ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শপথ ছিল ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শপথ ছিল ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’

সাইফুল ইসলাম: আশরাফুল ইসলাম জগলু চৌধুরী তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠছেন। বাবা আজিজুল ইসলাম চৌধুরী রতনকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। পাঁচ ভাই, তিন বোনের মধ্যে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা। এমন পারিবারিক পরিবেশের সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ভারতে চলে যান জগলু চৌধুরী। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে চলে আসেন নিজ এলাকায়। অংশ নেন ঐতিহাসিক শৈলাবাড়ি যুদ্ধে। এ যুদ্ধে তার গ্রুপ কমান্ডার আহসান হাবীবসহ অন্তত পাঁচজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। শৈলাবাড়ি থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে ১৪ ডিসেম্বর তারা ঢুকে পড়েন সিরাজগঞ্জ শহরে।

একাত্তরে সিরাজগঞ্জ শহরে পাকা ভবন ছিল হাতে গোনা। বাকী সবই টিনের ঘর, বাসাবাড়ি, দোকানপাট। জগলুরা দেখতে পান, পুরো শহরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও দোসরেরা ভস্মিভূত করে দিয়েছে। জনমানবহীন শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে শহরবাসী ফিরতে থাকে নিজ শহরে, গ্রাম থেকেও আসতে থাকে জনতা বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে। ধ্বংসস্তূপ হওয়া শহরই হয়ে ওঠে উৎসবের শহরে। সে উৎসব স্বাধীনতার উৎসব, বিজয়ের উৎসব। জগলুসহ এফএফের (ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত)  মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেন ভিক্টোরিয়া স্কুলের গোপাল হলে। সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজের লাগোয়া হওয়ায় এ স্কুলের ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অপরিসীম। এটাই ছিল সিরাজগঞ্জের স্কুল ছাত্রদের রাজনীতির সূতিকাগার। এ স্কুল থেকে হাতেখড়ি নিয়ে সিরাজগঞ্জ কলেজে তথা পুরো মহুকুমায় ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন অনেকেই। এ ক্যাম্পটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন আমির হোসেন ভুলু ও ইসমাইল হোসেন। একই ভাবে কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। কারণ, তারা মনে করতেন যে, দেশের স্বাধীনতা এবং জনগণের মঙ্গলের জন্য তারা যুদ্ধে নেমেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শপথই ছিল ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’। দেশের জন্য দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য তাদের প্রতিজ্ঞা তখনো অক্ষুন্ন। তারা সচেতন ছিলেন যে, তাদের আচরণে মুক্তিযুদ্ধের সুনাম-দুর্নাম নির্ভর করছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল, সে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয় নতুন ক্যাম্পেও। কমান্ডার বা ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারতেন না, বাইরে গেলেও অস্ত্র বহণের সুযোগ ছিল না। সুযোগ ছিল ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার, কিন্তু তখন দেওয়া হতো না অস্ত্র বহনের সুযোগ। সকাল-দুপুর রাতের নির্দিষ্ট সময়ে খাবার দেওয়া হতো; নিতে হতো লাইনে দাঁড়িয়ে। আত্মীয়-স্বজন এলে দেখা করা যেতো নির্দিষ্ট কক্ষে। ক্যাম্প কমান্ডারদের নির্দেশে কখনো কখনো পালিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের ধরতে যেতে হতো, তখনই অস্ত্র বহন করা যেতো। ইচ্ছে করলেই কোনো মুক্তিযোদ্ধা তার ব্যক্তিগত শত্রু ধরে আনতে পারতো না, এ উদ্যোগ কেউ নিলেও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হতো। কারণ তখনও মুক্তিযোদ্ধারা ছিল দেশপ্রেমে টগবগে।

দিন যায়, সরকারী কর্মচারীরা ফিরে আসতে থাকে। জগলুদের ক্যাম্পসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সমবেত করা হয় নিউ মার্কেটের মিলিশিয়া ক্যাম্পে। কেউ কেউ নিজে থেকেই মিলিশিয়া ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে যার যার কাজে অর্থাৎ স্কুল-কলেজে, কল-কারখানায় অথবা কর্মস্থলে ফিরে যেতে থাকে। তাদের এক মাসের বেতনের পঞ্চাশ টাকা এবং একটি সার্টিফিকেট দিয়ে বিদায় করা হয়। এভাবেই ভেঙে যায় মুক্তিযোদ্ধা দলগুলো। ভেঙে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা শৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জগলু চৌধুরী সেদিনের বিজয়ের আনন্দ এখন আর পান না। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা সেই শৃঙ্খলাকে এখন মনে হয় স্বপ্নের মতো। সে শৃঙ্খলা কীভাবে গড়ে উঠেছিল তা তিনি জানেন না, কিন্তু উপলদ্ধি করেন যে, বাঙালি জাতি এক সুকঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তা আর নেই এখন। তাই জাতির সবার মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছে। আবারো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে এতোদিন পরেও বিজয় আনন্দময় হয়ে উঠবে বলে তার বিশ্বাস।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়