ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যেভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারের যাত্রা || কামাল লোহানী

কামাল লোহানী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৯ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারের যাত্রা || কামাল লোহানী

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রমাণ। অপরিহার্য এই প্রচারমাধ্যম একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ বাংলার মানুষকে জাগ্রত করে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানবশক্তিকে আরো বলবান করে এবং রণাঙ্গনে কিংবা বাঙ্কারে বাঙ্কারে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের উদ্দীপ্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তিযুদ্ধকালীন মরণজয়ী মনোবল সুরক্ষায় এবং মুক্তিকামী মানুষের জাগরুক চরিত্র দৃঢ় ও প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত রাখাই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্দেশ্য। এই বেতার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হবার পর; ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারে। কিন্তু সিনিয়র একজন বেতার কর্মকর্তা আব্দুর  কাহহার  চৌধুরী সেদিন বেলাল মোহাম্মদদের বলেছিলেন, আপনারা কালুরঘাট বেতার প্রক্ষেপণ কেন্দ্রে চলে যান, জায়গাটা নিরাপদ। পরে সেখান থেকে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে এই কার্যক্রম শুরু করতে চট্টগ্রাম বেতার এবং শহরের সংস্কৃতি সংগ্রামে সম্পৃক্ত প্রগতিশীল কর্মীদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচার মাধ্যমের প্রয়োজন অপরিহার্য। কারণ বিশ্বের সকল মানুষ এমনকি মুক্তিসংগ্রামী জনগণকেও তো নিত্যকার খবরাখবর পরিবেশন করতে হয়। যুদ্ধরত সংগ্রামী যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা কিংবা বিপ্লবী সরকারের নির্দেশাবলী জানানোর জন্যও এর গুরুত্ব আছে। তাই এটি সংগঠনে অংশগ্রহণ করেন রাজনীতি সচেতন প্রাক্তন ছাত্রনেতা, বেতারকর্মী এবং চট্টগ্রাম শহরের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বরা। তারা যেহেতু দুনিয়ার মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, তাই তাঁরা বিলম্ব করেননি। গণহত্যা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলেন, এখনই ‘বিপ্লবী বেতার’ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তানি হামলার আগ পর্যন্ত বেতার কেন্দ্র কালুরঘাটে ছিল। পরে তারা অসীম সাহসিকতা ও অকল্পনীয় দক্ষতায় ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি উঠিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে যান এবং প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যের বগাফার জঙ্গলে বিএসএফ-এর সহযোগিতায় ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন, সেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সেখান থেকে প্রচার কাজ শুরু হয়। সে কাজের যে অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পরিবেশ, আজ তা চিন্তা করা দুষ্কর।

এদিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ তরুণ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে, ভারতে সসম্মানে প্রবেশ করলেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেন, বিএসএফ-এর সর্বভারতীয় প্রধান রুস্তমজীর মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদারের যোগাযোগের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল। যাই হোক, তাজউদ্দিন, আমীরুল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রয়োজনে যে সহায়তা চেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বেতার সম্প্রচার যন্ত্র। সে অনুযায়ী ভারত সরকার ৫০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন মধ্যম তরঙ্গের একটি ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা করেছিল। তাই নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার বালাগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলো। এই প্রথম সরকার পরিচালিত প্রচারকেন্দ্র চালু হলো। তবে কালুরঘাটের ধারাবাহিকতায় এর নামকরণ একই রাখা হলো। তবে এখানে স্মরণযোগ্য, চট্টগ্রামে প্রথমে যখন বেতার চালু করা হয় তখন তার নামকরণ হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। কিন্তু যখন মেজর জিয়াকে পটিয়া থেকে নিয়ে আসা হলো, তখন তাকে বেতারে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি বলতে সম্মত হয়েছিলেন কিন্তু সেখান থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিতে বলেন। না হলে তিনি কিছু বলবেন না বলে জানিয়ে দেন। বিপ্লবী বেতারের উদ্যোক্তারা ভেবে দেখলেন, বাঙালি সেনাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণের জন্য মেজর জিয়াকে প্রয়োজন। ফলে তারা ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দিতে সম্মত হন। তারা চেয়েছিলেন, অন্তত একজন বাঙালি সেনা অফিসারের পরিচয়ে তারই কণ্ঠস্বরে বক্তব্যটা থাকুক। যে কারণে অবশেষে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করা হয়েছিল। তবে মেজর জিয়া এই সামরিক কর্মকাণ্ডকে অভ্যুত্থান পর্যায়ের অ্যাকশন ভেবে পূর্ব পাকিস্তানে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করার কথা ভাবেন। কিন্তু এটা যে সামরিক অভ্যুত্থান  নয়, রাজনৈতিক যুদ্ধ সেটা তাকে বিভিন্নজন বোঝানোর পর তিনি খুবই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন ২৭ মার্চ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতার বালীগাও সার্কুলার রোডে প্রতিষ্ঠিত হলেও ট্রান্সমিটারটি ছিল সীমান্তের কাছাকাছি নিরাপদ কোনো একটি স্থানে, সেটি নিরাপত্তার কারণে আমাদের কাছেও গোপন রাখা হয়েছিল। এই শক্তিশালী বেতারযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ কেন প্রয়োজন, শত্রু নিধনে আমাদের সফলতা ও শত্রুর ব্যর্থতা প্রচার, মুক্তিযোদ্ধাদের তত্পরতা এবং তাঁদের অনুপ্রাণিত করা, দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ বাংলার মানুষের মনোবল অটুট রাখা ও তাঁদের সাহস দেয়ার কাজটি চলছিল। পাশাপাশি বিদেশে সকল সহায়ক রাষ্ট্র-জনগোষ্ঠীকে জানাবার জন্য এই বেতারই ছিল অন্যতম প্রধান মাধ্যম। শুধু কি তাই, অবাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘পাকিস্তান’ ভাঙা হচ্ছে বলে ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তার বিরুদ্ধে সত্য তুলে ধরার দায়িত্বও এই বেতারের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে নিজ শক্তি এবং মেধায় পরিচালিত হয়েছে। ভারত আমাদের ট্রান্সমিটার ও একটি রেকর্ডিং মেশিন দিয়েছিল। সেই দিয়ে শুরু। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেটের বেতার কর্মী, শিল্পী-কলাকুশলীরা এটি পরিচালনা করতেন। এ ছাড়া দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সাংবাদিক ও শিক্ষক-শিক্ষাবিদ তথা লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গান ও কথিকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার, অগ্নিশিখা, পিন্ডির প্রলাপ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেসহ নানা বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান এখান থেকে প্রচারিত হয়েছে। এতে অভিজ্ঞ সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, তোয়াব খান, মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী, আবদুল গাফফার চৌধুরী,  এমআর আখতার মুকুল, কামাল লোহানী, রণজিত্ পাল চৌধুরী, সলিমুল্লা, সাদেকীন, আমীর হোসেন প্রমুখ প্রধানত বিশ্লেষণাত্মক প্রচারধর্ম কথিকা লিখতেন এবং সেগুলো প্রচারিত হতো। বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, গাজীউল হক, জহীর  রায়হান, আনিসুজ্জামান, এআর মল্লিক ছিলেন এবং রাজনৈতিক নেতা ও সংসদ সদস্যরাও ছিলেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ বিভাগ ছিল সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই মুক্তিসেনাদের সফলতা, শত্রুর পরাজয় জনগণকে সাহস দেয়া আর মুক্তিসেনাদের মনোবল দৃঢ় রাখার নানা উপাদান প্রকাশিত হতো। সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম আমি। সহকর্মী শব্দসৈনিক হিসেবে ছিলেন জালালউদ্দিন আহমদ, মৃণালকৃষ্ণ সেন, রণজিত্ পাল চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, এ মাসুম, আলমগীর কবীর, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরিন আহমদ (শীল্প), সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী রেজা চৌধুরী, নূরুল ইসলাম সরকার, বাবুল আখতার, এরা নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি বুলেটিন তৈরি ও পাঠ করতেন। এমনকি কথিকা, জীবন্তিকাতেও অংশ নিতেন। আমরা পরের দিকে ময়মনসিংহের জাহিদ সিদ্দিকীকে পেলাম, তখন থেকে উর্দু সার্ভিস চালু করলাম। কারণ জাহিদ উর্দুভাষায় শুধু পারদর্শীই নন পণ্ডিতও ছিলেন।

এই রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে টেপগুলো সযতনে একটি পোর্টফোলিও ব্যাগে করে তৈরি রাখা হতো। বিএসএফ-এর নির্দিষ্ট ব্যক্তি এসে এগুলো নিয়ে একটি জিপে করে ছুটতেন ৪৫ মাইল গতিতে। ট্রান্সমিটারে পৌঁছতে লাগত প্রায় ঘণ্টাখানেক। তারপর নির্ধারিত সকাল, দুপুর ও রাতের অধিবেশন শুরু হতো। প্রথমে আমাদের একটি রেকর্ডিং স্টুডিও থাকলেও পরে আরো একটি হয়েছিল। তবে স্টুডিও না বলে একে কক্ষ বলাই ভালো। স্টুডিওর কোনো চরিত্রই এর  ছিল না।

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় দফায় যখন কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার শুরু হলো, তখন আমাদের না হারমোনিয়াম, না তবলা কিছুই ছিল না প্রথমদিকে। রেকর্ডের গানগুলো প্রচার করতে করতে ঐসব যন্ত্র ক্রমশ সংগ্রহ করা হলো। শিল্পীরাও এসে পৌঁছতেন এবং প্রয়োজনের খাতিরে অনেকেই গান লেখা শুরু করলেন। এ ব্যাপারে চিরকৃতজ্ঞ থাকলাম আমরা কলকাতার বীমা কোম্পানীর এক বন্ধু গোবিন্দ হালদারের। যখন নতুন গানের সংকট তখনই গোবিন্দ আমাকে অনেকগুলো গান লিখে দিলেন। যার মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’- এই গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এ ছাড়া প্রয়োজনে যারা কোনোদিন গান লিখেননি, তাঁরাও রচনা করেছেন এবং বেতারে যে যে গান প্রচারিত হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, বিজয়ের মুহূর্তে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটছে, তখনই প্রচারিত হলো বিশেষ সংবাদ বুলেটিন, যে বুলেটিনে সবাই জানতে পারলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয়লাভ করেছে। আজ আমরা মুক্ত, স্বাধীন। সংবাদটি আমি লিখে পাঠ করেছিলাম- এ আমার গর্ব। সেই সাথে আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেল, সে হলো, বিজয় মুহূর্তে গীতিকার সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম তাত্ক্ষণিকভাবে লিখতে শুরু করলেন একটি গান। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ.... আর সুরকার সুজেয় শ্যাম সুর বসাতে থাকলেন। এমনি করে গানটি রেকর্ড করেই ঐ সংবাদ প্রচারের পরপরই বেজে ওঠে। গানটির দু লাইন করে লেখা হচ্ছে আর সুরকার সুর সংযোজন করছেন এবং শব্দ সৈনিক গণশিল্পী অজিত রায়ের নেতৃত্বে কোরাসে গানটি পরিবেশন করা হয়েছিল। ঘটনাটি দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক অকল্পনীয় অধ্যায়।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত সচেতন রাজনীতির কর্মী সংগ্রামের উদ্দেশ্য, প্রচার, দেশপ্রেমে উজ্জীবন এবং আত্মত্যাগে বলীয়ান মুক্তিসেনা দল যখন নিজেদের শাণিত অস্ত্রকে দুশমন-দস্যুদের বিরুদ্ধে তাক করে নিরন্তর এগিয়ে চলেছেন, সেই সময় একটি দলকে দেখা গেল, স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করার পারিশ্রমিক এবং সম্মানীর মর্যাদা কী হবে তাই নিয়ে বিপ্লবী বেতারে ধর্মঘট করে বসলেন। কেউ কি শুনেছেন বিপ্লবী নেতার ধর্মঘটের কথা। না। শোনেননি, কারণ এই মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে এসেছেন, জীবন উত্সর্গ করছেন শত্রুকে বিতাড়িত করে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে, তাঁরা কি যুদ্ধ বন্ধ করবেন পয়সার জন্যে? মুক্তিকালীন প্রবাসী সরকারই তো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর তো কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। আমাদের কাজ কেবলই বেতার পরিচালনা করা। দুঃখজনক হলেও অমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে আমাদের তিনদিন পড়তে হয়েছিল। এ এক বিচিত্র বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা মুক্তিযোদ্ধা শব্দ সৈনিকদের জন্য। এই পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের সকল যোদ্ধা অত্যন্ত তত্পর ছিলেন যেন কোনোভাবেই অবরুদ্ধ বাংলার মানুষের মনে না হয়, স্বাধীন বাংলা বেতার বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সেদিন সাংবাদিক শব্দসৈনিকেরা নিজেদের কলম আরো তীক্ষ্ম করেছিলেন। বেতার সম্প্রচার বন্ধ হতে দেননি। কারণ বেতার সম্প্রচার একদিনও বন্ধ হলে মুক্তিসংগ্রামী মানুষদের হতাশাগ্রস্ত করে ফেলবে। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ অথচ রাজনীতি-সচেতন বেতার ও সংস্কৃতিকর্মীরা কি করে অসাধ্য সাধন করেছিলেন, তার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই। ঘটনাটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের। চট্টগ্রাম বেতারের কর্মী-প্রকৌশলী, লেখক- সংগঠকরা যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হলেন কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনে, তখন তাঁরা দিশেহারা। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা বেতারকর্মী সৈনিকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন, যেদিকেই যান না কেন তাদের প্রচারকার্য চালিয়ে যাবার জন্য ট্রান্সমিটার যন্ত্রটির প্রয়োজন হবেই। তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবন থেকে ১ কিলোওয়াট প্রক্ষেপণ যন্ত্রটি তারা উঠিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রকৌশল বিভাগের কর্মী, যারা এই সময় সংগ্রামে  নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে যন্ত্রটি তুলে নেয়া হয়েছিল। তবে যন্ত্রটি পরিবহনের জন্য মেজর জিয়াউর রহমান একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই ট্রান্সমিটারটি উঠিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে চট্টগ্রামের শব্দসৈনিক বন্ধুদের একটি দল এটি নিয়ে প্রতিবেশী ত্রিপুরার রাজ্য রাজধানী আগরতলার বগাফার জঙ্গলে ত্রিশজন লোকের সহযোগিতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই ট্রান্সমিটারটি পুনঃস্থাপনে আরেক অনন্য ইতিহাস রচিত হলো। এই দলের সদস্য ছিলেন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের টেকনিক্যাল অপারেটর তরুণ রাশেদুল হোসেন। দেশপ্রেম এবং মুক্তি প্রয়াসের প্রয়োজনে সেদিন রাশেদ সহযোদ্ধা শব্দসৈনিকদের সহায়তায় ‘কপিবুক’ ছাড়াই ট্রান্সমিটারটি রিইনস্টল করতে পেরেছিলেন। এ ছিল অসাধারণ কৃতিত্ব। কিন্তু তখন ছিল দেশমাতৃকার মুক্তির যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধার পবিত্রতম দায়িত্ব এবং প্রয়োজনের প্রতি আনুগত্য। সেদিনের এই মহতী দায়িত্ব সম্পন্ন কি করে করলেন ঐ তরুণ, এই অবিশ্বাস্য ও অবিস্মরণীয় তারুণ্যের প্রদীপ্ত দেশপ্রেমকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের তত্কালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী সত্পতি এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও আকাশবাণীর প্রধান প্রকৌশলী, যাঁরা দিল্লী থেকে ছুটে এসেছিলেন, মুক্তিকামী জনগণকে তাঁদের প্রচার মাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এসে যে বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন, তা বস্তুতই অবিশ্বাস্য এক বিস্ময় সৃষ্টিকারী ঘটনা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়