ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুন্ডাদের বর্ষবরণ: সিরুয়া বিসুয়া

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুন্ডাদের বর্ষবরণ: সিরুয়া বিসুয়া

খুলনার কয়রায় মুন্ডা সম্প্রদায়ের পহেলা বৈশাখ উদযাপন

দীপংকর গৌতম : বাংলাদেশে বসবাসরত মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী মানবগোষ্ঠী বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাস করে। মুন্ডারাও আদিবাসী মান্দিদের মতো নিজেদের ‘হোরোকো’ বলে। যদিও তারা ‘মুন্ডা’ পরিচয়েই বেশি গর্ববোধ করে। মুন্ডা শব্দের অর্থ সম্মানী ও সম্পদশালী মানুষ।

মুন্ডা ও মাহাতোরা খুবই উৎসবমুখর। গবেষকগণ তাদের উৎসবকে ৫ ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন সনাতন ধর্মীয় উৎসব, সুন্দরবনভিত্তিক উৎসব, ইষ্টদেবতার পূজা উপলক্ষ্যে উৎসব, পার্বণভিত্তিক উৎসব ও লৌকিক উৎসব। পহেলা বৈশাখে তারা নিজেদের মতো করে উৎসবে মেতে ওঠে। দেশের অন্যান্য জায়গার মতো খুলনা অঞ্চলেও পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলে উপকূলীয় অঞ্চলের পহেলা বৈশাখ উদযাপনে কিছু ভিন্নতা চোখে পড়ে। লেখার শুরুতেই যেমন মুন্ডাদের কথা বলা হলো, তারা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে বলে ‘সিরুয়া বিসুয়া’। খুব ঘটা করে এ উৎসব পালন করে তারা। এ সময় সাধারণ নিত্যকাজ বন্ধ থাকে। কখনো কখনো মনে হবে এরা সমতলের অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই পহেলা বৈশাখের রীতি পালন করে। কিন্তু তা নয়। যেমন ঋতুভিত্তিক ফসলি উৎসব ছাড়াও প্রতিদিন তাদের ধর্মীয় দেবতা সিং, বোঙ্গা বা সূর্যকে পূজা করে। মুন্ডারা সূর্য দেবতার পূজায় অভ্যস্ত।


খুলনার কয়রায় মুন্ডা সম্প্রদায়ের পহেলা বৈশাখ উদযাপন

পহেলা বৈশাখে তারা সকালে স্নান করে এসে বোঙ্গা বা সূর্যপূজা দিয়ে সবাই মিলে পান্তা ভাত খায়।   দুপুরে তারা ভাতের সঙ্গে খায় বারো পদের সবজি। বারো পদের কারণ হলো, এর মধ্য দিয়ে তারা বারো মাসের সমাপ্তি বুঝায়। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে প্রণাম করে শুরু হয় চোলাই মদ পান ও নৃত্য গীত। সারারাত চলে নাচগানের আসর। বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিন বা সাকরাইনের দিনও মুন্ডা সম্প্রদায় আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। ওইদিন তারা শুদ্ধি অভিযান চালায় দলেবলে মিলে। তারা ঝেড়ে, মুছে, লেপে ঘড়-দোর পরিষ্কার করে কাদা উৎসবে মেতে ওঠে। একে অপরকে কাদায় মাখায়। এই আনন্দ তারা উৎসর্গ করে বোঙ্গা দেবতার নামে। এরপর কাদা মাটি ধুয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে তারা মূলত বৎসরের আবর্জনা দুঃখ কষ্ট ধুয়ে ফেলে নতুন জীবনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। এটা তাদের পূর্বপুরুষদের রীতি। যে যাকে কাদা মেখে দেয় সে তাকে হাড়িয়া বা নিজস্ব তৈরি মদ পরিবেশন করে। এভাবে তাকে সম্মানিত করার রেওয়াজ মুন্ডা সমাজে এখনও রয়েছে। তারা মনে করে এর মধ্য দিয়ে অন্তরের বাঁধন শক্ত হয়।

মুন্ডারা চান্দ্র মাসকে মাথায় রেখে সিরুয়া বিসুয়া উদযাপন করে। আয়োজন করে চৈতালি পূজার। এই পূজার কারণে সূর্য দেবতা রোগ-শোক থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। বোঙ্গার নামে তাই  চৈতালি পূজার আগের রাত থেকে তারা উপোস থাকে। পরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙা নিয়ম। রাতে বেল গাছের নিচে ধূপ সাজিয়ে, দীপ জ্বালিয়ে, পান-সুপারি, দুধ-কলা, ধান, দূর্বা, সিঁদুর দিয়ে সাজিয়ে  হাড়িয়ার হাঁড়ির সামনে সবাই গোল হয়ে বসে বোঙ্গাকে প্রণাম করে সমস্বরে গান গায় ও নাচে। নারীরা এ সময় তাদের মরদদের মুখে হাড়িয়া তুলে দেয়। অন্যদিকে মানতের হাঁস, পাঠা বলির মাংস, খিচুড়ি রান্না হতে থাকে। তার গন্ধ ছড়ায় চারদিকে। নাচ-গান চলতেই থাকে। জীবনের কষ্ট, বঞ্চনা, শোষণ এভাবেই ভুলে থাকে আদিবাসী মুন্ডা সমাজ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়