ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নোনা জলে ভেসে যায় ঈদের আনন্দ

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৬ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নোনা জলে ভেসে যায় ঈদের আনন্দ

জুনাইদ আল হাবিব: প্রতি বছর ঈদ আসে। ঈদ আনন্দের বন্যায় ভাসে এই জনপদ। কিন্তু সবাই কি সেই আনন্দে সমানভাবে সামিল হতে পারেন? নিশ্চিতভাবেই এর উত্তর হলো ‘না’। কিছু মানুষ আছেন যাদের কাছে ঈদ আসে দ্বিগুণ কষ্ট নিয়ে। দারিদ্র্যই এর অন্যতম কারণ বলা যায়। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনে ঈদ আসে নিরানন্দে।

ছোট ছোট কুড়েঘর এখনও যে দেশে টিকে আছে তা লক্ষ্মীপুরের দ্বীপ রমণীমোহনে না গেলে বোঝা যাবে না। শুধু ঘর নয়, মাচা বানিয়ে মাচার ওপর তাদের ঘুমাতে হয়। জীবন ধারণের জন্য যে প্রয়োজনীয় উপাদান বিশুদ্ধ পানি, সে পানিও নেই দ্বীপটিতে। অথচ দ্বীপে বাস করছেন পাঁচ ছয়শ মানুষ। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি, চিকিৎসার জন্য নেই কোনো হাসপাতাল, নেই সবুজ গাছপালা, এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে নেই আশ্রয় কেন্দ্র। এখানে বসবাসরত মানুষের বেশিরভাগ মুসলমান হলেও নেই কোনো মসজিদ, নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে এভাবেই মানবেতর জীবন যাপন করা ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। তবুও তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। কারণ, এখানে বসবাসরত মানুষগুলো সবাই কোনো না কোনো স্থান থেকে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বসতি গড়েছেন। এমন কষ্টে বারো মাস বাস করছেন যারা তাদের কাছে ঈদ কীভাবে আসে?

এই অঞ্চলের অনেক মানুষের ঘরে ঈদের দিন সেমাই রান্না হয় না। সন্তানের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা তাদের জন্য খুব কষ্টসাধ্য। মূল ভূ-খণ্ডে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সহযোগিতা এলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেগুলো পৌঁছায় না। তারপরও ঈদ আসে। যতটুকু সাধ্য ততটুকু দিয়েই পরিবার পরিজন নিয়ে তারা ঈদের দিন কাটিয়ে দেন। প্রয়োজনে ধার করে হলেও ঘরের সদাইপাতি কিনে প্রিয়জনের মুখে চেষ্টা করেন হাসি ফোটাতে।
 


দ্বীপের বাসিন্দা বাসু মাঝি (৬৫)। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘কি আর করবো, কোথাও তো থাকার জায়গা নেই। বেঁচে থাকতে তো হবে। আমাদের কষ্টে জীবন পার করতে হবে, এটা আমাদের কপালে আছে। কিছু করার নেই। এই যে একটা ঈদ যায়, ছেলেমেয়েদের জন্য তেমন কিছু কিনতে পারিনি। এটাও তো আমাদের দুঃখ। কে বুঝবে আমাদের দুঃখ?’

দ্বীপের আরেক বাসিন্দা রহিমা বেগম (৩৭)। চার সন্তানের জননী। তার গল্পটাও এর ব্যতিক্রম নয়। কোনো দিক থেকে যদি কিছু সহযোগিতা পান, তাহলে ছেলেমেয়েদের ঈদ কষ্ট দূর করতে পারবেন। সে প্রত্যাশায় দিন গুনতে হয় তাকে। স্বামীর সংসারে থেকেও তেমন ভালো দিন যায় না রহিমার। কারণ, যেখানে আয়ের খাতা শূন্য, সেখানে ব্যায়ের বিষয়টা মাথায় আনা বোকামি।
 


দ্বীপের এ মানুষগুলোর কষ্টের চিত্র তুলে ধরে লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তথ্যকোষ নিয়ে রচিত ‘লক্ষ্মীপুর ডায়েরি’র লেখক সানা উল্লাহ সানু বলেন, ‘আসলে আমি এখানে মানুষ নামের কিছু প্রাণীর বসবাস দেখছি। যাদের জীবন একদম যাযাবর প্রকৃতির। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় যে উপাদান- বিশুদ্ধ পানি, সেখানে তা নেই। তাহলে বুঝতে হবে আসলে সেখানে মানুষ খুব কষ্টে আছেন।’

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ও দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মাহবুবে এলাহি সানি বলেন, ‘দ্বীপের জীবনযাপন দেখে আমরা বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। আসলে এখানে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে, তা তারা এবং সৃ্ষ্টিকর্তা ভালো জানেন। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য দ্বীপের পরিবেশ উপযুক্ত নয়। এ দ্বীপে কোনো এনজিও কাজ করে না, ফলে তাদের জীবন মান উন্নয়নের চেষ্টা চোখে পড়ে না। এমন অবস্থায় সেখানে ঈদের আনন্দ মাটি হবারই কথা। দ্বীপের পরিবেশ স্বাভাবিক করতে প্রয়োজন সরকারি এবং বেসরকারি নানান উদ্যোগ। তাহলে মানুষগুলো অন্য জনপদের মানুষের মতো ঈদ করতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ নিয়ে।’





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুন ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়