ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সংলাপ এবং ড. কামালের প্রতি জিজ্ঞাসা

কবীর চৌধুরী তন্ময় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ৮ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সংলাপ এবং ড. কামালের প্রতি জিজ্ঞাসা

আলোকচিত্র: সংগৃহীত

কবীর চৌধুরী তন্ময়: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানা দলের, নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। সেইসঙ্গে জোট-মহাজোট, যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্টের নামে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক দলগুলো একটি মঞ্চে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করে ভোটারের মন জয় করার জন্য এখানে-সেখানে বক্তব্য দিচ্ছে। সেইসঙ্গে কোন ফরমেটে নির্বাচন হবে, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে এসব বিষয়সহ নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পর যুক্তফ্রন্টের ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সংলাপের আহ্বানেও সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ‘সংলাপ’ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে- এটিই এখন প্রশ্ন। আমি সংলাপে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করছি। কারণ, আমি শেখ হাসিনাকে জানি এবং তার রাজনৈতিক দর্শন কী সেটাও আজ জাতির কাছে পরিষ্কার বলে বিশ্বাস করি। তাছাড়া অতীত কিছু অভিজ্ঞতা থেকেও বিষয়টিকে ইতিবাচক বলছি। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দুই নেত্রীর ফোনালাপের বিষয়টি। তখন নিশ্চয়ই দুই নেত্রীর কথা বলার ধরণ, একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের শিষ্টাচার, মন-মানসিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা এবং সর্বোপরী লাল ফোনের সেই ঘটনাগুলো কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।

আরকেটি দৃশ্য নিশ্চয়ই পাঠকের আরও বেশি মনে থাকার কথা। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর শুনে খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অপমান হয়ে বাড়ির দরজার সামনে থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফিরে আসার দৃশ্যটি। জানি, দেশের মানুষ তখন ছিঃ ছিঃ করেছিল। খালেদা জিয়াকে এদেশের মানুষ এক সময় প্রধানমন্ত্রী করেছিল বলে অনেকে নিজের প্রতি নিজেই ধিক্কার ছুড়েছে সেদিন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এদিকেও যাচ্ছি না। আমি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সংলাপের দিকে থাকতে চাই। আমিও চাই, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক হামলার কালো ছোবল থেকে জাতি মুক্ত থাকুক। পেট্রোল বোমার আগুন যেন আর কোনো শিশু-কিশোরের জীবন কেড়ে নিতে না পারে। বাস কিংবা ট্রাক ড্রাইভারকে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করার অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের রাজনৈতিক দল বিএনপি বেরিয়ে আসুক।

আমিও অন্য সবার মতো সংলাপ কিংবা আলোচনায় বিশ্বাসী। তবে সেটা কতপিয় রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তি স্বার্থে নয়। কিংবা কোনো জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত নেতাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর জন্যেও নয়। আমি এটাও মনে করি যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার খুনী, যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ অবলম্বনকারী অপরাধীদের মুক্তির দাবি নিয়ে কোনো সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে না। সাধারণ জনগণের মতো আমারও চাওয়া, আধুনিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতার বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ কীভাবে বিশ্বের বুকে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা বা সংলাপ হতে পারে এবং এই সংলাপে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।

ডাক্তার আর ডক্টর সাহেবের যুক্তফ্রন্ট-ঐক্যফ্রন্টের ৫ দফা আর ৭ দফা দাবির ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জাতি জানতে পেরেছে, এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত একজন অপরাধীর মুক্তির দাবি করা হয়েছে! রাজবন্দি মুক্ত করার নামে (যদিও বাংলাদেশে কোনো রাজবন্দি নেই) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি ও বিশেষ গোষ্ঠীর মুক্তি চাওয়া হয়েছে। না। আমি এই দাবি-দাওয়া নিয়েও আলোচনা করতে চাই না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামক রাজনৈতিক জোটের নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। কারণ, এই কামাল সাহেবরা নির্বাচনের সময় উদয় হন আর নির্বাচনের পরে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশ ও জাতির কোনো ক্রান্তিলগ্নে তাকে আমরা সম্মুখসাড়িতে দেখি না।

পাঠক, শুধু যে নির্বাচনের সময় তাও কিন্তু নয়। ড. কামাল হোসেনের কিছু সময়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বিদেশের মাটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার’ প্রেক্ষাপট তুলে ধরে একটা সংবাদ সম্মেলন করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও পঁচাত্তরের বর্বরতা নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানা এ প্রসঙ্গে তাকে পুনরায় অনুরোধ করলে তখনও তিনি বিষয়টি কানে তোলেননি। প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতে ইতিহাস রচনা করে। আজ শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখানে-সেখানে বক্তব্য-বিবৃতিসহ তিনি সংবাদ সম্মেলন করছেন। এখানে শুধু ‘ক্ষমতায় যেতে’ বলার কারণ, এই সাহেবরা কখনো দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেছে বলে তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের শেষ সময়ে এসেও করবেন এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না।

মনে করে দেখুন, ১/১১’র সময় এই আইনজীবী কার পক্ষ অবলম্বন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন? ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি নিয়ে যখন দেশের শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ- সব বয়সী মানুষ রাস্তায়; তখন এই আইনজীবীর ভূমিকা কী ছিল? তার জামাতা ডেভিড বার্গম্যানের মাধ্যমে তার অবস্থানই শুধু পরিষ্কার হয়নি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার বানচাল করতে এই ডেভিড বার্গম্যান রীতিমত লবিষ্ট হয়ে কাজ করেছে। এটি সর্বজনস্বীকৃত। আরেকটি ব্যাপার, সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা সেতুর তথাকথিত দুর্নীতি! দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা যখন বারবার পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে আলোচনা-সমালোচনা করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের উপর কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেছিল; তখন এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞ আইনজীবী দেশ ও দেশের মানুষের মর্যাদা রক্ষায় কী ভূমিকা নিয়েছিলেন- এই প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, যুক্তফ্রন্ট-ঐক্যফ্রন্টের বড় বড় নেতারা এত দিন কোথায় ছিলেন? দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের ভূমিকা কতটুকু? কী এমন হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর খুনের ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা থেকেও ড. কামাল সেদিন দূরে সরে ছিলেন? তিনি তো সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা। তাহলে যেদিন দেশে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি হলো তখন তার কণ্ঠ নিশ্চুপ ছিল কেন? আজ বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে দেশ ও জাতি যখন বের হয়ে এসেছে তখন তারা বলছেন ভিন্ন কথা! কিন্তু কেন? এই যে আজকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা। মামলার তদন্ত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। দেশের সকল মিডিয়ায় বিস্তারিত প্রকাশিত, প্রচারিত হয়েছে। আদালত তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর করে রায় দিয়েছেন। আপনি নিজেও একজন আইনজীবী। আইনের শাসন চাইলে একজন অপরাধী যিনি আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত, তার মুক্তির দাবি করেন কীভাবে? এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।

খুব শ্রদ্ধা করেই যেহেতু ড. কামালকে ‘চাচা’ ডাকেন, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানতে চাইতে পারেন-  চাচা, আপনি নিজেই সংবিধান প্রণেতাদের একজন। এই যে সংসদ ভেঙে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলছেন, এই দাবি কতটুকু সংবিধানসম্মত? সংলাপের আবেদনে শেখ হাসিনা তৎক্ষণাৎ যে শুধু সাড়া দিয়েছেন তাই নয়, দপ্তর সম্পাদককে নিদের্শ দিয়েছেন, চাচা কী কী খেতে চান জিজ্ঞেস করে তার একটা তালিকা তৈরি করতে। প্রতিউত্তরে তারা বলেছেন- সেখানে তারা খেতে যাবেন না! গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঠানো চিঠিতে শেখ হাসিনার বক্তব্য আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। সেখানে লেখা রয়েছে: ‘অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।’

আমি নিজেও ড. কামাল হোসেনের ভক্ত। তার প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের প্রতি আস্থাশীল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডেকে এনে কামাল হোসেনকে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। সংবিধানের কোন ধারায় কী আছে তা তিনি অবশ্যই জানেন। সুতরাং সংবিধান পরিপন্থি কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে না। জাতি সেটাই প্রত্যাশা করে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়