ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

৯ শিশুর মৃত্যু এবং এর দায়

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২১ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৯ শিশুর মৃত্যু এবং এর দায়

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : আমরা যারা এই বাংলার মাটিতে জন্মেছি, তারা সৌভাগ্যবান। আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ আছে। আমরা বলতে পারি- দিগন্তবিস্তৃত এ সবুজ প্রান্তর আমার, ঊর্ধ্ব আকাশে যতদূর নজর যায়- এ আকাশ আমার। বিশ্বের যেখানে যাই, বলতে পারি আমি বাংলাদেশি। আমাদের নিজেদের ভাষা আছে, প্রাণভরে যে ভাষায় কথা বলতে পারি। লিখতে পারি। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত আছে। আমরা সম্পদ অর্জন ও ভোগ করতে পারি।

পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ আছে, যাদের জন্ম হয়েছে উদ্বাস্তু শিবিরে, জীবন পাড়ি দিয়ে মৃত্যুও সেই উদ্বাস্তু শিবিরে। আপন দেশ কী- সেটা তারা জানে না। মুক্ত জীবনের আনন্দ তারা পায়নি। উদ্বাস্তু গ্লানি নিয়ে যাদের জীবন শুরু, শেষ হয় একই গ্লানিতে। জাতিসংঘের হিসাবে- পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। এদের নিজের বাড়ি নেই। সম্পদ অর্জন, সংরক্ষণ বা ভোগ করার অধিকার নেই। এদের সন্তানদের ভবিষ্যত নেই।

আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিতে, পূর্ব-পুরুষদেরকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে ভয়াবহ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাদের দূরদর্শী ভাবনা আর ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা ঐশ্বর্যবান।

আমরা পেরেছি অনেক কিছুকে জয় করতে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর এ দেশে লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এর ৭০ ভাগই ছিল দরিদ্র। সেই দারিদ্র্যের হার এখন ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বের মাত্র ২৪টি রাষ্ট্র গত এক দশক ৬ শতাংশের কাছাকাছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এখন আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ মাত্র তিন বছরে বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ৪৪তম অবস্থান অর্জন করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশ বিশ্বের ২৩তম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ হবে। গত চার দশকে লোক সংখ্যা প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভূমি বাড়েনি বরং কমেছে। সেই স্বল্প জমিতে ১৬/১৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। বছরে প্রায় ৫ কোটি টন শস্য ফলছে।

এত ফসল উৎপাদন, এত উন্নয়ন-অগ্রগতির মধ্যেও দেশের একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সন্তানেরা না-খেতে পেয়ে অপুষ্টির শিকার হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ায় অপুষ্টি ও হামের কারণে কয়েক দিনের মধ্যে নয়টি শিশু মারা গেছে। তবে আশার কথা, স্বাস্থ্য বিভাগ পদক্ষেপ নেওয়ায় আরো ৪৬টি শিশু অসুস্থ থাকলেও কেউ মারা যায়নি।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা যেভাবেই এ মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করুন না কেন, এর দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ত্রিপুরা পাড়ায় নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা এই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক। দেশ স্বাধীন করতে নৃগোষ্ঠীর মানুষ অংশ নেন এবং তাদের অনেকে জীবন দেন। তাদের বৈচিত্র্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারপ্রাপ্ত তারা। তাদের সন্তানেরা এই আধুনিক যুগে এসেও কেন অপুষ্টিতে বা হামে মারা যাবে? এই ক্ষত কি আমাদের এত উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না?

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ ভুইয়া জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের মারাত্মক পুষ্টিহীনতার কারণে ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের শরীরে সহজে নানা সংক্রমণ ঘটে। ওই শিশুদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম, রক্তশূন্যতাও প্রবল। পরে জানা গেছে, হামের সংক্রমণে শিশুরা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।

বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ শিশু হামের টিকার আওতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যা অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- পুরো ত্রিপুরা পাড়ার ৮৫টি পরিবারের সবাই গত ২০ বছর ধরে এই ৮৫ শতাংশের বাইরে থাকল। একটা জনগোষ্ঠী এভাবে বাইরে থাকল কীভাবে, কী জবাব দেবে স্বাস্থ্য বিভাগ?

এখন বহু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানেরা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। তারা মূলস্রোতে এসে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। তাদের জন্য সরকারি নিয়োগে কোটা আছে। যার সুযোগ নিয়ে তারা বহু সংখ্যক নিযোগ লাভ করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পোস্টিং পার্বত্য জেলায় দেওয়া হয়। তারা পাহাড়ে জীবন-যাপনে পারদর্শী। তারা তো নিজেদের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আচার-কালচার সম্পর্কে জ্ঞাত। তাহলে ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দারা কখনো আধুনিক চিকিৎসা না নিয়ে থাকে কীভাবে? এ মানুষগুলোকে কী কখনো আধুনিক জীবনে আনার চেষ্টা করা হয়নি?

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রকৃতির মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। তারা নিজেদের মতো করে নিজেরা মিলেমিশে ভালো থাক। সেই দিক থেকে তারা কিছুটা বিচ্ছিন্ন আধুনিক জীবনযাপন থেকে। কাছাকাছি বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোকজন থাকলেও তাদের সঙ্গে ওই গোত্রের মানুষের মেলামেশা কম। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ওই মানুষেরা গোত্রপ্রধানের নির্দেশে চলে। তারা আধুনিক চিকিৎসা নেয় না। তাদের সন্তানেরা স্কুলে যায় না।

এরা বংশ পরম্পরায় প্রকৃতির মধ্যে পাহাড়ে বাস করে। সেখানেই তারা সুখে থাকে। আমাদের উচিৎ তাদেরকে তাদের মতো করে থাকতে দেওয়া। তারপরও তাদের আধুনিক চিকিৎসা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে হবে। সেখানে স্কুল স্থাপন করে তাদের সন্তানদের পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তারা এ দেশের নাগরিক, তাদের সন্তানেরা যদি অপুষ্টিতে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, সরকারের সব উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

দেশে শিশুমৃত্যুর হার চার দশকে হাজারে ১৮৫ জন থেকে ৪৮ জনে নেমে এসেছে। গুরুতর রোগের টীকার আওতায় এসেছে ৯০ শতাংশ শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে এই অঞ্চল থেকে হামকে নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে তারা অনেক উন্নয়ন করেছে। ২০১৪ সালে ব্যাপকভাবে হামের টিকা দেওয়ার পর থেকে এই রোগের প্রকোপ কমে এসেছে, তবে নির্মূল হবে না যদি ত্রিপুরা পাড়ার মতো ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মূলস্রোত থেকে দূরে থেকে যায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুলাই ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়