ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মস্তিষ্কের সুস্থতায় যা করবেন

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মস্তিষ্কের সুস্থতায় যা করবেন

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : শরীরকে সুস্থ রাখতে আপনি প্রতিদিন অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যেমন- পানিশূন্যতা এড়াতে পানি পান করেন, সুষম খাবার খান, শরীরচর্চা করেন, দাঁত ব্রাশ করেন, প্রেসক্রিপশনের ওষুধ খান, পর্যাপ্ত ঘুমান ও অন্যান্য। এসব ছোট কাজ একত্রে বড় ফল দেয়, যার ফলে আপনি সুস্থ থাকতে পারেন ও দীর্ঘায়ু পেতে পারেন। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসগুলোও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। ডালাসে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অন্তর্গত সেন্টার ফর ব্রেইন হেলথের ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেসের প্রধান জেনিফার জিয়েন্টজ বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন যা করি তা আমাদের মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে। আপনি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও ডায়েট অনুসরণের মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি অটুট রাখতে পারেন, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেন এবং বিষণ্নতাকে দূরে রাখতে পারেন।’ মস্তিষ্কের উন্নয়নে ২০ পরামর্শ নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

* মাল্টিটাস্ক থেকে বিরত থাকুন
একই সময়ে একাধিক কাজ বা মাল্টিটাস্কে ভালো ফল পাওয়া যায় না এবং এটি মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি আপনি টিভি দেখার সময় নোট লিখেন ও অনলাইনে প্রতিবেদন পড়েন, তাহলে আপনার এ ধরনের অভ্যাস থেকে বিরত থাকার সময় হয়েছে। লোকজন মাল্টিটাস্কের ক্ষেত্রে কম কার্যকর- আপনার মস্তিষ্ক একটা সময়ে শুধুমাত্র একটা কাজই করতে পারে, বলেন ডা. জিয়েন্টজ। তিনি যোগ করেন, ‘যখন আপনি মাল্টিটাস্ক করেন, তখন মস্তিষ্ক এত বেশি অশান্ত হয় যে মস্তিষ্কের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে। করটিসলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং হরমোনের এ অত্যধিক মাত্রা স্নায়ুকোষের কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করতে পারে। এছাড়া মাল্টিটাস্কের ক্ষেত্রে আপনি কোনো কাজই সম্পূর্ণরূপে বা মনের মতো করে করতে পারেন না। কিন্তু সুখে থাকার জন্য মনের সন্তুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কাজ ভালোভাবে করতে পারলে মনে সন্তুষ্টি আসে, যা সুখানুভব হরমোন ডোপামিন নিঃসরণে ভূমিকা রাখে।’ ডোপামিন হলো একটি নিউরোট্রান্সমিটার যা সুখানুভূতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ডা. জিয়েন্টজ আরো বলেন, ‘মাল্টিটাস্ক মস্তিষ্কের স্মৃতি ও জ্ঞানার্জন কেন্দ্র হিপোক্যাম্পাসকে সংকুচিত করে ফেলে।’

* গেমস খেলুন
কিছু গেমস প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু-কিশোরদেরকে মেন্টাল বুস্ট দেয়। যেসব গেমার ফিজিকস-বেসড পাজল গেম ‘কাট দ্য রোপ’ খেলেছিল তাদের মনোযোগ, কাজ শুরু করার দক্ষতা ও নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা তাদের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছিল যারা অন্যান্য ধরনের ভিডিও গেমস খেলেছিল, সিঙ্গাপুরে অবস্থিত নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অনুসারে। গবেষকরা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কমপ্লেক্স ব্রেইন-টিজার বা জটিল ধাঁধাঁর গেমস খেলতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

* স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখুন
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানোর পদক্ষেপ নিন, যেমন- প্রতিদিন বাড়ির আশপাশে হাঁটা, প্রতিসপ্তাহে শরীর ম্যাসাজ, মেডিটেশন, প্রার্থনা অথবা বই-ম্যাগাজিন পড়া। দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস করটিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে, যা মস্তিষ্কের স্মৃতি কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে, ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার গবেষণা অনুসারে।

* চিনি কমিয়ে ফেলুন
চিনি ও অন্যান্য সরল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার আপনার মস্তিষ্ককে নিঃশেষ করতে পারে, চ্যারিটে ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষণা অনুসারে। গবেষকরা পেয়েছেন যে, নিম্নমাত্রার রক্ত শর্করার লোকদের স্মৃতিশক্তি তুলনামূলক ভালো ছিল- এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে শব্দের অর্থ মুখস্ত করানোর ৩০ মিনিট পর স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করা হয়।

* পর্যাপ্ত ঘুমান
অনেক গবেষণায় স্মৃতি ও ঘুমের মধ্যে যোগসূত্র পাওয়া গেছে, কিন্তু নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড পেকিং ইউনিভার্সিটি শেনজেন গ্রাজুয়েট স্কুলের একটি গবেষণায় এর ব্যাখ্যা জানা গেছে। ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায় যে ধীর তরঙ্গের ঘুমের সময় মস্তিষ্কে দিনের ক্রিয়াগুলো পুনরায় প্রদর্শিত হয়, যা ঘটনাগুলোকে স্মৃতি হিসেবে ধারণ করতে সাহায্য করে। এ গবেষণা বলছে যে, ঘুম ছাড়া নতুন স্মৃতি গঠন কঠিন। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনের একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, রাতে যেসব লোকের ঘনঘন ঘুম ভেঙ্গেছিল তাদের মস্তিষ্কে অ্যামাইলয়েড প্লেক গঠনের সম্ভাবনা তাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি ছিল যারা রাতে আরামে ঘুমাতে পেরেছিল। অ্যামাইলয়েড প্লেক হলো অ্যালঝেইমারস রোগের একটি বৈশিষ্ট্য। বিঘ্নিত ঘুম ডিমেনশিয়া সৃষ্টি করে নাকি অ্যালঝেইমারসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘুমের প্যাটার্নে পরিবর্তন আনে তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

* ব্যথানাশের জন্য ইবুপ্রোফেন সেবন করুন
ইংল্যান্ডে অবস্থিত নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটির একটি প্রাণী গবেষণা সাজেস্ট করছে যে, ইবুপ্রোফেন প্রদাহ হ্রাস করে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। এ গবেষণায় দেখা গেছে, জিনগতভাবে প্রদাহপ্রবণ ইঁদুরগুলো অন্যান্য ইঁদুরের তুলনায় দ্বিগুণ দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছেছিল। তাদের হার্টের সমস্যা, ধূসর লোম, ওজন হ্রাস ও পায়ের ভারসাম্যহীনতা তুলনামূলক বেশি ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তাদেরকে ইবুপ্রোফেন সরবরাহ করার পর আবিষ্কার করেন যে, অকাল বার্ধক্য থেমে গেছে। এ গবেষণা আমাদেরকে ধারণা দিচ্ছে যে, প্রদাহে বার্ধক্য দ্রুত আসে। প্রদাহ ছিল না এমন ইঁদুরের মধ্যে ইবুপ্রোফেনের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন যে, এ ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে।

* ব্যায়াম করুন
দ্য জার্নাল অব এজিং রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারী একটি গ্রুপের নারীদের হালকা কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট (স্মরণ-নতুন কিছু শেখা-মনোযোগ দেওয়া-সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসামর্থ্যতা সংক্রান্ত সমস্যা, যা দৈনন্দিন কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে) ছিল, কিন্তু হাঁটা অথবা ভারোত্তোলনের ছয় মাস পর তাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। হাঁটা ও ভারোত্তোলন উভয়েই স্পেশিয়াল মেমোরি (কোথায় কি আছে সংক্রান্ত স্মৃতি) বৃদ্ধি করেছিল। অন্যদিকে যারা শুধুমাত্র হেঁটেছিল তাদের ভার্বাল মেমোরি (দৈনন্দিন কার্যসাধনের জন্য প্রয়োজনীয় স্মৃতি) বৃদ্ধি পেয়েছিল। অতএব বোঝা গেল যে, বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম বিভিন্ন ধরনের উপকার করে, তাই আপনার ব্যায়াম রুটিনে এন্ডিউরেন্স ট্রেইনিং ও ওয়েট ট্রেইনিং উভয়টাই রাখুন।

* বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখুন
বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। আপনি কি এক বা একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানেন? তাহলে যে যন্ত্র বাজাতে পারেন না তা বাজানো শিখতে পারেন। আপনি কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে না পারলে বাজানো শেখার জন্য যেকোনোটি একটি যন্ত্র বেছে নিন (যেমন- গিটার বা বেহালা বা ট্রম্বোন বা পিয়ানো বা হারমোনিয়াম)। জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখলে মস্তিষ্ক তরঙ্গ এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যা শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি করে। মস্তিষ্ক কার্যক্রমের এ পরিবর্তন আপনার শোনার দক্ষতা পুনরুদ্ধার এবং বার্ধক্যজনিত মস্তিষ্কের ক্ষয় হ্রাসে সাহায্য করতে পারে।

* নাচুন
সম্প্রতি জার্নাল অব দ্য আমেরিকান জিরিয়াট্রি সোসাইটিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, যেসব লোক নাচের মতো মনোযোগ দিতে হয় এমন শারীরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল তাদের কগনিটিভ ফাংশন বা স্মৃতি ও জ্ঞানার্জন সংক্রান্ত কার্যক্রম তাদের তুলনায় উন্নত ছিল যারা এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নেননি। গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, এমনকি প্রতিসপ্তাহে এক ঘণ্টার নাচও সেসব লোকের মস্তিষ্ক উন্নত করেছিল যাদের ইতোমধ্যে স্মৃতি সমস্যা ছিল।

* যোগব্যায়াম করুন
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের স্নায়ুবিজ্ঞানীদের একটি দলের মতে, যোগব্যায়াম কেবলমাত্র মানসিক প্রশান্তিই দেয় না, এটি মস্তিষ্কেরও উপকার করে। তারা আবিষ্কার করেছেন যে, যেসব লোক তিন মাস ধরে কুন্ডলিনি যোগব্যায়াম ও ধ্যান করেছিল তাদের কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট, অ্যালঝেইমারস রোগ ও অন্যান্য ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, প্রচলিত স্মৃতি বর্ধক অনুশীলনের চেয়ে যোগব্যায়াম অনেক বেশি কার্যকর।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

পড়ুন : *




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়