অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা ও শহীদ আতিউর রহমানের পরিবারের সদস্যরা।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার চাপোড় গ্রামের বাসিন্দা শহীদ আতিউর রহমান পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তার দ্বিতীয় সন্তান আজাহারুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির। আজাহারুল জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১০ বছর। পড়তেন ৪র্থ শ্রেণীতে।

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অল্প অল্প বুঝতাম। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে প্রায়ই আমার বাবা প্রফেসর গোলাম মোস্তফা যুদ্ধ নিয়ে আলাপ-সালাপ করতেন ডা. সুজাউদ্দীনের বাসায়। বাবার সঙ্গে আমিও যেতাম মাঝে মাঝে। যুদ্ধ নিয়ে তাদের আলাপ আমিও শুনতাম। উনার (ডা. সুজাউদ্দীন) একটা ভাই ছিল ডুডু নাম। তার মিষ্টির দোকান ছিল। আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়াতো।’

‘১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ। পাকিস্তানিদের কাছে আগেই থেকেই মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের তালিকা ছিল। তারা এসে চারদিকে ঘেরা করে আমার বাবা, ডা. সুজাউদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, সুজাউদ্দিনের ভাই মোজ্জাফর হোসেন ডুডুসহ দুইজন হিন্দুকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। হিন্দু দু’জনের দোষ ছিল তারা নাকি কাঠের নৌকা তৈরি করেছিল। পরে তারা শিবগঞ্জের ভাতারমারী ফারাম নামক স্থানে বেয়োনেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে ডা. সুজাউদ্দিনের লোকজন তাদেরই গাড়িতে তারা দুই ভাই ও আমার বাবার লাশ নিয়ে আসে বিরহলী নামক গ্রামে নিয়ে আসে। এখান থেকে আমার চাচাসহ কয়েকজন গোপনে নিয়ে এসে মছলন্দপুর গ্রামে কবর দেয়।’

আজাহারুল আরো বলেন, ‘আমার বাবা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন। এজন্যই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাকে শহীদের মর্যাদা দিবে এ বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার। এবং আমার বাবার কবরটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেন হয়। অনেক দরখাস্ত করেছি প্রশাসনের কাছে বাবার নামে রাস্তা করার জন্য কোনো লাভ হয়নি। বাবার নামে শহীদ আতিউর রহমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০০০ সালে নিজ উদ্যেগে প্রতিষ্ঠা করি। বেতন এখনো হয়নি।’

৪৭ বছর পরেও এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সমাধি সংরক্ষণ ও শহীদের স্বীকৃতি দিতে ব্যবস্থা নিবে সরকার এমনটাই আশা করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়