ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বকাপের বল নিয়ে যত কথা

শিলু হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৫ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বকাপের বল নিয়ে যত কথা

শিলু হোসেন: ফুটবল খেলায় দর্শক, খেলোয়াড় এমনকি রেফারির চোখ সবচেয়ে যে জিনিসটির দিকে বেশি থাকে সেটি বল। বল গোলপোস্টের জালে জড়িয়ে গেলে গোল হয়। প্রিয় দলের গোল পাওয়ার আশায় দর্শক খেলা দেখতে আসেন। আর গোল হলে তো কথাই নেই, মাঠের মধ্যেই আনন্দে নেচে ওঠে খেলোয়াড়, মাঠের বাইরে ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠ উত্তেজিত হয়, হাততালিতে ফেটে পড়ে গ্যালারি। বিশ্বকাপ ফুটবলের ক্ষেত্রে এই উত্তেজনা চরমমাত্রা ধারণ করে।

প্রতিটি বিশ্বকাপেই আলাদা আলাদা বল ব্যবহৃত হয়। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরেকটু আলাদা। ফিফা আর ক্রীড়াসামগ্রী তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান এডিডাস স্বাগতিক দেশগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছাপ রেখে বলের নাম রাখার চেষ্টা করে। বিগত বিশ্বকাপের আসরে ব্যবহৃত বলগুলোর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। যেমন ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে বলের নাম ছিল ‘অ্যাজটেকা’। মেক্সিকোর প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতার প্রতি সম্মান রেখে এর নামকরণ করা হয়েছিল। আবার ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের বলের নাম ছিল ‘ব্রাজুকা’। কিন্তু এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যবহৃত বলের নাম এরকম কোনো বিষয়ের সাথে মিল রেখে নির্ধারণ করা হয়নি। এই বলের নাম রাখা হয়েছে প্রায় ৫০ বছর আগেকার একটি বলের নামে।

১৯৬৩ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডায় ‘টেলস্টার’ নামে একটি স্যাটেলাইট স্টেশন চালু হয়। যেটি আবহাওয়া ও টর্নেডোর পূর্বাভাস সম্প্রচার করতো। জনপ্রিয় সেই নাম থেকেই ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে বলটির নাম দেওয়া হয় ‘টেলস্টার’। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের নবম আসরে ফুটবলের কর্তা সংস্থা ফিফার সঙ্গে প্রথম বল তৈরিতে চুক্তি করে এডিডাস। চলতি বছরে এই টেলস্টার বলটির ৪৮তম জন্মবার্ষিকী চলছে। বলটির সামনে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নাম দেওয়া হয়েছে ‘টেলস্টার-১৮’। যদিও প্রথম টেলস্টারের  থেকে এর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। টেলস্টার-১৮ তৈরি করা হয়েছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে। এডিডাসের কাছ থেকে রাশিয়া বিশ্বকাপের এই ফুটবল তৈরির স্বত্ব পায় পাকিস্তানের ক্রীড়াসামগ্রী নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘ফরওয়ার্ড স্পোর্টস’। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপে সেখান থেকেই ফুটবল তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে।

শিয়ালকোটে ফুটবল তৈরির শুরুর ঘটনাটাও একটু অদ্ভুত। ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশদের কাছে ফুটবল বরাবরই ছিল জনপ্রিয় খেলা। তাদের জন্য জাহাজে করে ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল আসত ভারতে। অনেক সময় নানা কারণে ফুটবল আসতে দেরি হয়ে যেত। ১৮৮৯ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে শিয়ালকোটের এক ব্রিটিশ সেনার ফুটবল ফেটে যায়। তখন এক মুচির কাছে ফুটবল সারাতে নিয়ে আসেন তিনি। মুচির কাজ দেখে মুগ্ধ হন ওই সেনা। এরপর তাকে একটি ফুটবল বানানোর কথা বলেন। শিয়ালকোটে বানানো প্রথম ফুটবল সেটিই। সেই থেকেই সেখানে ফুটবল বানানো শুরু।

ভারতের সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়া এই শহর তাদের চমৎকার ক্রীড়া সামগ্রী তৈরির জন্য এখন বিখ্যাত। বিভিন্ন বড়ো ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য অনেক আগে থেকেই ফুটবল সরবরাহ করে আসছে তারা। জার্মানির বুন্দেসলীগ, ফ্রান্সের লীগ ওয়ান এবং চ্যাম্পিয়নস লীগে ফুটবল সরবরাহ করে থাকে ফরওয়ার্ড স্পোর্টস। ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ব্রাজুকা তারা বানিয়েছিল। এই বিশ্বকাপে ব্যবহার করা হয়েছে থার্মো ব্যান্ডেড ফুটবল। নতুন উপায়ে তৈরি এই বল সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে। তার আগে হাতে সেলাই করা ফুটবল সরবরাহ করত পাকিস্তান। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় সব বিশ্বকাপেই হাতে সেলাই করা ফুটবল সরবরাহ করেছে পাকিস্তান। থার্মো বান্ডেড বলগুলো মূলত তাপ দিয়ে জোড়া লাগানো বল। এই প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করে এডিডাস। এরপর ২০১৩ সালে ফরওয়ার্ড স্পোর্টসের হাতে তুলে দেয়। সারা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ বল এখন পাকিস্তানে তৈরি হয়। আর প্রতিমাসে এই কোম্পানি ফুটবল বানায় প্রায় ৭ লাখ। ক্রীড়া সামগ্রী রপ্তানি করে পাকিস্তান প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। এর মধ্যে ৩৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারই আসে ফুটবল রপ্তানি করে।

ফিফা র‌্যাংকিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান ২০১ তম। তবে পাকিস্তানের নাগরিক সরাসরি খেলায় অংশগ্রহণের স্বাদ পাচ্ছে তাদেরই বানানো বলের কারণে। যে কারণে অন্যান্য দেশের দর্শকের তুলনায় তাদের উত্তেজনা একটু বেশি। ফরওয়ার্ড স্পোর্টসের চেয়ারম্যান খাওজা মাসুদ বলেন, ‘যদিও পাকিস্তানের ফুটবল দল বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে না, তবুও আমাদের এই ফুটবলের কারণে আমরা সেখানে উপস্থিতির অনুভূতি পাব।’ অবশ্য টেলস্টার-১৮ বলটি নিয়ে বিশ্বকাপ খেলা শুরুর আগে খানিকটা বিতর্কের চর্চা হয়। গুণগত মান থেকে শুরু করে টেলস্টারের ডিজাইন মন কেড়েছে আর্জেন্টাইন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির। গত বছর ৯ মে রাশিয়া বিশ্বকাপের বলের আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনীর সময় এই বলটির প্রশংসা করেন তিনি। তার মতে আকারে ছোট এবং হালকা হওয়ায় ফরোয়ার্ডরা এই বল থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে। মেসির এরকম প্রশংসা পেলেও গোলরক্ষকরা টেলস্টারকে নিয়ে খুশি নন। স্প্যানিশ গোলরক্ষক পেপে রেইনা এই বলের অনেক সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানান, এই বলের কারণে দূর থেকে শটে অনেক গোল হতে পারে। তাছাড়া বলটি প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো তাই ধরা কঠিন।

রাশিয়ার অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে বলের ওপর বরফ পড়ে কোনো রকমে যেন খেলায় ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্যে প্লাস্টিকের বিশেষ আবরণ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে বলটি। ১৯৭০ সালের টেলস্টারের মডেলের এই আধুনিক সংস্করণে রয়েছে ছয়টি প্যানেল যেখানে পুরোনো বলটিতে ছিল ৩২টি প্যানেল। এই বলটি আগেকার যে কোনো বিশ্বকাপ বলের তুলনায় হালকা এবং সেরা।  মূল টেলস্টারটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন সাদা-কালো টেলিভিশনের যুগ। তাই বলটি যাতে স্পষ্ট দেখা যায় সেই ব্যাপারটি মাথায় রেখে বলের রং সাদা-কালো করা হয়। মূলত সেই ডিজাইনেই আধুনিক প্রযুক্তিতে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে টেলস্টার-১৮।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়