ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

তুফানদের যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তুফানদের যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে

রুহুল আমিন : বাড়ি থেকে কলেজছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ। তারপর ধর্ষণের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মেয়েটির পেছনে ক্যাডার ও রাজনৈতিক নেতাকে লেলিয়ে দেওয়া। একপর্যায়ে কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন। এরপর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া।

প্রথমে মনে হতে পারে কোনো সিনেমার সিনোপসিস। কিন্তু না, এটা কোনো সিনেমার গল্প না। একটি বাস্তব ও নৃশংস ঘটনা। আর এ ঘটনা ঘটেছে বগুড়া শহরে। যার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে তার নাম তুফান সরকার। বর্তমান শাসক দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই তুফানের আজকের ‘তুফান’ হয়ে ওঠার জন্য চলুন দেখে আসি ফ্লাশব্যাক।  

বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর কসাইপাড়া এলাকার ক্ষুদে ব্যবসায়ী মজিবর রহমান সরকারের আট ছেলের মধ্যে সবার ছোট তুফান সরকার। প্রথমে পারিবারিকভাবে চমড়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় সে। বড় ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বড় ভাই যুবলীগ নেতা মতিন সরকারের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তুফান।

মতিন বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। এ সময় তুফানের বেগে তুফানের রাজনীতিতে উত্থান ঘটতে থাকে। তারপর মাদক ব্যবসায় জড়ান। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। যদিও ২০১২ সালে একবার ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে বেরিয়ে আসেন।  একই বছর  একটি হত্যা চেষ্টা মামলায় তুফান এবং তার তিন ভাই ঝুমুর, ওমর ও সোহাগ গ্রেপ্তার হয়। এবারও অল্প দিনের মধ্যেই বের হয়ে আসেন তারা।

তুফান বেপরোয়া হতে থাকেন আরো। ২০১৩ সালে বগুড়ায় এক যুবদল নেতা খুন হন। নিহতের মা  তুফান ও তার ভাইদের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। ওই ঘটনায় থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ নেয়নি বলে অভিযোগ নিহতের মায়ের।

একাধিক মামলার আসামি তুফান এক সময় শ্রমিক লীগে যোগ দেয়। তাকে ওই সংগঠনের বগুড়া শহর শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠনের ওই পদবি ব্যবহার করে শুরু হয় তার নতুন বেপরোয়া জীবন। তিন চাকার রিকশা-ভ্যান মালিক সমিতির নেতা হয়ে যান। অল্প কয়েকদিনে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যান তুফান। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে বগুড়া শহরে বিভিন্ন স্থানে জায়গা-জমি এবং দোকান দখলের অনেক অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ, তুফানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। ব্যতিক্রম হলো কেবল কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায়। ততদিনে অনেক সময় চলে গেছে। কথা হলো, এতো বেপরোয়া কীভাবে হয় তুফান? ফিল্মি কায়দায় উঠিয়ে এনে ধর্ষণ করে? তারপর আবার তা ধামাচাপা দিতে নাটক করতে থাকে! আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর এতো স্পর্ধা কোথায় পেয়েছে সে। আসলে তুফানকে তুফান হিসেবে তৈরি করতে সমাজ দায়ী, রাজনীতি দায়ী। এখানকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী। একদিন তুফান দলের হয়ে কাজ করেছে। তুফানকে রক্ষা করতে হত্যা মামলা নেওয়া হয়নি (অভিযোগ সত্য হলে)। বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে জামিনপ্রাপ্তি তুফানকে তুফান হিসেবে তৈরি করেছে। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি একটু একটু করে এই ভয় দূর করার মধ্য দিয়ে তুফান নিজেকে তুফান হিসেবে তৈরি করেছে। সেখানে রাজনৈতিক পরিচয়, দলীয় প্রভাব- এইসব বড় ভূমিকা রেখেছে। তুফানের জন্ম অনেক আগেই হয়েছিল। ক্ষমতার গর্ভে অন্যসব কীটের মতো তুফানেরও জন্ম হয়।

যে কোনো অপরাধের বিচার না হওয়া মানে আরেকটি অপরাধের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে অনেক কথা বলি আমরা। একজন নারী কাউন্সিলর যখন ধর্ষিতাকে শায়েস্তা করেন তখন আমার কাছে তা ক্ষমতার অপব্যবহারই মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। সেখানে নারী-পুরুষ খুব একটা ভেদাভেদ তৈরি হয় না। অথবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাও পুরুষতান্ত্রিক। তো সে ক্ষমতা নারী বা পুরুষ যার হাতেই থাকুক না কেন। তাই এই নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। যা দরকার তা হলো অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা। সেটা যে কোনো পর্যায় থেকে। রোজই যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার জন্য দায়ী কে? আমরা কয়টা ঘটনার কথা জানি? উপযুক্ত ও ন্যায বিচারের ব্যবস্থা থাকলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যেত। গাজীপুরে বিচার না পেয়ে বাবা-মেয়ের স্বেচ্ছামৃত্যু, বনানীতে ধর্ষণ, প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আবার উত্যক্তের শিকার হয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথও বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ।

গত শুক্রবার কুমিল্লায় এক কলেজ ছাত্রী তার নামে ফেসবুকে আইডি খুলে অশ্লীল পোস্টের কারণে অপমানে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিল। এখন পর্যন্ত যে কয়টি ধর্ষণ ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে তার বিচার হয়েছে কি? বিচার প্রক্রিয়া এতো দীর্ঘ যে শেষ পর্যন্ত আদৌ বিচার হয় কি না আমরা জানি না। কিংবা একের পর এক ঘটনার কারণে সব হারিয়ে যায় ঘটনার আড়ালে। এটার একটা সামাজিক প্রভাব আছে সমাজে। অপরাধের বিচার হয় না। কিছুদিন এক বিষয় নিয়ে হৈ চৈ। তারপর অন্য বিষয়। ধর্ষণের পর এমনিতে পরিবার, সামাজিক দিক বিবেচনা করে অনেকে মুখ খুলতে চান না। সব বাধা পেরিয়ে বিচার চাইতে গিয়ে পড়তে হয় এক দীর্ঘসূত্রিতায়। যা দিন শেষে ধর্ষকদের উৎসাহী করে তোলে। গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই দ্রুত বিচার মানে নামে দ্রুত বিচার না। কাজে দ্রুত বিচার।  

অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধের বিচার করে সরকার তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে। বৃহৎ দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের কেউ কেউ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে যেকোনো সময়। তবে দলে যখন অন্তর্ভুক্ত হয় তখন যাচাই-বাছাই করে দলে ঢুকানো যেতে পারে। তুফান দলে ঢুকে প্রভাব খাটিয়ে অনেক অপরাধ করেছে। এখন দল তাকে বহিষ্কার করেছে। দলের দায়িত্ব কি শেষ এখানে? আপাত দৃষ্টিতে দায় এড়ানো গেলো। তুফান সরকারের অপর ভাইয়েরা রাজনীতি করে। তারা যে প্রভাব খাটাবে না তার নিশ্চয়তা শাসক দলকে করতে হবে।

সর্বোপরি এই জঘন্যতম কাজের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর কোনো তুফান যেন এতটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ না করতে পারে। তুফান সরকারের বিচার করে সমাজের আনাচে কানাচে যদি আরো কোনো তুফান লুকিয়ে থাকে তাদের সংবাদ দিতে হবে। অন্তত তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের মতো একটা অপরাধের ক্ষেত্রে আমরা যেন বিস্মৃতিপরায়ণ হয়ে না যাই। নতুন ঘটনার জন্ম হলে যেন ভুলে না যাই মানবতার এই পরাজয়ের গল্প। তুফানদের রুখতে হবে যেকোনো মূল্যে। না হয় মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয় দেওয়ার আর সুযোগ থাকবে না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়