ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফজরের আজান ছিল যুদ্ধ শুরুর সংকেত

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফজরের আজান ছিল যুদ্ধ শুরুর সংকেত

মহিউদ্দিন অপু : ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। এই দিন দেশের বেশ কিছু স্থান হানাদার মুক্ত হয়। পাক হানাদারদের হটিয়ে আজকের এই দিনে বরগুনা মুক্ত করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকহানাদার ও রাজাকারদের হাতে নিহত ১৩৮ জন শহীদ স্মরণে বরগুনার শহীদ স্মৃতি সড়কের গণকবরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সার্কিট হাউস ময়দানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। বরগুনার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় যথাযথ মর্যাদায় দিনটি স্মরণ করছেন। বিজয় শোভাযাত্রা, স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বরগুনা হানাদার মুক্ত দিবস।

মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীন বরগুনাকে মাত্র ২২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বে হানাদার মুক্ত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই বরগুনার মুক্তিকামী তরুণ প্রশিক্ষণ শুরু করলেও এরই মধ্যে পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলা দখল করে। হানাদারদের মোকাবেলা করার মতো তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যান মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে বিনা বাধায় বরগুনা শহর দখল করে ফেলে পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বরগুনার বিভিন্ন থানা ও তৎকালীন মহকুমা সদরে অবস্থান করে নির্বিচারে গণহত্যা ও পৈশাচিকভাবে নারী নির্যাতন করতে থাকে পাকবাহিনী। ২৯ ও ৩০ মে জেলখানায় ৭৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে হায়েনার দল। কয়েক মাসের মধ্যে বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল ও শক্তি অর্জন করে এলাকায় ফিরে আসে। বামনা, বদনীখালী ও আমতলীতে যুদ্ধ হয়। তখন পাকবাহিনী জেলার ট্রেজারি ও গণপূর্ত বিভাগের ডাকবাংলোয় অবস্থান নেয়।



বরগুনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মানোয়ার হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পেয়ে বুকাবুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ২ ডিসেম্বর বেতাগী থানার বদনীখালী বাজারে আসেন। রাত ৩টার দিকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার খানের নেতৃত্বে নৌকায় করে বরগুনার খাকদোন নদীর পোটকাখালীতে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের নিজস্ব সংকেত পেয়ে ভোর রাতে তীরে উঠে আসেন তারা। মাত্র ২১ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি বরগুনা মুক্ত করার লক্ষে আক্রমণ করেন। তাদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন বরগুনার, বাকি ১১ জন ছিলেন ঝালকাঠির। কারাগার, ওয়াবদা কলোনী, জেলা স্কুল, সদর থানা, ওয়্যারলেস স্টেশন, এসডিওর বাসাসহ বরগুনা শহরকে কয়েকটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যে যার অস্ত্র নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান নেন এবং ফজরের আজানকে যুদ্ধ শুরুর সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেন।

আজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ৬টি স্থান থেকে একযোগে ফায়ার শুরু করা হয়। সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে পাক হানাদাররা। দ্বিতীয় দফা ফায়ার করে জেলখানার দিকে এগোতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। চারজন সহযোগীসহ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার খান ছিলেন কারাগার এলাকায়। তারা এসময় জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করিয়ে এসডিও অফিসের সামনে নিয়ে আসেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়ে স্বাধীনতাকামী তৎকালীন এসডিও আনোয়ার হোসেনকে মুক্ত করেন। দুপুর ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব সাময়িকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চলে যায় বুকাবুনিয়া সাব-সেন্টারে। এর পরপরই লাল সবুজের পতাকা ওড়ে বরগুনার বুকে। সেদিন থেকেই হানাদার মুক্ত হয় বরগুনা।



এছাড়াও ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর সরাসরি গুলিতে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথম শহীদ হয় রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনীর সদস্যরা। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে শহরে প্রবেশ করেন এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বিজয় উল্লাস করে। আরো জানা যায়, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুক্তাঞ্চল থেকেই পরিচালিত হয় ’৭১ এর চূড়ান্ত লড়াই। ১৫ এপ্রিলের পর ঠাকুরগাঁও এলাকায় শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুটপাটের সঙ্গে ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ। শহরের ইসলাম নগর থেকে ছাত্র নেতা আহাম্মদ আলীসহ ৭ জনকে হানাদারা ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে ধরে এনে আটক করে রাখে। বেয়নেট চার্জ করে হত্যার পর তাদের লাশ শহরের টাঙ্গন ব্রিজের পশ্চিম পাশে গণকবর দেয়। পরে ১৭ এপ্রিল ২ হাজার ৬শ’ নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। ওইদিনই জগন্নাথপুর, গড়েয়া শুখাপনপুকুরী এলাকার কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভারত অভিমুখে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে আটক হয় এবং মিছিলের কথা বলে পুরুষদের লাইন দিয়ে পাথরাজ নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে পাক হানাদারদের ব্রাশফায়ারে তাদের হত্যা করায়। পরে মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানে পঞ্চগড় মুক্তিবাহিনীদের দখলে চলে এলে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে এবং  ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। অপরদিকে মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে তাই পাকসেনারা ৩০ নভেম্বর ভুল ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ২ ডিসেম্বর সারারাত গোলাগুলির পর শত্রু বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পুরোপুরি পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে শত্রুমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও।

৩ ডিসেম্বর পীরগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত দিবস। জানা যায়, মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের অধীনে দুইশতাধিক গেরিলা ও মিত্রবাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে ’৭১ এর এই দিন পাকবাহিনীরা পীরগঞ্জ ছাড়তে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা নেতা শহীদুল্লাহ শহিদ, মকিমউদ্দিন আহম্মেদ, আব্দুল আজিজ, বীরহলীর তালেবুর রহমান ও কাচন ডুমুরিয়ার আকতারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন গেরিলা মুক্তিসেনারা পীরগঞ্জে প্রবেশ করেন। ডিফেন্সের মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট পীরগঞ্জে প্রবেশ করলে পাকবাহিনী পালিয়ে যায় এবং সেই দিন থেকেই ৩ ডিসেম্বর পীরগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।



৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ কোটালীপাড়াও হানাদার মুক্ত হয়। জানা যায়, কাকডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্পের সদস্যরা এই দিন মুক্তিকামী হেমায়েত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাই প্রতিবছর কোটালীপাড়ায়ও যথাযথ মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দিনটি স্মরণ করা হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়