ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বাংলা পঞ্জিকার উৎস ও বিবর্তন

রওশন জাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা পঞ্জিকার উৎস ও বিবর্তন

|| রওশন জাহিদ ||


বাংলায় পঞ্জিকা শব্দটি বেশ প্রচলিত। তবে কেউ কেউ ‘পাঁজি’ও বলে থাকেন। অনেক সময় বড়দের মুখে শোনা যায়, যে-কোনো কাজ পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে তবেই শুরু করা উচিত। তাতে নাকি অনিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা  কম থাকে। যদিও বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে অনেকেই এসব বিষয় পাত্তা দিতে চান না, তারপরও মনের ভিতর কেমন যেন উশখুশ অবস্থা তৈরি হয়ে থাকে। বিশ্বাস এবং সংস্কারের একটি জেনেটিক কোড আসলে বাঙালির রক্তে বিচরণশীল। তাই পঞ্জিকার গুরুত্ব জেনে বা না-জেনে সকলেই বিষয়টি শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, চন্দ্রোদয় থেকে চন্দ্র ডুবে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস এবং বছরের চক্রে আবর্ত ঘূর্ণায়মান প্রতি মুহূর্তের নির্দেশকারী পুস্তিকাই আমাদের দেশে পঞ্জিকা নামে পরিচিত। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত ভারত কোষ অনুযায়ী, ‘যে পুস্তকে বৎসরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, পর্বদিন, শুভদিন ইত্যাদি থাকে তাকে পঞ্জিকা বা পঞ্জি বা পাঁজি বলে।’ লোকসংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকার সম্পাদক ড. সনৎকুমার মিত্র মনে করেন, ‘যে বই বা পুস্তক উচ্চতর গাণিতিক বিদ্যাকে নির্ভর করে সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্র সমন্বিত বিরাট আকাশম-লের মহাবিস্ময়মণ্ডিত যে সংসার তার প্রতি দণ্ড-পল-বিপলের সংবাদ দেয় তাই-ই পঞ্জিকা।’ বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ- এই পাঁচটি বিষয়ের উপর আলোকপাতকারী বই সাধারণত ‘পঞ্চাঙ্গ’ নামে পরিচিত। সংস্কৃত সাহিত্য এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এটি পঞ্চাঙ্গ নামে পরিচিত।
বাঙালি তার জীবনে কখনই ধর্ম-সংস্কারকে ছোট করে দেখেনি। বরং ভালো এবং মন্দ উভয় বিষয়ের জন্যই সে ধর্মকে বেশ আঁকড়ে ধরেছে আপন করে। তাই বার এবং তিথি থেকে কখনই বিচ্যুত হতে দেয়নি প্রয়োজনীয় কোনো যজ্ঞ অনুষ্ঠানকে। জীবন চালনা কিংবা লৌকিকতা যা-ই হোক না কেন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়েছে অদৃষ্টের কৃপা লাভ। তাই, সভ্যতার কতটা অতিক্রান্ত হলো তার চেয়ে বেশি ভাবতে হয়েছে ধর্মীয় সংস্কার এবং জীবনবোধের কথা। সময়ের গণ্ডিতে গণনা পদ্ধতিকে আবদ্ধ করার এই পদ্ধতিই বিভিন্ন সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে পঞ্জিকার রূপ ধরে।

স্মার্ত রঘুনন্দন একটি নাম। বাংলা পঞ্জিকার ইতিহাসে এই নাম চিরস্মরণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিদেশীদের আগমন ছিল এবং তা বেশ ঘনঘন হতো বললে ভুল বলা হবে না। বিদেশীরা যখন এদেশ; এমনকি বাংলায় এসেছে তখন তারা যেমন বাঙালিদের সংস্কৃতিকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছে তেমনি এদেশীয়রাও বিদেশী সংস্কৃতিকে অনেকাংশে নকল করার চেষ্টা করেছে। ফলে, সনাতন ধর্মপন্থীগণ যারা নিজেদের ধর্মের যে-কোনো ধরনের বিচ্যুতির ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন ছিলেন তাদের তাগিদই পঞ্জিকার শুরুতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ‘হিন্দু সমাজের নানাবিধ ধর্মীয় বিধিনিষেধের কঠোর নিয়ামক হিসেবে স্মার্ত রঘুনন্দনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন বিদেশি প্রভাব থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার জন্যই তিনি হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার উপর নানান নির্দেশ আরোপ করেছিলেন। কথিত এই নির্দেশ সহজে সর্বজনের কাছে পৌঁছে দেবার তাগিদেই পঞ্জিকার সূত্রপাত হয়েছিল। সুতরাং প্রাসঙ্গিকতার বিচারে স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা প্রচলনের প্রধান পথিকৃত।’ আরও পরে স্মৃতি শাস্ত্রে অভিজ্ঞ এবং সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ পঞ্জিকা সংকলনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন। অবশ্য বিভিন্ন পণ্ডিতগণ কর্তৃক পঞ্জিকার সংকলন হতে থাকায় নানা রকমফের ঘটতে থাকে যা সমাজ জীবনে বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্জিকায় প্রকাশিত পণ্ডিতগণের ভিন্ন মতের কারণে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় কাজে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের সমস্যা হওয়ার ফলে তারা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে যান এই সমস্যার সমাধানের জন্য। নবদ্বীপের এই রাজা সকল গুণী পণ্ডিত যারা গণনা ও স্মৃতি শাস্ত্রে পারদর্শী তাদের আমন্ত্রণ জানান বিষয়টির সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানের জন্য এবং তিনি পঞ্জিকা গণনার একটি সর্বমান্য নীতি তৈরি করতে সমর্থ হন। এই হিসেবে বাংলা পঞ্জিকার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে নবদ্বীপের রাজা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা অপরিসীম এবং তিনিই প্রধান পৃষ্ঠপোষকরূপে নিজেকে পরিচিত করেছেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীকালে প্রকাশিত পঞ্জিকাগুলিতে ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে’ বা ‘নবদ্বীপাধিপতির অনুমত্যানুসারে সংকলিত’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা।

সমাজ জীবনে পঞ্জিকার ব্যবহার ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট দিন ক্ষণ জানা না থাকলেও; ১১২৯ সনে (১৭২২-২৩) প্রকাশিত হাতে লেখা পুঁথির সংবাদ জেমস লঙের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। পঞ্জিকার আলোচ্য বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে ১৩৬৪ সনে (১৯৫৭-৫৮) ইন্ডিয়া মেটিওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গের ভূমিকায় তিনি বলেছেন যে, ‘১. এতে মাসের দিন-তারিখযুক্ত একটি বর্ষপঞ্জি দেওয়া থাকে, যা সাধারণ লোকের লৌকিক কার্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; ২. এতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মকৃত্যের দিন ও অনুষ্ঠানের সময়ের উল্লেখ থাকে এবং বিবাহ, উপনয়ন প্রভৃতি শুভকার্যের  দিনক্ষণ দেওয়া থাকে। এই সকল শুভদিন তিথি-নক্ষত্রাদির অন্তকালও কখনও কখনও গ্রহাবস্থানের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়ে থাকে।’ গণনা পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণে বাংলা পঞ্জিকার ক্ষেত্রে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকার পরেও এই ধরনের নানা সমস্যা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। ফলে, পঞ্জিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে দুইটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। যথা: শুদ্ধ পঞ্জিকা বা দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা এবং অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা।
খ্রিষ্টের আবির্ভাবের ১৫০০ বছর আগে সূর্যনির্ভর যে গণনা পদ্ধতির শুরু হয়েছিল তাই-ই কালের আবর্তে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। তালপাতায় বাংলা ভাষায় হাতে লেখা পুঁথিই পঞ্জিকার আদিরূপ। এক শ্রেণির লোক যারা দৈবজ্ঞ নামে পরিচিত এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাতে লেখা পুঁথির নির্দেশ মেনে খড়ি দিয়ে অঙ্ক লিখে হিসাব করতেন। তারা যোগ বিয়োগ করে দিন, তারিখ ও শুভলগ্ন বিচার করে আগতদের শুভ দিন ক্ষণের হিসাব দিতেন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কাব্য মনসা মঙ্গলে পাওয়া যায় চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যে যাওয়ার সময় নির্ণয় অথবা মেনকার সাধ ভক্ষণের শুভক্ষণ পঞ্জিকা দেখেই নির্ধারিত হয়েছিল। এমনকি ভারত বর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসও পঞ্জিকা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পরবর্তী সময়ে তালপাতার পরিবর্তে কাগজে হাতে লেখা পঞ্জিকার প্রকাশ ঘটে। হাতে লেখা পঞ্জিকার দাম ছিল তখন দুই আনা থেকে ষোল আনা অর্থাৎ একটাকা। পঞ্জিকার দাম নির্ভর করত এতে দেয়া ব্যাখ্যার পরিমাণ দেখে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত সংবাদপত্রে সেকালের কথায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের সংবাদে দেখা যায় যে, ‘এতদ্দেশে নবদ্বীপ ও মৌলা ও বারইখালি ও বাকলা ও খানাকুল ও বজরাপুর ও বালি ও গণপুর এই সকল গ্রামে প্রস্তুত হয়। ইহার মধ্যে কতক আমাদের নিকটে পৌঁছিয়াছে, সকল পঞ্জিকা আইলে আগামী বৎসরের গ্রহণাদি ছাপান যাইবেক।’ এখানে হাতে লেখা পঞ্জিকার উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এই সাল বিবেচনা করলে ছাপানো পঞ্জিকার শুরুর সময় সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। এবং জেমস লঙের দেয়া তথ্যানুযায়ী আরও কয়েকটি স্থানের নাম জানা যাচ্ছে যেখান থেকে পঞ্জিকা প্রকাশ হতো। যথা; চন্দ্রদ্বীপ, জনাই, বকসা, কৃষ্ণনগর, কোদালিয়া, দিগসা, বিষ্ণুপুর ও অন্যান্য।

ভারতবর্ষে পঞ্জিকা প্রকাশনার ইতিহাসে উনিশ শতক গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ, এই সময়েই ভারতে মুদ্রণ ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে এবং ছাপানো পঞ্জিকাও শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ উনিশ শতকেই প্রথম ছাপানো পঞ্জিকা জনতার হাতে আসে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও  বাংলা পঞ্জিকার প্রকাশ কখনই বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ ভারতবর্ষে ছাপাখানার বয়সের চেয়ে অল্প একটু কম বয়স ছাপানো পঞ্জিকার। শুধু ধর্মীয় বিরোধের কারণেই শ্রীরামপুর মিশন বাইবেলের অনুবাদ কিংবা অন্নদামঙ্গল ছাপলেও হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতির দিনক্ষণ গণনা করা এই বইটি ছাপেনি। কিন্তু সমাজের চাহিদার কারণেই ১২২৫ সনে ( ১৮১৮-১৯) শ্রীরামপুর থেকে প্রথম ছাপানো পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। ‘রামহরি নামে এক ব্যক্তি প্রাচীন পঞ্জিকার সাংকেতিক অক্ষরগুলিকে ভাষায় প্রকাশ করে ছাপিয়ে করেন প্রথম পঞ্জিকা।’ এই সংখ্যাটি কোথাও সংরক্ষিত না হলেও একই বছরে প্রকাশিত অন্য একটি পঞ্জিকার সংখ্যা সংরক্ষিত আছে যার সম্পাদক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ। তিনি কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাসিন্দা ছিলেন। প্রথম ছাপানো বাংলা পঞ্জিকা নিয়ে অন্য একটি দাবিও উত্থাপিত হতে দেখা যায়। বিশ্বকোষের বর্ণনা মতে, ‘কলকাতার স্যান্ডার্স কোম্পানি সর্বপ্রথম ছাপানো বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশ করে এবং এর সংকলক ছিলেন কুলটি-নিবাসী হলধর বিদ্যানিধি।’ জন্ম থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাড়তে থাকা চাহিদার কারণেই ছাপানো পত্রিকার ছাপার সংখ্যা বেড়েছে। জেমস লঙের বর্ণনামতে সে সময় প্রায় এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার পঞ্জিকা বিক্রি হতো আর পান তামাকের মতোই বাঙালির জীবনে পঞ্জিকার অবস্থান ছিল। নিচে সংক্ষেপে বাংলা পঞ্জিকার বিবর্তন আলোচনা করা হলো।

১২২৫ সনে (১৮১৮-১৯) রামহরি সংকলন করেন প্রথম পঞ্জিকা। এতে মোট ১৫৩ পৃষ্ঠা ছিল। এই পঞ্জিকায় একটি মাত্র ছবি ছিল যাতে দেখানো হয়েছে এক দেবী কর্তৃক রথ টানার দৃশ্য। ১২২৫ সনে (১৮১৮-১৯) প্রকাশিত আরও একটি পঞ্জিকার খোঁজ পাওয়া যায়। এটি ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। পঞ্জিকাটি ছিল সংক্ষিপ্ত এবং এতে রাশিফল ছিল না। এটির সংকলক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ। ১২২৭ সনে (১৮২০-২১) প্রকাশিত হয় একটি পঞ্জিকা। এতে প্রতি মাসের শুরুতে সংক্রান্তি ঠাকুরের ছবি ছাপানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ের সকল পঞ্জিকাতেই এই রীতি মেনে চলা হয়। ১২৩১ সনে (১৮২৪-২৫) শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত এই পঞ্জিকাটি ছিল ১৬৮ পৃষ্ঠার বিরাট ব্যাপ্তিযুক্ত এবং সময়ের বিবেচনায় অনেক বড়। বিশ্বনাথ তর্কভূষণ মহাশয়ের সম্পাদনায় একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১২৩২ সনে (১৮২৫-২৬)। এটি কলেজ পঞ্জিকা নামেও পরিচিতি পায়। কৃষ্ণনগরের রাজার নামে উৎসর্গীকৃত এই পঞ্জিকার সম্পাদক ছিলেন গঙ্গাধর এবং এর দাম ছিল এক টাকা। একই সনে নবপঞ্জিকা নামে আরও একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। প্রতিমাসের শুরুতে রাশিচক্র এবং টিকিধারী ব্রাহ্মণের আদিরূপ এখানে উপস্থিত। মুদ্রণ মানের পাশাপাশি প্রচুর তথ্য, জ্যোতিষ কথকতা, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় তথ্য এবং রাশিফলের বিস্তারিত পাওয়া যায় নতুন পঞ্জিকা নামে প্রকাশিত একটি পঞ্জিকায় যেটি ১২৪২ সনে (১৮৩৫-৩৬) প্রকাশিত হয় চন্দ্রোদয় প্রেস থেকে। দেশীয় খ্রিষ্টানদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১২৪৮ সনে (১৮৪১-৪২) ক্যালকাটা খ্রিশ্চিয়ান সোসাইটির পক্ষ থেকে। তবে এতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও প্রয়োজনীয় তথ্য ছিল। একই সময়ে চার্চ অব ইংল্যান্ড মিশনারী সোসাইটির পক্ষ থেকেও একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। পুরাতন পঞ্জিকা নামে একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় বঙ্গবাসী প্রকাশনা থেকে ১২৫১সনে (১৮৪৪-৪৫)। এই পঞ্জিকায় প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ‘১২৫৩ সনে (১৮৪৬-৪৭) শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র কর্ম্মকারের অনুমত্যানুসারে প্রকাশিত হয় নতুন পঞ্জিকা। এই সংখ্যায় ডাকমাশুল শিরোনামে পরিবেশিত তথ্য থেকে বাঁকি নামক এক বিকল্প মাধ্যমের খবর পাওয়া যায়।’ নানা রকম অলঙ্করণ আর ছবির মাধ্যমে প্রথম বাংলা চিত্রিত পত্রিকা পাওয়া যায় কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের হাত ধরে। এটি নতুন ধরনের পঞ্জিকা। এবং এটির কাঠখোদাই হস্তশিল্প নকল করে স্যান্ডার্স কোম্পানি পরে প্রকাশিত পঞ্জিকায় ব্যবহার করেছিল। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৬১ সনে (১৮৫৪-৫৫)। ৩০৪ পৃষ্ঠার এই পঞ্জিকা অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেক তথ্য দিয়ে ১২৬২ এবং ৬৩ সনে (১৮৫৬-৫৭) বঙ্গ ভাষানুবাদক সমাজ নামে পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। বিপুল পরিমাণ তথ্যের কারণে এটি অন্যান্য পঞ্জিকার চেয়ে আলাদাভাবে পরিচিতি পায়। ১২৬৩ সনে (১৮৫৬-৫৭) নূতন পঞ্জিকা নামে একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। নবদ্বীপের মহারাজা ছিলেন এই পঞ্জিকার পৃষ্ঠপোষক। একই নামে ১২৬৫ এবং ১২৬৬ সনে (১৮৫৯-৬০) শ্রী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য্য কর্তৃক ভাষাকৃত একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। এরপর ১২৭০ এবং ৭৪ সনে (১৮৬৭-৬৮) প্রকাশিত হয় ঐ একই পঞ্জিকা। ১২৭৬ সনে (১৮৬৯-৭০) দুর্গাচরণ গুপ্ত প্রকাশ করেন গুপ্তপ্রেস ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা। এই ডাইরেক্টরি ধারণা আজও চলমান। ১২৭৮ সনে (১৮৭১-৭২) শ্রী আনন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত নবপঞ্জিকা ও প্রদর্শিকা প্রকাশিত হয়। ১২৮৫ সনে ( ১৮৭৮-৭৯) প্রকাশিত হয় গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা। ১২৮৭ এবং ১২৮৯ সনে (১৮৮২-৮৩) যথাক্রমে নতুন ভিক্টোরিয়া পঞ্জিকা এবং বৃহৎ ডাইরেক্টরি ও কলেজ পঞ্জিকা এবং বৃহৎ ডাইরেক্টরি প্রকাশিত হয়। পি. এম. বাক্চীর ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১২৯০ সনে ( ১৮৮৩-৮৪)। ডাইরেক্টরি রচনার এই ধারা আজও চলমান। ১২৯০ এবং ৯৬ সনে (১৮৮৯-৯০) দে এন্ড ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত হয় পঞ্জিকা। এরপরে ১২৯৭ সনে (১৮৯০-৯১) বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার শুরু হয়। অন্যান্য পঞ্জিকা প্রকাশের পাশাপাশি  ১৩০৩ সনে (১৮৯৬-৯৭) নতুন শ্রীরামপুর পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। একই সনে মুসলমানদের জন্য বৃহৎ মহম্মদীয় পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। প্রথম বছর মোট পাঁচ হাজার কপি প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৮৪। এরপর একই ধরনের মদীনা পঞ্জিকা নামে আরও পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ১৩০৬ সনে (১৮৯৯-১৯০০) প্রকাশিত হয় বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানির বিশুদ্ধ পঞ্জিকা। ১৩০৭ সনে ( ১৯০০-০১) ঢাকার লাল মোহন সাহা প্রকাশ করেন সারস্বত পঞ্জিকা। ১৩২৫ সনে (১৯১৮-১৯) প্রকাশিত হয় পূর্ণচন্দ্র ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। ১৩২৬ সনে প্রকাশিত হয় কেশরঞ্জন পঞ্জিকা। ১৩২৭ সনে (১৯২০-২১) প্রকাশিত হয় নববিভাকর পঞ্জিকা ও ডাইরেক্টরি। ১৩২৯ সনে (১৯২২-২৩) বরিশাল পঞ্জিকা নামে একটি বিশুদ্ধ পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। ছোট আকারে নতুন পকেট পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১৩৪৮ সনে (১৯৪১-৪২)। বৃহৎ সোলেমানী পঞ্জিকা নামে  একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১৩৫২ সনে (১৯৪৫-৪৬)। পঞ্জিকা প্রকাশের ধারা অব্যাহত থাকে। এরই মধ্যে নতুন ধারার নবগ্রহ পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় ১৩৬০ সনে (১৯৫৩-৫৪)। একই সনে পাকিস্তান পকেট পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন কমরুদ্দীন আহমেদ। ১৩৬৫ সনে (১৯৫৮-৫৯) প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণ পকেট পঞ্জিকা। ১৪১৪ সনে (২০০৭-০৮) প্রকাশিত শ্রীমদন ফুল পঞ্জিকা বা  বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় গ্রাম ও নগর জীবনের বিভিন্ন চাহিদার বিষয় মাথায় রেখে বিস্তারিত বিষয়ের উপস্থাপনা করা হয়েছে।

প্রতি বছরই নতুন নতুন পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং সংকলক ও প্রকাশকগণ চেষ্টা করেছেন পাঠকদের নতুন কিছু তথ্য উপহার দিতে। ফলে বিষয়ের ক্ষেত্রে যেমন পঞ্জিকা বিস্তার লাভ করেছে তেমনি এর আকারও বেড়েছে। এমনকি সে সময়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রির তালিকায় ছিল পঞ্জিকা। কারণ পঞ্জিকা ছাড়া বাঙালির গৃহকর্ম থেকে শুরু করে ধর্মকর্ম কোনো কিছুই হতো না। পঞ্জিকা প্রকাশের ধারাতে রাজা-রানিসহ অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। এবং তা ভালোই হয়েছে বলা যায় কারণ এর সাহায্যে অনেক বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হয়েছে।  মোটের উপর, বাংলা পঞ্জিকা শুরু যেমন একদিনে হয়নি এর বিবর্তন হতেও অনেক সময় লেগেছে। বিষয়টি আগ্রহী পাঠকমাত্রেই ব্যাপক অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি করে থাকে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়