ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গণমাধ্যম কর্মী আইন: সাধুবাদের সঙ্গে অভিনন্দনও প্রাপ্য

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২২ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণমাধ্যম কর্মী আইন: সাধুবাদের সঙ্গে অভিনন্দনও প্রাপ্য

হাসান মাহামুদ: এই তো চার মাস আগে ১৯ জুন জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে নীতিগতভাবে পাস করা হলো ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭’।

দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে তাল রেখে অনলাইন গণমাধ্যম বিকশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি নীতিমালার প্রয়োজন ছিল। নীতিমালার জন্য সরকারের অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু সর্বমহল থেকে তা তারা পায়নি কিছু বিষয়ে আপত্তি ওঠায়। বিশেষ করে অনলাইনগুলোর অফলাইনে কাজ করার সুবিধা না রাখা, ডোমেইন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড আইনে যুক্ত না-করাসহ বিভিন্ন কারণে নীতিটিকে ‘বৈষম্যমূলক নীতি’ বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে তখন একটা কথা মোটামুটি প্রচলিত হয়ে ওঠে: ‘অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া অনুমোদন হওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ, তবে অভিনন্দন জানানোর সুযোগ নেই’।

প্রথম আপত্তি ওঠে নিবন্ধন ফি নিয়ে। অনুমোদিত খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে ‘অনলাইন গণমাধ্যম নিবন্ধনের জন্য কমিশনে নির্ধারিত ফি দিতে হবে। কিন্তু প্রথমদিকে যখন নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার কাজ চলছিল, তখন অনলাইন কর্তৃপক্ষের মতামত নেয়া হয়। তখন নীতিমালায় কোনো ফি রাখার কথা বলা হয়নি।

আমরা জানি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনসহ প্রিন্ট মিডিয়া নিবন্ধন করতে সরকারকে কোনো ফি দিতে হয় না। সে ক্ষেত্রে অনলাইন সংবাদপত্র নিবন্ধনের জন্য ফি দেওয়ার নিয়ম- এক দেশে দুই আইনের মতো! 

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, ‘মুদ্রিত পত্রিকা বা টেলিভিশনের অনলাইন সংস্করণ চালাতে নতুন করে নিবন্ধন নিতে হবে না জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ১৯৯৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী যারা নিবন্ধন নিয়েছে, তাদের নতুন করে আর নিবন্ধন নিতে হবে না। তবে পত্রিকা ও টেলিভিশনের অনলাইন সংস্করণ চালাতে হলে কমিশনকে তা অবহিত করতে হবে।’

অর্থাৎ সংবাদপত্রগুলো চাইলে অনলাইন চালাতে পারবে, অথচ অনলাইনগুলো নিবন্ধন নেওয়ার পর কখনোই সংবাদপত্র প্রিন্ট করতে পারবে না। এটিও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত। যাই হোক, অনুমোদিত আইন সংসদে চূড়ান্ত পাশ হওয়ার আগে সরকার আরেকবার নীতিমালাটি পর্যালোচনা করবে-এই আশা আমরা করতেই পারি। বিশেষ করে, যাদের জন্য এ আইন তৈরি করা হচ্ছে প্রয়োজনে আরেক দফা তাদের মতামত নেয়া যেতে পারে।

মালিক বা প্রকাশকরা বছরের পর বছর ভুর্তুকি দিয়ে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অনলাইন গণমাধ্যম টিকিয়ে রেখেছেন। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নেই প্রতিটি মানুষের হাতের মুঠোয় অনলাইন গণমাধ্যম থাকবে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন টেলিভিশন ও অনলাইন রেডিও-সবই হবে সংবাদের অন্যতম এবং নির্ভরশীল উৎস। সরকার অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য এখনো সরকারিভাবে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। তাদের জন্য নেই কোনো বিজ্ঞাপন নীতিমালাও। কিন্তু এই গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা অন্য মাধ্যমগুলোর মতোই সরকারি প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রাখছেন। ক্ষেত্র বিশেষে, অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এবং দ্রুত সরকারের যেকোন জরুরি সংবাদ পৃথিবীর সকল প্রান্তে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছেন।

আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যদি সফলতার সাথে কাজ শুরু করতে পারে, তাহলে অনলাইন গণমাধ্যম হয়ে উঠবে দেশের জনগণের কাছে মূলধারার গণমাধ্যম। এই অবস্থায় সরকার গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন-২০১৭ তৈরি করেছে। এই আইনের জন্য সরকার সাধুবাদের সঙ্গে অভিনন্দন পাওয়ারও দাবিদার, বেশ কয়েকটি কারণে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হলো, অন্তত এই আইনটি বৈষম্যমূলক নয়। খসড়া এই আইনের ফলে সকল গণমাধ্যমকর্মী একই মজুরি বোর্ডের আওতায় আসবে।

‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকুরির শর্তাবলী) আইন-২০১৭’ যদিও নতুন কোনো আইন নয়। ১৯৭৪ সালের ‘দ্য নিউজ পেপার এমপ্লয়িজ (কনডিশনস অফ সার্ভিস) অ্যাক্ট যুগোপযোগী করে আইনটির খসড়া তৈরি করেছে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি)। আইনটি প্রণয়নের কাজ শুরুর প্রথম দিক থেকেই এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রেখেছিলাম আমরা। প্রথমদিকে আইনটিতে ২৬টি ধারা রাখা হয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সর্বমহলের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া খসড়া আইনটিতে দেখা গেছে ২৪টি ধারা। অর্থাৎ আপত্তি উঠতে পারে, এমন দুটি ধারার বিয়োজন করেই আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

আইনটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে, সংক্ষিপ্ত হলেও আইনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন-ভাতা, কল্যাণ তহবিল, কর্মঘণ্টা, চিকিৎসা সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিষয়ই এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ হচ্ছে, ‘করপোরেট আর নিবর্তনমূলক আইনে বন্দি স্বাধীন সাংবাদিকতা’। আমরা বিশ্বাস করি নতুন এই আইন কার্যকর হলে এই অপবাদ ঘুচবে।

খসড়া আইনে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই মজুরি বোর্ডের অধীনে বেতন-ভাতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ আইনের ধারা দুইয়ে বলা হয়েছে, পূর্ণকালীন কর্মরত সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মচারী, ছাপাখানা কর্মচারী, মিডিয়া সদর দপ্তর কর্মী, আঞ্চলিক বা বিদেশি অফিসে কাজ করে এমন কর্মী এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংস্করণের কর্মচারীরা এই আইনের আওতায় পড়বেন। এছাড়া পূর্ণকালীন প্রযোজক, স্ক্রিপ্ট-রাইটার, শিল্পী, ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট, ক্যামেরাম্যান, অডিও ও ভিডিও এডিটর, সাউন্ড রেকর্ডার, ক্যামেরা সহায়ক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও ইনফোগ্রাফ ডিজাইনারও প্রস্তাবিত নতুন আইনের আওতায় পড়বেন। আইনটির ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে নিজ কর্মীদের কল্যাণের জন্য একটি ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করার কথা হয়েছে এতে। এটিও উত্তম ও যুগোপযোগী একটি সিদ্ধান্ত।

প্রস্তাবিত আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘মিডিয়া কর্মীরা মালিকদের কাছ থেকে অপরিশোধিত টাকা পুনরুদ্ধার করতে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবেন। অপরিশোধিত টাকার বিষয়টি সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলে এই অর্থ আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ এর মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের বেতন বা অর্থপ্রাপ্তির একপ্রকার নিশ্চয়তাই দিল সরকার। আইনটির খসড়ার ধারা ৯-এ নারী কর্মচারীদের বিশেষাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মচারী নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কর্মী এমন কোনো আচরণ করতে পারবে না যা অশ্লীল কিংবা উক্ত নারীর শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী। আইনটির ১০ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার প্রতি পাঁচ বছর পর পর মিডিয়া কর্মীদের জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠন করবে। এতে মালিকপক্ষ এবং কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকবে। এসব সিদ্ধান্তও অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়া উচিত।

এছাড়া চাকুরীবিধি, নিয়োগপত্র, ছুটি এবং চিকিৎসা সুবিধার কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিধি লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত করার কথা বলা হয়েছে।

তবে আইনের ধারা-২২-এ বলা হয়েছে সরল বিশ্বাসে কৃত কাজের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়ে। বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা এর কোনো বিধির অধীনে সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত বা সম্পাদনের লক্ষ্যে অভীষ্ট কোনো কাজের জন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা রুজু বা অন্য কোনো আইনত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না’। তবে সরল বিশ্বাস সংক্রান্ত এই ধারাটি নিয়ে কেউ ভিন্ন সুবিধা নিতে পারে কি না, সে বিষয়ে আরেকটু ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। বোদ্ধা এবং গুণীজনেরা হয়তো বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

কয়েক মাস আগে, ৩ মে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-তে একজন প্রবীন সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘আমরা এখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথাও বলি না। আমরা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলি।’ কথাটিকে ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো- সাংবাদিকতার স্বাধীনতা থাকলে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম- দুটোই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। তাই আমরা এখন সাংবাদিকতার স্বাধীনতার কথা বলি। আর নতুন এই আইন সাংবাদিকদের বৈষম্য ও গণমাধ্যমের প্রতি চাওয়া-পাওয়ায় বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করছি।

পরিশেষে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে। ৩৯(১)-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ ৩৯(১)(ক)-তে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং ৩৯(২)(খ)-তে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা টিকিয়ে রাখতে জবাবদিহিতা, সুশাসন যেমন অপরিহার্য তেমনি অংশগ্রহণমূলক এবং টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া মজবুত করতে গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর তাই নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনের উপযোগী পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। মালিকপক্ষ ভালো থাকলে, গণমাধ্যম অফিসগুলো ভালো থাকবে। সংবাদকর্মীরা ভালো থাকলে গণমাধ্যম শক্তিশালী হবে।  গণমাধ্যমকর্মী আইনের ফলে বর্তমানে প্রচলিত অনেক সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হতে পারে। এ জন্য সরকারকে আবারো ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, সাধুবাদ ও অভিনন্দন। আমরা চাই আইনটি কার্যকর হোক। 

(খসড়া নীতিমালাটি দেখুন )




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়