ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আপনার দেয়া শিক্ষা আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না তো?

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ২ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আপনার দেয়া শিক্ষা আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না তো?

ছবিটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত

|| ফিরোজ আলম ||


জীবনমুখী গানের কিংবদন্তি গায়ক নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি আমাদের সবার পছন্দের। সব পূর্ণবয়স্ক মানুষকেই দেখি গানটি শুনলে একটু আনমনা হয়ে যেতে। আমরা কেউ নিজেদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে দেখতে চাই না। একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, যে বাবা-মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন তারাও এই জীবনটি চাননি। কিন্তু ভাগ্য তাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছে। ভাগ্য বলে যে অদৃশ্য শক্তির আমরা দোষারোপ করছি তা আসলে আমরাই নিয়ন্ত্রণ করি অনেকাংশে। ভাগ্যের দোষ দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজা মা-বাবাকে কিন্তু তার ছেলেমেয়েরাই বাধ্য করে আশ্রমে বাস করতে।

নিজের অসীম স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা সন্তানের দিকে তাকিয়ে কখনো ভাবতে চান না যে, এই শিশুটি একদিন আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে। এরপর একদিন এই সন্তানেরা যখন আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তখন পুরো দায়টি কি শুধুই সন্তানের? আমার এই প্রশ্ন শুনে যারা কপাল কুঁচকে ফেলেছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- আমি এমন সন্তানদের সাফাই গাইতে এই লেখা লিখছি না। শুধু আপনাদের ভাবনাটাকে একটু ভিন্ন দিক থেকে ভাবার অনুরোধ করছি।

যৌথ পরিবারের ভাঙনের শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। তবে আশির দশকে এসে তা প্রকট হতে থাকে। আর নব্বইয়ের দশকে শুরু হয় অনু পরিবারের প্রথা। এই বিভাজনের জন্য আধুনিকায়ণকে দায়ী করা হয়। কিন্তু শুধু আধুনিকায়ণকে দায়ী করে আমরা অনেক সমস্যাকে চোখের আড়াল করে দিচ্ছি। এখন সময় হয়েছে সেসব সমস্যগুলো অনুধাবন করার। আমার এক বন্ধু দুঃখ করে একদিন আমাকে বলেছিল, ‘আমার মা চায় আমরা সব ভাই সারাজীবন একত্রে বসবাস করবো। কিন্তু আমার বাবা তার ভাইদের সাথে একত্রে বাস করেন না। সেটার দায় কিন্তু অনেকটাই আমার মায়ের।’ আমি আমার বন্ধুর বলা কথাগুলো অনেক ভেবেছি। সত্যিই তো অনেক বাবা-মা নিজে অনু পরিবার নিয়ে আপাত সুখের নীড় গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তারা নিজেরা চান সন্তানেরা সবাই একত্রে থাকবে। বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে হেসে খেলে দিন কাটাবেন তারা।

পেশাগত কিংবা ব্যবসায়িক কারণে মূল পরিবার ছেড়ে শুধু স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দূরের কর্মস্থলে থাকাটা অন্যায় কিছু নয়। কিংবা পুরোনো বাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আলাদা বাড়িতে থাকার প্রয়োজন হয় যদি সেটাও মেনে নেয়া যায়। তাই বলে মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু স্বামী-স্ত্রী মিলে আলাদা জগত তৈরি করার বিষয়টাই সমস্যা সৃষ্টি করছে। বাবা-মায়েরা যখন তাদের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তখন সন্তানরাও হয়ে ওঠে তাদের মতোই আত্মকেন্দ্রিক। এসব পরিবারের শিশুরা ছেলেবেলা থেকেই শেখে যে বড় হলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে আলাদা জগত তৈরি করলেই সকল সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে। তারা এসব শেখে তাদের বাবা-মাকে দেখেই। অথচ যদি তারা ছেলেবেলা থেকেই দেখত তাদের বাবা-মা নিজেদের বাবা-মায়ের প্রতি যত্নশীল তবে তারাও নিজেদের বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন হতে পারতো। আমি বলছি না, বৃদ্ধ বাবা-মাকে আশ্রমে পাঠানোর এটাই একমাত্র কারণ। আমার কাছে অন্যান্য কারণের মধ্যে মূল্যবোধের ঘাটতির কারণটাকেই বড় মনে হয়। আর শিশুরা মূল্যবোধটা শেখে প্রথমত পরিবার থেকে, দ্বিতীয়ত সমাজ থেকে। আজকালকার শহুরে শিশুরা সামাজিকভাবে মোটামুটি একঘরে হয়ে বড় হচ্ছে। নিজের ফ্ল্যাটের চার দেয়ালে বন্দি এই শিশুরা সমাজের তেমন কোন সংস্পর্শই পায় না। আর স্কুলে গিয়ে তারা যতটুকু সময় অন্য শিশুদের সাথে মেশে সেই সময়টাও কাটে বড়দের মতো কার কি আছে সেসব নিয়ে গর্ব করতে করতে। ছোট ছোট শিশুরা যখন জাগতিক সম্পদ নিয়ে আত্মঅহমিকায় ভোগে তখন তাদের বাবা-মাকে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করাটা দোষের কিছু নয়। আমি অবাক হয়ে দেখি কোনো শিশু যদি স্বার্থপরের মতো আচরণ করে তবে বাবা-মা হেসে বলে দেখেছেন, কত চালাক হয়েছে! অনেক অভিভাবককেই দেখি স্কুলগামী সন্তানদের শিখিয়ে দেয়, ক্লাসে শুধু ভালো ছাত্রদের সাথে মিশবে। অমুকের ছেলে কিংবা মেয়ের সাথে মিশবে। তার বাবা অনেক বড়লোক। দরিদ্র আর খারাপ ছাত্র মানেই যেন খারাপ শিশু। অথচ পুঁথিগত শিক্ষার সাথে নৈতিক শিক্ষার অনেক ফারাক রয়েছে। ধনী পরিবারের অথবা ভালো ছাত্র মানেই কি সে নৈতিক ভাবে ভালো হবে? বাবা-মা শিশুদের ছেলেবেলায় শেখায় নিজের প্রয়োজন বুঝে বন্ধু বানাবে। তারা শিশুদের বুদ্ধিমান না বানিয়ে চতুর বানানোর প্রশিক্ষণ দেন। কারণ অনেক বাবা-মায়েরই ধারণা চতুরতা ছাড়া সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে না। আর ছেলেবেলা থেকে চতুরতার বাহবা পেতে পেতে এসব শিশুরা হয়ে যায় মহাচতুর। চতুরতা করে এক সময় হয়তো এসব সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিতও হয়। কিন্তু লাভ-ক্ষতির হিসাব করে চলতে চলতে বাবা-মা, ভাই-বোনের সম্পর্কগুলোও একসময় এরা লাভ-ক্ষতির পাল্লায়  তোলা শুরু করে। বৃদ্ধ বাবা-মা বাসায় থাকলে যদি লাভ হয় তবেই তারা তাদেরকে সাথে রাখে নতুবা গ্রামের বাড়ি অথবা আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। অথচ এই সন্তানগুলো যদি দেখতো তার বাবা-মা তাদের আত্মীয়ের সাথে মমতাময় সম্পর্ক বজায় রেখেছে তবে এই শিশুরাও হতো কোমল। তারা বুঝতে শিখতো সব কিছু লাভক্ষতির পাল্লায় তুলতে নেই।

আবার আমার বন্ধুর বলা কথাটাতেই ফিরে যাই। আপনি যদি চান যে, আপনার সব সন্তান মিলেমিশে থাকবে। আপনি বৃদ্ধ বয়সে সবাইকে নিয়ে আনন্দে কাটাবেন তবে নিজেও সেই উদাহরণ সৃষ্টি করুন। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করুন। আপনার সন্তান আপনাকে কতটা অনুসরণ করে তার ধারণা হয়তো আজ করতে পারছেন না। কিন্তু যেদিন আপনার সন্তান আপনাকে বলবে, দাদুর মতো তুমিও এখন থেকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে। সেদিন আপনি বুঝবেন কি ভুলটাই না করেছিলেন! কিন্তু আফসোস তখন সেটা শোধরানোর সময় আর আপনার থাকবে না।


 

লেখক: মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়