ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এক পরিবারে তিন ব্যারিস্টার

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ২৩ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক পরিবারে তিন ব্যারিস্টার

বাবার সঙ্গে মেয়ে রাশনা ইমাম ও ছেলে রেশাদ ইমাম

মেহেদী হাসান ডালিম : ব্যারিস্টার আখতার ইমাম। সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রথিতযশা আইনজীবী। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নিরবে কাজ করে যেতেই ভালবাসেন। নিজে আইন পেশার লোক হয়ে বিয়ে করেছেন ১৯৮০’র দশকের জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী প্রিসিলা পারভীনকে।

আখতার ইমাম দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে রাশনা ইমাম ও ছেলে রেশাদ ইমাম। বাবাকে অনুসরণ করে দুজনই বার অ্যাট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

রাশনা ইমাম লন্ডনের লিংকনের অধীনে সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে অক্সেফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে আরো উচ্চতর ডিগ্রি বিসিএল অর্জন করেন। চাকরি নেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ল’ ফার্ম ব্রেকার এন্ড মেকাঞ্জির লন্ডন অফিসে। কিন্তু সেখানে তার মন টেকেনি। এই দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া করে কিছু দিন পর চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। বিদেশে অর্জন করা অভিজ্ঞতা দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে চান। আইনের জগতে অবদান রাখতে চান।

অপরদিকে রেশাদ ইমামও লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপর দেশে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।



নিজস্ব চেম্বারে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম


এখন সর্বোচ্চ আদালতে বিভিন্ন মামলায় একসঙ্গে লড়ছেন বাবা, মেয়ে ও ছেলে- এই তিন ব্যারিস্টার। এই প্রথম একসঙ্গে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন তারা। তাদের সাক্ষাৎকারের দুই পর্বের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

রাইজিংবিডি: ব্যারিস্টার বাবার সঙ্গে অভিনয় শিল্পী মায়ের বিয়ে …
রাশনা ইমাম-রেশাদ ইমাম:
বাবা-মায়ের বিয়ে পুরোপুরি এরেঞ্জড। বাবাকে অনেক মেয়ে দেখানো হয়েছিলো। তখন উনি ইয়াং ব্যারিস্টার। একদিন মাকে টিভিতে দেখলেন। তখন মায়ের জনপ্রিয়তা টপে ছিল। বাবা বললেন, ওকেই আমি বিয়ে করবো, যে ভাবেই হোক না কেন। সে সময় আমার বড় খালার আবার বিয়ে হয়নি। যখন প্রস্তাবটা পাঠানো হল তখন নানার বাড়ি থেকে বলা হল এখন তো বিয়ে দেওয়া হবে না। আগে বড় বোনের বিয়ে হোক তারপর দেখা যাবে। বাবা অপেক্ষা করতে থাকলেন। বড় খালার বিয়ে হয়ে যাওয়ার এক বছর পর আবার প্রস্তাব পাঠালেন। তখন তো না বলার কারণ ছিল না। এত ব্রাইট ও গুড লুকিং ইয়াং ব্যারিস্টার। ১৯৭৭ সালে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর বাবা-মা লন্ডনে চলে গেলেন। ওখানেই ছিলেন। বিয়ের আগে ১০ বছর, বিয়ের পর ২/৩ বছর, টোটাল ১২/১৩ বছর বাবা লন্ডনে প্র্যাকটিস করেছেন। মায়ের অভিনয় করা নাটকের মধ্যে ছাড়পত্র, মারিয়া আমার মারিয়া, বোধদয়, সে সময় সাংঘাতিক ফেমাস হয়েছিল।

রাইজিংবিডি: শৈশব, কৈশোর ও পড়ালেখা …
রাশনা ইমাম: ছোটবেলা কেটেছে ঢাকায়। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় জন্ম। আমার স্কুল ছিলো ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ওখান থেকে ও লেভেল, এ লেভেল শেষ করে ২০০০ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডে চলে যাই। ইউনিভার্সিটি অব বাকিংহামে এলএলবি করেছি। এটা ইংল্যান্ডের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটার ফাউন্ডার ছিলেন লর্ড ডেনিং। উনি খুব ফেমাস ইংলিশ জজ। আমাদের দেশের বিশেষ করে আমার বাবার জেনারেশনের সবাই লর্ড ডেনিংয়ের ফ্যান। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারসহ অনেক নামীদামি ব্যক্তি এটা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ছিলেন। বাকিংহামে এটা ছিল দুই বছরের ডিগ্রি। নরমালি এলএলবি তিন বছরের বা চার বছরের হয়। এটা খুব টাফ একটা কোর্স ছিল। কোন ছুটি ছিল না। বিরতিহীন ক্লাস চলতো। বিরতিহীন ক্লাস চলার কারণে দুই বছরে এলএলবি কমপ্লিট করি।

দুই জনেরই রেজাল্ট ভাল ছিল, দুজনই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। তবে তা ভিন্ন সময়ে। আর এই বাকিংহামে এলএলবি কমপ্লিট করার পেছনে পুরোটাই বাবার হাত ছিল। উনি চাচ্ছিলেন খুব টাফ প্রেসারে ঢুকিয়ে দিতে। কোন দিকে যাওয়ার সুযোগ দিতে চাচ্ছিলেন না। উনি প্রেসারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন, পেরে যাবে, চেষ্টা করতে থাকো। বাবা চাচ্ছিলেন দ্রুত শেষ করে এসে যেন বাবার পেশার হাল ধরতে পারি।

 

ব্যারিস্টার রাশনা ইমামের সঙ্গে কথা বলছেন রাইজিংবিডির প্রতিবেদক


২০০১ সালের ডিসেম্বরে আমার এলএলবি শেষ হয়ে যায়। তারপর ২০০২ সালে ৯ মাসের একটা এলএলএম (মাস্টার্স অব ল’) কোর্স ওখানেই করি।

এলএলএম শেষ করার পর সে বছরের সেপ্টেম্বরেই লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করি। লিংকন জেনের মেম্বার হয়ে সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করি।

২০০৩ সালে বার অ্যাট ল পড়া শেষ করে বাংলাদেশে চলে আসি। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাবার সঙ্গে প্র্যাকটিস করি। ২০০৬ সালের শেষে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে আবার লন্ডনে চলে যাই। এটা খুব কমপিটেটিভ ও টাফ একটা ডিগ্রি। এটার নাম বিসিএল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১ বছর পড়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে এই ডিগ্রি অর্জন করি। এই ডিগ্রি বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেনসহ হাতে গোনা কয়েকজনের আছে। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন মেয়ের এই ডিগ্রি নেই। ২০০৭ সালে বিসিএল ডিগ্রি সম্পন্ন হয়। তারপর লন্ডনে বিশ্বের অন্যতম নামকরা ল’ ফার্ম ব্রেকার এন্ড মেকাঞ্জির লন্ডন অফিসে এক বছরের মত চাকরি করি। এখানে আমার স্পেশালাইজেশন ছিল করপোরেট ল।

রেশাদ ইমাম: জন্ম ১৯৮৩ সালে ঢাকায়। সানবিম স্কুলে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়ে চলে যাই ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ওখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ি। তারপর চলে যাই মাস্টারমাইন্ড স্কুলে। মাস্টারমাইন্ড থেকে ও লেভেল, এ লেভেল সম্পন্ন করি। ২০০৩ সালে এলএলবি করতে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বাকিংহামে চলে যাই। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে এলএলবিতে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন হয়ে যায়। ২০০৬ সালের শেষের দিকে লিংকন জেনের মেম্বার হয়ে বিপিপি থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করি। ২০০৭ সালে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে মাস্টার্স করতে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে চলে যাই। ২০০৮ সালে কেমব্রিজ থেকে এলএলএম সম্পন্ন করি। তারপর আমি তিন মাসের জন্য ইন্ডিয়া চলে যাই। সেখানে একটি ইন্টার্নশিপ করেছি নামিদামি একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেটের আন্ডারে। উনার নাম ড. আভিশেক সিংভী। যিনি কংগ্রেসের মুখপাত্র ছিলেন। তিনি বর্তমানে ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টের মেম্বার। তার ছেলে আনুভব সিংভী আমার বন্ধু। ইন্ডিয়ায় তিন মাস থাকার পর দেশে চলে আসি।

 

নিজস্ব চেম্বারে ব্যারিস্টার রেশাদ ইমাম


২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে বাবার সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিসে আছি। ২০১০ সালে হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট হয়।

রাইজিংবিডি: যে কারণে আইনপেশায় …
রাশনা ইমাম-রেশাদ ইমাম: বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তবে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়েছি। বাবার পক্ষ থেকে কোন চাপ ছিল না। এই পেশার প্রতি যে শ্রদ্ধা তা পুরোপুরি বাবার কাছ থেকে এসেছে। আইন পেশা মানেই এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। এটা বাবার কাছ থেকে শিখেছি।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, আমার মনে হয় এটা ঠিক, এটা ঠিক না। এখন তুমি চিন্তা করে দেখ কি করবে। আরেকটি কথা, বাবা কখনও কোন ব্যাপারে ছেলে-মেয়েকে ভিন্ন চোখে দেখেননি। অনেক ফ্যামিলিতে মেয়েকে বেশি সুযোগ না দিয়ে ছেলেকে দিয়ে থাকে কিন্তু বাবা কখনও এটা করেননি।

রাইজিংবিডি: বাবাকে মূল্যায়ন …
রাশনা ইমাম-রেশাদ ইমাম: বাবা খুব লিবারেল অ্যান্ড মডার্ন। উনি একদম লো প্রোফাইল মেইনটেইন করেন। বাবা পুরোপুরি প্রচার বিমুখ। উনি খুব কম মামলা নেবেন কিন্তু যেটা নেবেন সেটা সেন্ট পারসেন্ট অ্যাটেনশন ও আন্তরিকতার সঙ্গে নেবেন। এটা কিন্তু অনেক সিনিয়র আইনজীবী করেন না। তারা নিয়ে নিচ্ছেন মামলা কিন্তু সময় দিচ্ছেন না। বাবা বলেন, আমি যদি মামলা নিয়ে থাকি তাহলে সেটার পেছনে হানড্রেড পারসেন্ট সময় দেব। এর আগে অন্য কোন মামলা নেব না। এটা অবভিয়াসলি আমাদের খুবই ইনফ্লুয়েন্স করেছে। আমরা এটাতেই বিশ্বাসী। উনি কোর্টে যে প্রিপারেশন নিয়ে যান, এই প্রিপারেশন নিয়ে অনেক আইনজীবীই যান না। যদিও অনেকে আছেন যারা মনে করেন, আমি সিনিয়র আমার চেহারা বিক্রি করলেই হয়ে যাবে। বাবা এটাতে বিশ্বাসী না। তিনি বলেন যে, আমি সিনিয়র বলেই আমার প্রতি এক্সপেকটেশনটা বেশি থাকবে। এগুলো বাবার কাছ থেকে শিখেছি। তাই বাবাকে দেখে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত হই, অনুপ্রাণিত হই।

 

ব্যারিস্টার রেশাদ ইমামের সঙ্গে কথা বলছেন রাইজিংবিডির প্রতিবেদক


বাবা সবসময় একটা কথা বলেন, ‘দিস ইজ নট এ প্রফেশন, ইট ইজ এ ওয়ে অব লাইফ। এটাকে নাইন টু ফাইভ জব ভাবলে চলবে না।’

আমরা অনেক চেয়েছিলাম বাবা রাজনীতিতে আসুক। অনেক জায়গা থেকেই উনাকে রাজনীতিতে আসার কথা বলা হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও কিন্তু কখনও আনতে পারেনি। কিন্তু এখন আমরা বাবার এই সিদ্ধান্তকে রেসপেক্ট করি। হয়তো রাজনীতিতে না আসার কারণেই সব মহলে বাবার প্রতি রেসপেক্ট আছে।

রাইজিংবিডি: বাবার সাথে যেখানে মিল খুঁজে পান …।
রাশনা ইমাম: ডালিম সাহেব, আমি আপনাকে একটা কথা বলি, আমাদের তিনজন, বাবা আমি আর রেশাদ, আমরা কিন্তু পুরোপুরি ডিফারেন্ট প্রান্ত থেকে এসেছি। মানুষ হিসেবে আমরা কেউ কারো মত না। একেবারে আলাদা। ও একদম আলাদা, আমি একদম আলাদা, বাবা পুরোপুরি আলাদা। তাই অনেক বিষয়ে ভিন্ন মত হতেই থাকে। কিন্তু কিছু কমন জিনিস আছে যেটার জন্য আমরা একসঙ্গে থাকতে পারছি, কাজ করতে পারছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ডেডিগেশন। কম কাজ নেবে কিন্তু সিনসিয়ারলি কাজটা করবে। আজকে যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি তা হলো, চেম্বারে ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে নতুন যে ছেলে মেয়েরা আসছে এরা সব শর্টকাট খুজছে। কিন্তু আমরা অনেক কাঠ-কয়লা পুড়িয়েছি। বাবা ছিলেন প্রফেশনে। এইজন্য কিছুটা সুবিধা পেয়েছি কিন্তু আমাদের পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমাদের বাবা ছিলেন, আর এ কারণেই আমাদের উপর প্রেশার অনেক বেশি ছিল। কোর্টে সবাই আমাদের চেনেন। আর চেনেন মানেই কোর্টে দাঁড়িয়ে যখন আমি একটা মেনশন করতে যাবো সবাই জানছেন কে মেনশন করছে, সবাই তাকিয়ে আছেন। সবাই আমাদের নোটিশ করছেন। শেখার সময় নোটিশ না করাই ভাল। বাবা না থাকলে আমাদের এই প্রেশারটা থাকতো না।

(চলবে …)।

লন্ডনে কাটানো দিন, ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতিতে আসা নিয়ে চিন্তাভাবনা, কোর্টে প্রথম দিনের সাবমিশনের স্মৃতিসহ নানা বিষয় থাকছে আগামী পর্বে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুলাই ২০১৭/মেহেদী/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়