ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাল্পনিক ভূত-প্রেতের গল্পের অবসান হোক

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৭ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাল্পনিক ভূত-প্রেতের গল্পের অবসান হোক

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক : পৃথিবীতে যার অস্তিত্বই নেই, তাকে নিয়ে যত দুশ্চিন্তা! ভূত-প্রেতের গল্প শোনে নি এমন শিশুকিশোর পাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন? আসলে যারা ভূত-প্রেতের গল্প শোনান তারাও ভূত-প্রেতে ভয় পান। কারণ একটাই, তাঁরাও নানা-নানী, দাদা-দাদীদের কাছ থেকে ভূত-প্রেতের গল্প শুনেছেন। আবার নানা-নানী, দাদা-দাদীরাও তাঁদের নানা-নানী, দাদা-দাদীদের কাছে ভূত-প্রেতের গল্প শুনেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কেউ কখনও ভূত-প্রেত দেখেননি, শুধু শুনেছেন। যাদের কেউ কখনও দেখেনি তা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কেন? এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে মন দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ, এটা অনেকটা থেরাপি হিসেবে কাজ করে। তাতে করে অনেক কাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। ব্যাপারটা আসলে শুধুই কাল্পনিক এবং অবাস্তব গল্প মাত্র। নিচে এসব নিয়ে দুই পর্বে আসল কথাটা খুলে বলছি :

যীশুখ্রিস্টের মৃত্যুর পরের শতকে ভূত নিয়ে প্রথম গল্প লেখা শুরু হয়। এরপর গ্রিক লেখক লুসিয়ান প্লাইনি এবং প্লুটো ভূত নিয়ে গল্প লিখেছেন। সেই থেকে ভূত-প্রেত নিয়ে গল্প লেখা শুরু। ঐতিহ্যগতভাবে মানুষ আজও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করে বলেই ভূত-প্রেত নিয়ে গল্প লেখা এবং গল্প শোনা থেমে নেই। বাংলার লোকসাহিত্যে ভূতের গল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। রূপকথায় প্রায়ই ভূত-প্রেতের ধারণা ব্যবহার করা হয়। ভূত-প্রেত আসলে কোথায় থাকে? নানা-নানী, দাদা-দাদীরা গল্পে বলে থাকেন যে, ভূত-প্রেতরা নাকি ভাঙা পুরনো বাড়ি, গোরস্তান, শ্মশান, বটগাছ, গাবগাছ, তেঁতুল গাছ, শেওড়া গাছ, তাল গাছ, বাঁশ বাগান, বনের পুকুর পাড় ইত্যাদি জায়গায় থাকে। তাহলে তো ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। সব জায়গায় তো আর ভূত-প্রেত দেখা যায় না। বিশেষ করে ভালো বাড়ি, শহর-বন্দর, লোকালয়ে এসব জায়গায় তো ভূত-প্রেতের থাকার কথা নয়। এমনকি গ্রামেও এখন থাকার সুযোগ নেই। বিপুল জনসংখ্যার এদেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ঝোঁপ-জঙ্গল কেটে মানুষ বাড়িঘর বানাচ্ছেন এবং সেখানে নিশ্চিন্তে বসবাস করছেন।

শুনেছি যে, ভূত-প্রেতের ব্যাপারে নাকি স্বয়ং ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার মানুষরাও বিশ্বাস করেন! এক সমীক্ষায় তারা জানতে পেরেছে যে, ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ ভূত-প্রেত বিশ্বাস করেন। আমেরিকাতেও এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, সে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কঠোরভাবে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় কী? তাহলে এবার চিন্তা করুন যে, ব্যাপারটা আসলে কী দাঁড়ালো? তাই যদি হয় তাহলে ভূত-প্রেতরা যেসব জায়গায় বসবাস করে, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় সেসব জায়গা কী খুঁজে পাওয়া যাবে? সেখানে কী শ্মশান, গাবগাছ, তেঁতুল গাছ, তাল গাছ, বাঁশ বাগান, বটগাছ এতসবের বালাই আছে? নাকি ইংল্যান্ডের ৬৮ শতাংশ মানুষ এবং আমেরিকার ৪০ শতাংশ মানুষ সবাই গ্রামে বাস করেন। আসলে হলিউডের সিনেমা জগতের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ‘হরর ফিল্ম’। ভূত আর প্রেতের সিনেমা দেখিয়ে টাকা কামানোর ধান্দা ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতেও তার কিছু চলন আছে। সে দিক থেকে আমাদের সিনেমা জগতের মানুষদের ধন্যবাদ দিতে হয়। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, তাঁদের টাকা রোজগারের ইচ্ছা থাকলেও তাঁরা এসব পচা ছবি-টবি বানান না। দু’একটা নাটকে ভূত-প্রেতের গল্প দেখা গেলেও তা আসলে একান্তই নাটক। তবে আমাদের দেশে কিছু ওঝা আর জাদুকর কঙ্কাল-টঙ্কাল নিয়ে কিছু ভেল্কি দেখান সেটা ঠিক। এটা আসলে এক ধরনের চোখের ধাঁধা। শক্ত মানুষের পাল্লায় পড়লে তাও ঘুঁচে যাবে।

যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্করা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ভূতের আসলে অস্তিত্ব কোথায়! বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ ব্রায়ান কক্স জানিয়েছেন যে, ভূতের আসলে অস্তিত্ব নেই। যদি থাকতো তাহলে বিশ্বের সব থেকে বড় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ধরা পড়তো। মানুষের মৃত্যুর পর যদি তাঁর আত্মা প্রেতাত্মা হতো তাহলে তাও ধরা পড়তো। তিনি আসলে ভূত-প্রেত নিয়েই গবেষণা করেছেন। এরপর নিশ্চিত হওয়ার পরই তা তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। এরপরও ভূত-প্রেতের ভয় থেমে নেই। ব্যাপারটা আসলে সবই নানা-নানী, দাদা-দাদীদের তরফ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুষ্টামি থামানোর জন্য কাল্পনিক আবিষ্কার ছাড়া কিছুই নয়। তবে হ্যাঁ, দুষ্ট জ্বীনদের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। যার সত্যতাও আছে। এই দুষ্ট জ্বীনদেরকেই সনাতন ধর্মের লোকেরা আবার ভূত বলে ধারণা করেন এবং খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের তরফ থেকে ধারণা করা হয় ঘোস্ট হিসেবে। সব ধর্মের মানুষই আবার বিশ্বাস করেন যে, মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে (আত্মহত্যা, অপমৃত্যু- যারা নাকি পরবর্তীতে প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে প্রেতাত্মা হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে) তখন প্রেতাত্মা তথা ভূত-প্রেতে পরিণত হয়। এটিও আসলে এক ধরনের মনগড়া গল্প। মানুষের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা আর কখনই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে না, এটিই আল্লাহর বিধান। তবে হ্যাঁ, শয়তানের কিছু কাজকর্ম আছে সে সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। আমরা জানি যে, ইবলিস বলে এক মহা শয়তান আছে। দুষ্ট জ্বীনরা তার দলে যোগ দিয়েছে। এই শয়তান দুষ্ট জ্বীনদের দিয়ে কিছু কাজকর্ম করায় বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। ব্যাপারটা আসলে একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। মানুষ সৃষ্টির পূর্বে মহান আল্লাহ তায়ালা জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর প্রথম মানব সন্তান হিসেবে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। আল্লাহ তায়ালা তখন আদম (আঃ)-কে সিজদার জন্য জ্বীনদেরকে আদেশ করেন। ইবলিস তখন আল্লাহ তায়ালার সামনে অহংকার প্রদর্শন করে এবং আদম (আঃ)-কে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে। এরপর তিনি ‘কাফের’ হয়ে জাহান্নামী ও আল্লাহ তায়ালার অভিশাপ প্রাপ্ত হন। সেই থেকে ঐ ব্যাটা শয়তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জ্বীনদের মধ্যে ঈমানদার মুসলিম এবং কাফের জ্বীনও আছে। কাফের জ্বীনরা শয়তানের অনুসারি। এরা কিছু কিছু দুষ্টামি করে থাকে। যেমন- (১) খানজাব নামে বিশেষ একপ্রকার জ্বীন আছে যারা মানুষ যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন নানা কুচিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। যাঁদের ঈমান খুব দুর্বল তাঁদের ঈমান এই দুষ্ট জ্বীনরা অমনোযোগী ও উদাসীন করতে পারে। (২) ওলহান নামে আর এক প্রকারের জ্বীন আছে যারা মানুষকে ওযুর সময় ওয়াসওয়াসা দেয়। ওয়াসওয়াসাগ্রস্ত মানুষেরা ওযুতে ভুল করে বেশি। (৩) ক্বারীন (যার অর্থ সঙ্গী) নামে আর এক প্রকারের শয়তান জ্বীন আছে যারা অনবরত মানুষের পেছনে লেগে থাকে সঙ্গী হিসেবে। এরা সবসময় বান্দার অন্তরে কুচিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে পাপ কাজ করতে উৎসাহিত করে। পবিত্র কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ তায়ালা এইসব শয়তান জ্বীনদের কথা উল্লেখ করেছেন (সুরাতুল ক্বাফ, ১৯-২৯)।

কিন্তু তাতে কী হয়েছে? জ্বীনরা সবসময় অসাধ্য সাধন করতে পারে না। কেননা তারা ঝড়-বাদলের দিনে চলতে পারে না। কারণ, তারা আগুনের তৈরি বিধায় বৃষ্টির সময় আয়োনাজাইশেন ও বজ্রপাতের তীব্র আলোকচ্ছটায় তাদের ক্ষতি হয়ে থাকে এবং কোন ঘরে যদি নির্দিষ্ট কিছু দোয়া-কালাম ও কাঁচা লেবু থাকে, তাহলে ঐ ঘরে জ্বীন প্রবেশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জ্বীনরা ধোঁয়াবিহীন আগুনের তৈরি। আর মানুষ আগুন, পানি, বায়ু ও মাটির তৈরি। তাই তারা সব সময় সব মানুষের সাথে পেরে ওঠে না। এরা শুধু খারাপ মানুষদের ঘায়েল করতে পারে। এতো গেল মুষ্টিমেয় কয়েকটি দুষ্ট জ্বীনের কথা। এই সুযোগে বলে রাখি যে, আমাদের শরীর আগুন দিয়ে তৈরি বলেই কিন্তু শরীরে তাপ তৈরি হয়। পানি আছে বলেই শরীরযন্ত্রের তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে। বায়ু আছে বলেই আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছি। আমাদের শরীরের রক্তে অক্সিজেন (বাতাস) আছে। পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল যেমন, তেমনি আমাদের দেহেও প্রায় তিন ভাগ (প্রায় ৭০ শতাংশ) পানি আছে, যা আমরা বুঝতে পারি না। মাটি দিয়ে তৈরি বলেই আমাদের শরীরটা রক্ত-মাংসের মনে হয়। যাহোক, মহান আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য ভালো জ্বীন সৃষ্টি করে রেখেছেন। যাঁদের কাজ হচ্ছে মানুষদের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা। দুষ্ট জ্বীনরা শুধু খারাপ মানুষদেরকেই ঘায়েল করতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও কিছু নিস্তার আছে, দুষ্ট জ্বীনরা কিন্তু মোটা মানুষকে দেখতে পায় না। সুতরাং মোটা মানুষ এবং অন্যদের তারা যদি দুষ্টামি না করে তাহলে ঐসব জ্বীনরা কাউকেই নাগালই পাবে না। এই সুযোগে আপনাদের আরেকটি কথা বলে ফেলি। সেটা হলো- খারাপ জ্বীনরা সাধারণত নাপাক বা নোংরা জায়গায় থাকে। এসব জায়গায় একটুখানি সতর্ক থাকলে আর কোন অসুবিধা নেই। এদের খাদ্য কী জানেন? এদের খাদ্য হলো হাড়, গোবর, কয়লা ইত্যাদি।

এবার আমরা একটু অন্যভাবে আলোচনা করি। সেটা হলো দুষ্ট জ্বীনরা যদি ভূত সেজে আমাদের কিছু একটা করতে চায় তাহলে ভালো জ্বীনরা কী চুপ করে বসে থাকবে, কখনও না। তারা তৎক্ষণাৎ তাদের আক্রমণ করবে। কারণ, ভালো জ্বীনদের কাজ হলো ভালো মানুষদেরকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা। একটা কথা আসলে সকলের জানা থাকা দরকার, আর তা হলো- মানুষের কখনও কখনও মতিভ্রম হয়। যাকে ইংরেজিতে হ্যালুসিনেশন বলে। এই মতিভ্রম যখন ঘটে তখন আসলে মনের উপর প্রবল একটা চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে আমরা যা দেখার নয় তাই দেখে ফেলি। আর তখনই আমাদের মনের ভেতর ভয় এমনভাবে জেঁকে বসে যে আমরা তখন অন্ধকারে মরা গাছ, ঘরের চেয়ার-টেবিল, আসবাবপত্রকে একটা রূপে দেখতে পাই। এ ধরনের যখন ঘটনা ঘটে তখনই আমাদের মনের মধ্যে গল্পের ভূত-প্রেত মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এটি আসলে একান্তই বিভ্রম মাত্র। বাস্তবে কেউ কখনও ভূতের দেখাই পায়নি এটাই সত্যি। আর পরী (যাদেরকে আমরা প্রেত বলতে পারি) তারা যে কোথায় থাকে তাও জানা যায় নি। তাছাড়া, দুষ্ট কিছু মানুষও নানা অঙ্গ-ভঙ্গী করে রাতের বেলায় নানা মতলব হাসিল করার জন্য। অনেকে চুরি-ডাকাতিও করে। আর তারাই ঝোঁপ-জঙ্গলকে বেছে নেয়। তার খানিকটা দিনের বেলায়ও আমরা দেখতে পাই। কেউ পাগল সাজে, কেউ বন্ধু-বান্ধবী সেজে ছিনতাই করে, কেউ নানা ধরনের ছলচাতুরি করে টাকা রোজগার করে। এসব বিষয়ও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। ভূত-প্রেত আসলে এ ধরনের মতলববাজরা নয় তো!

(আগামী পর্বে সমাপ্য)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়