ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘ধনীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিলেও দরিদ্ররা দিয়েছে’

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৩, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ধনীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিলেও দরিদ্ররা দিয়েছে’

সাইফুল ইসলাম: ডা. জহুরুল হক রাজা (৬৬)। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএমএ’র সভাপতি। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেবার আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বাবা অ্যাড. আব্দুল করিম মিয়া সিরাজগঞ্জ শহরের মোক্তার পাড়ায় থেকে ওকালতি করতেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হামলা শুরু করলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সিরাজগঞ্জ শহরের যেটুকু বন্ধন ছিল তা-ও ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হয়, শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে মাঝখানে একটি অঞ্চলে স্বাধীনতাপন্থীদের তৎপরতা পাকিস্তানীরা সইবে কেন? তারা সিরাজগঞ্জকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ছড়াতে শুরু করে পাকিস্তানীদের আসার খবর। তাদের বর্বরোচিত গণহত্য, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের ভয়াবহতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। শহরবাসী ত্যাগ করতে থাকে তাদের প্রিয় শহর। সে সময় অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল জহুরুল হক রাজার পরিবার শহর ছেড়ে চলে যায় শাহজাদপুর থানার নিজ গ্রাম আগ-নুকালীতে।

গ্রামে গিয়ে লেখাপড়া থেকে আরো ছুটি পায় রাজা।  একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা, যা তখন সকল বাঙালিই করতো। গ্রামের পাশের সড়কের ইব্রাহিমের মুদি দোকানে বসে দূর থেকে আসা মানুষকে পানি খাওয়ানো, ক্ষুধার্তকে কিছু খাবার দেওয়া আর তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের খবর নেওয়া-এই ছিল কাজ। এর মধ্যেই পাকিস্তানীরা সিরাজগঞ্জ দখল করে নেয়। আগুনে পুড়িয়ে দিতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। সে আগুন নেভানোর কেউ নেই, জ্বলতে থাকে দিনের পর দিন। এ সময় খবর আসে, ভারতে তাদের বয়সী অনেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। অস্ত্র নিয়ে দেশের ভিতরে ঢুকে লড়ছে তারা স্বাধীনতার জন্য। জহুরুল হক গ্রামের পাঁচ বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের। তারা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসেন নিজ এলাকায় কমান্ডার কুয়াত-ইল ইসলামের নেতৃত্বে।

তারা এলাকায় ফিরে বড় বাহিনী গড়ে তোলার পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধকেই কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। শুরু করে গ্রামে গ্রামে উঠোন বৈঠক, বাজারে পোস্টার লাগানো, স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী ইত্যাদি শত্রু পক্ষের দুর্বল স্থানগুলোতে হামলা চালানোর। তাদের কমান্ডার কুয়াত-ইল ইসলাম ছাপাখানা বসিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশেরও উদ্যোগ নেন। ছাপাখানাটি অন্যত্র থেকে এনে দেন দৌলতপুর আওয়ামী লীগের কর্মীরা। পত্রিকার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলার মুখ’।  পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুলফিকার মতিন। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব তৎপরতায় স্বাধীনতাবিরোধীরা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে থাকে। গ্রামাঞ্চল হয়ে ওঠে অনেকটা মুক্ত এলাকা। এ সময় জহুরুল হক রাজা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে, কৃষক, তাঁত শ্রমিক, এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সখ্য বাড়ছে। গ্রামের ধনী পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেলেও দরিদ্ররা আশ্রয় দিচ্ছে সহজেই। ধনী বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নিতে কখনো কখনো ভয় দেখানোর প্রয়োজন পড়লেও দরিদ্ররা আশ্রয় দিচ্ছে ডেকে নিয়ে। বেশীর ভাগ দরিদ্র পরিবারের একটাই ঘর, সে ঘর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছে গোয়ালঘরে। নারীরা তো আরো অবাক করা কাণ্ড ঘটিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাড়িতে গেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে শোলার বেড়া ফাঁক করে দেখেছে। বের করে দিয়েছে ফুল তোলা কাঁথা- যা তুলে রাখা হয়েছিল কোনও প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য অথবা মেহমানদের জন্য। তাদের আচরণ, শ্রদ্ধা ভক্তিতে জহুরুল হক রাজার মনে হয়েছে যে, রূপকথার রাজপুত্তুর যেন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে দরিদ্রদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে জহুরুল হক রাজাসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের।

চূড়ান্ত যুদ্ধের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসে। আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল মানেক শ’ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বলতে থাকেন ‘হাতিয়ার ডাল দো’। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় আত্মসমর্পণও করে পাকিস্তানী জেনারেল একে নিয়াজীসহ ৯৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য। শত্রু মুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা। সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের সাধারণ মানুষ। সন্ত্রস্ত হয় বিত্তবানেরা। ডা. জহুরুল হক রাজা জানান, এখন দরিদ্রদের ওপর কেউ ভরসা করেন না, তাদের সঙ্গে সকল কিছুরই দুরত্ব বেড়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী- এরা এখন দরিদ্রদের থেকে যোজন-যোজন দূরে। অথচ তারাই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমার কাছে মনে জয়, বিজয় দিবস এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়