ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জিএসপি নিয়ে নতুন শঙ্কা, প্রয়োজন রাজনৈতিক তৎপরতা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৮, ৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জিএসপি নিয়ে নতুন শঙ্কা, প্রয়োজন রাজনৈতিক তৎপরতা

হাসান মাহামুদ :  যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে তার আজ চার বছর হতে চললো। তৈরি পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা স্থগিত করে বলে জানিয়েছিল। তখন বলা হয়, পোশাক শিল্প খাতে কাজের পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।

কিন্তু এরপর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। তাতে ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়টি পরিষ্কার ভাবেই এসেছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন কাঠামো বাড়ানো হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা নিয়েও কাজ হয়েছে। কারখানা সংস্কার হয়েছে। অবকাঠামোগত, স্বাস্থ্যঝুঁকিগত বিভিন্ন বিষয় সমাধান করা হয়েছে। জিএসপি পুনর্বহালে রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ইউএসটিআর-এ পাঠানো হয় জিএসপি রিভিউ-এর জন্য। শুনানির আগেই যুক্তরাষ্ট্র ২০০ পরিদর্শক নিয়োগের শর্ত দিয়েছিল। নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কারখানা পরিদর্শক ও ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাহিদামফিক পরিদর্শকও নিয়োগ দেওয়া হয়। ‍কিন্তু কাঙ্খিত জিএসপি এখনো সোনার হরিণ হয়ে আছে। 

এক্ষেত্রে বেশকিছু কারণ বা প্রভাবককে দায়ী করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। কেউ বলছেন, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা রয়েছে। কেউ বলছিলেন, ওবামা প্রশাসন তথা হিলারি ক্লিনটন দিচ্ছে না। এখন বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করে দিচ্ছে না। অসংখ্য কথা বাতাসে ভাসছে।

তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এর একটি কথা এ প্রসঙ্গে খুব বেশি মনে পড়ে। গত বছর মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেছিল মন্ত্রীর সাথে। সাক্ষাতের পর মন্ত্রী ব্রিফ করতে চাইছিলেন না। তখন আমরা কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী উনার রুমে কথা বলতে গেলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এসেছিল মূলত জিএসপি বিষয়ে তাদের কিছু চাহিদা ও পরামর্শের কথা জানাতে। তো, মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জানতে চাইলাম, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা কবে নাগাদ জিএসপি পাওয়ার আশা করতে পারি? তিনি তখন খুব মজা করে এর উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন, ‘এই জবাব মার্শা বার্নিকাট দিতে পারবেন!’

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সব শর্ত ততদিনে আমাদের পূরণ হয়ে গেছে। তাও আমরা জিএসপি পাচ্ছি না। মন্ত্রী সেদিন আরো বলেছিলেন, শর্ত পূরণ করলে তারা নতুন শর্ত দেয়…..। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত পূরণ করা শেষ হবে না, তাদের শর্তও শেষ হবে না।’

‘জিএসপি’ সর্ম্পকে আমাদের পরিষ্কার জ্ঞান থাকাটাও জরুরি। কারণ পৃথিবী এখন আবর্তিতই হচ্ছে পুঁজিবাদের প্রভাবে। সেখানে ব্যবসা কিংবা ট্রেডই প্রধান ফোকাস বিষয়। জিএসপির পূর্ণরূপ হচ্ছে- জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) সাধারণ নিয়ম থেকে ছাড় দেওয়ার একটি প্রথাগত পদ্ধতি। আগে এটি জেনারেল এগ্রিমেন্ট অফ ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাট নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এতে আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ম যোগ করে নাম পরিবর্তন করা হয়। এছাড়াও জিএসপি ধনী রাষ্ট্রগুলোর শুল্ক না কমিয়ে, অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য শুল্ক কমাতে সদস্য রাষ্ট্রকে ছাড় দিয়ে থাকে।

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) এর আবেদনে ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। তার আগে জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারত।

এসব তো গেল যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক জিএসপির গল্প। জিএসপি নিয়ে যুক্তরাজ্য বা ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও গল্প কিন্তু কম নেই। ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের পর বলা হলো, বাংলাদেশের জিএসপি নিয়ে নতুন করে দুপক্ষকে আলাদাভাবে আলোচনায় যেতে হবে। সেই আলোচনা আমাদের করতেও হয়েছে। এখন নতুন সঙ্কট সৃষ্টির আভাস দিচ্ছে কাতার ইস্যু।

অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলা ও সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনের অভিযোগে সোমবার সৌদি আরব কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিপদ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সৌদি আরব এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ এরপর একে একে সাতটি দেশ সৌদি আরবের সুরে সুর মিলিয়ে একই ঘোষণা দেয়। হঠাৎ করে সন্ত্রাস ও উগ্রতাবাদে অর্থায়ন ও সমর্থনের অভিযোগ এনে কাতারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের হিকিড় পড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গরম হাওয়া বইতে শুরু করে। এবার কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাহরাইন হুঁশিয়ার করেছে, যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। সব মিলিয়ে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে।

কিন্তু বাংলাদেশকে কাতার ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই ঘটনার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে হাইরিস্ক দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা মনে করছে কুয়েত, সোমালিয়া, মিশর ও ইয়েমেনের কাতারে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ। আর এ কারণে আকাশ পথে কার্গো পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগের বলবৎ বিধি-নিষেধের সঙ্গে এখন বিস্ফোরক সনাক্তকরণ যন্ত্র যুক্ত করতে হবে।

অনেকের হয়তো জানা আছে, ২০১৬ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশ থেকে আকাশ পথে সরাসরি কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বৃটেন। সে নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে যতটা জানা গেল, এই বিধি-নিষেধ শুধুমাত্র এয়ার কার্গোই নয়, শিপিংয়ের ক্ষেত্রেও।

গত সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে হয় ঢাকায়, অথবা দুবাই, দোহা বা ইস্তাবুলে পণ্য স্ক্যান করে দেখতে হবে বিস্ফোরক রয়েছে কিনা।

পাশাপাশি জিএসপি ইস্যুতেও বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে সংগঠনটি। গত ৩১ মে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে হলে শ্রমিক অধিকারে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি দেখাতে হবে। অন্যথায় অস্থায়ীভাবে এ সুবিধা স্থগিত করা হবে।’ পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করার কথাও চিঠিতে বলা হয়েছে।

জিএসপি ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত মাসে।  এটি ছিল উভয়ের মধ্যকার তৃতীয় পর্যালোচনা বৈঠক। রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পদ্মা’য় ১৮ মে পর্যালোচনা বৈঠকটিতে সংগঠনটি ইতিবাচক মনোভাবই দেখিয়েছিল। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ওই বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। উচ্চপর্যায়ের ওই বৈঠকে জিএসপির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো রকম আলোচনাই উপস্থাপন করা হয়নি। অর্থ্যাৎ, জিএসপি নিয়ে অনাহুত আগ্রহ বাংলাদেশ দেখায়নি। জিএসপি নিয়ে আলোচনার আগ্রহ ছিল বেশি তাদেরই। অথচ বৈঠকের মাত্র দু’সপ্তাহেরও কম সময়ে তারা জিএসপি বাতিলের হুমকি দিয়ে চিঠি দিল। এই চিঠি একই সঙ্গে পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শ্রম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে। এর আগে ১৬ মার্চ তারা আরো একটি চিঠি লিখেছিল বাংলাদেশকে। তার জবাব দেয়নি বাংলাদেশ। এ জন্য এই চিঠিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।

এর থেকে বুঝা যায়, বিষয়টিতে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু কাতার প্রসঙ্গে এখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শক্ত কূটনেতিক অবস্থান এবং বক্তব্য প্রয়োজন। না হলে একটি অনাকাঙ্খিত সমস্যায় জড়িয়ে যেতে পারি আমরা। এটি কখনোই উচিত হবে না। কারণ শুধু এশিয়া নয়, এখন পুরো বিশ্ব জানে- বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে চলে। তাহলে আমরা কেন এ বিষয়ের ভুক্তভোগী হবো?

বিষয়গুলো বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। এ জন্য প্রয়োজনী কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো বিকল্প নেই। আবার, পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পাশ কাটিয়ে চলার অভিযোগ মাঝে মাঝে তুলেছেন অনেকে। আমরা মনে করি, এ ধরনের কূটনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক নয়। আমরা এখনো এলডিসিভুক্ত দেশ। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছি। আমাদের প্রয়োজন ব্যবসায়িক ও দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সুযোগ সৃষ্টি করা। বড় ধরনের বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো সুযোগ নষ্ট করা নয়।

এই মুহর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তারা আমাদের সবচে বড় রপ্তানি ক্ষেত্র। ২০১৫ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করেছি আমরা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মুদ্রাস্ফীতি না হলে এটি ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতো। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা বাড়াতে নানা সহযোগিতাও করছে তারা। আমরা আশা করি, এই ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে জোর তৎপরতা চালানো হবে।

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুন ২০১৭/হাসান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়