ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ

জালিয়ানওয়ালাবাগের দেয়ালে গুলির ক্ষতচিহ্ন

তপন চক্রবর্তী: আজ ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯। ১৮১৮ সালের এই দিনে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের কলঙ্কের দিন। এই দিন বিকেলে ব্রিটিশ সেনারা তৎকালীন পাঞ্জাব অঞ্চলের (বর্তমান পাঞ্জাব রাজ্য) অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণ-জমায়েতে বিনা নোটিশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত শিশু-কিশোর-তরুণ-নারী-পুরুষকে হত্যা করেছিল। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় পাঁচশ ও আহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। বেসরকারি হিসেবে মৃত ও আহতের সংখ্যা এর প্রায় তিন গুণ। বাঁচার আশায় পাতকুয়ায় যারা ঝাপিয়ে পড়ে মারা গিয়েছিল তাদের সংখ্যা কয়েক শত।

জমায়েতের স্থানটি তিন দিক থেকে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা ছিল। সেনারা উন্মুক্ত ফটক বন্ধ করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিন্যাল্ড অ্যাডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারের ওপর পাঞ্জাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েছিল। এটি ছিল তার শান্তি প্রতিষ্ঠার বর্বরতম প্রয়াস। জনগণের অপরাধ তারা ‘রাওলাট আ্যাক্ট’-এর বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে একদিনের ধর্মঘটে পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত মিছিলে সেনাদের গুলিবর্ষণ ও গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে যোগ দিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৮) ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রোধে অনেকগুলো দমনমূলক জরুরি আইন প্রণয়ন করেছিল। যুদ্ধশেষে ভারতের জনসাধারণ আশা করেছিল যে, প্রবর্তিত নিপীড়নমূলক আইন তুলে নিয়ে জনগণকে অধিকতর রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টে’ ভারতে সীমিতভাবে স্থানীয় স্ব-শাসিত সরকার পরিচালনার অধিকার প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ ১৯১৯ সালের প্রথমে ‘রাওলাট অ্যাক্ট’ প্রবর্তন করে, যার বদৌলতে ভারতবাসীকে অধিক নিপীড়ন করা যায়।
 

স্মৃতিসৌধ


এই আইনে বিনা পরোয়ানায় যাকে ইচ্ছা গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করার ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছিল। রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে সারা ভারতে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে থাকে। পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রতিবাদের আগুন বেশি ঝলসে ওঠে। ১৯১৮-এর এপ্রিলের প্রথমে গান্ধীজী একদিনের জন্য সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। অমৃতসরে খবর এসে পৌঁছায় যে ভারতের স্বনামধন্য রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁদের গুম করা হয়েছে। এই সংবাদে অমৃতসরের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১০ এপ্রিল জনগণ পথে নেমে আসে। সেনারা গুলি বর্ষণ করে। মানুষ মারা যায়। সেনারা শহরের বিল্ডিংসমূহে লুট করে ও আগুন ধরিয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে। ক্রুদ্ধ জনতা কয়েকজন বিদেশিকে হত্যা করে এবং এক ক্রিশ্চান মিশনারিকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এরপর জেনারেল ডায়ার গণ-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। জনগণ তার আদেশ অমান্য করে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদ সভায় হাজির হয়েছিল।

নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের পর পাঞ্জাব অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করা হয়। জনগণকে বেধড়ক পেটানো ছাড়াও নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। এই খবর সারা উপমহাদেশকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দেয়। বাঙালি নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘নাইটহুড’ উপাধি বর্জনের ঘোষণা দেন। গান্ধীজী জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও, পরে তিনি ব্যাপক  জনসমর্থন নিয়ে ‘সত্যাগ্রহ’ ও সরকারের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগ’ (১৯২০-২২) আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের চাপে সংঘটিত অপরাধ তদন্তে ‘হান্টার কমিশন’ গঠনে বাধ্য হয়। হান্টার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী জেনারেল ডায়ারকে ভর্ৎসনা করা হয় এবং সেনাবাহিনি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। স্যার উইনস্টন চার্চিলসহ ‘হাউস অব কমন্স’-এর অনেকে নিন্দা জানান। কিন্তু ‘হাউস অব লর্ডস’ ডায়ার্সের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে তার প্রশংসা করেন। তাদেরই উত্তরসূরি বেশ কজন মন্ত্রী জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের  শতবর্ষে থেরেসা মে-কে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনার অনুরোধ জানালেও থেরেসা কেবল দুঃখ প্রকাশ করেন। ক্ষমা চাননি। ব্রিটেনের মহারানি এলিজাবেথ জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন শেষে দুঃখও প্রকাশ করেননি।

বলেছিলাম এই ঘটনা উপমহাদেশের জনগণকে নাড়িয়ে দেয়। জনগণ বুঝতে পারে ব্রিটিশের শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। পাঞ্জাবের জনগণের আত্মবলিদান বৃথা যায়নি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়