ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারে থাকুক উপকূল

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারে থাকুক উপকূল

রফিকুল ইসলাম মন্টু: চারদিকে ভোটের বাদ্য। গ্রামীণ বাজারের চায়ের টেবিল কিংবা শহুরে কফিশপ- সবখানে একই আলোচনা। সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা সবার। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি রাজনৈতিক দলগুলোতে। চলছে ভোটের সমীকরণ। কিন্তু ভোটে জয়ের এই সমীকরণের মাঝে প্রান্তিকের মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণের সমীকরণের কথাটা মনে করিয়ে দিতে চাই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উপকূল ইস্যু অগ্রাধিকারে থাকুক। ২০১৯ সালে উপকূলের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী যেন আরও একটু ভালো থাকতে পারে।

সংকট আর সম্ভাবনা নিয়ে সমুদ্ররেখায় জেগে আছে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল। প্রাকৃতিক বিপদ এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বহু এলাকার মানুষ এখনও জোয়ার-ভাটায় ভর করে চলেন। আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখনও নদীনির্ভর। কিন্তু সেই নদীপথে সংকটের শেষ নেই। প্রাকৃতিক ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষ সৃষ্ট ঝুঁকি। যেন আমরাই আমাদের বিপদ ডেকে আনছি। দুর্যোগ দুর্বিপাক প্রতিনিয়ত হানা দেয় উপকূলে। প্রায় সারাবছরই কোন না কোনো ধরণের দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূল। এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে উপকূলে। সব দুর্বিপাকের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এখানকার মানুষ বাঁচে, এগোয় সামনের দিকে। উপকূলের মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই উপকূলের দিকে রাজনৈতিক সুদৃষ্টি প্রয়োজন। উপকূলের কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

১) বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন: পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত অধিকাংশ স্থানেই শক্ত বেড়িবাঁধ নেই। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ থাকলেও তা বছরের পর বছর অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। নদীভাঙনের কারণে বহু এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলের অধিকাংশ দ্বীপ-চর এখনও বেড়িবাঁধের আওতায় আসেনি। এইসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর অরক্ষিত থাকছে। একই অবস্থা রাস্তাঘাটের। ফলে সামান্য ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও বাড়িঘর ডুবে যায়, ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

২) দুর্যোগ প্রস্তুতি জোরদার: দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সাফল্য দেখাতে পারলেও উপকূলে স্থানীয় পর্যায়ে এখনও রয়েছে অনেক সমস্যা। দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, আগের চেয়ে লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই প্রতিটি গ্রামে অন্তত একটি করে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র দরকার। একইসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে নারী ও শিশুদের জন্য সুষ্ঠুভাবে অবস্থানের পরিবেশ থাকা দরকার। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তার ক্ষেত্রেও অনেকের অভিযোগ আছে। অনেকে আবার বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা তারা যথাযথভাবে পান না। প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আরও সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে সজর দেওয়া দরকার।  

৩) শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন: উপকূল অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থায় একরকম দৈন্য চলছে। শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত থাকছে উপকূলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে। নদীভাঙনের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়ায় অনেক শিশু ঝরে পড়ে। এভাবে বারবার স্কুল বদল হওয়ায় অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ নেই। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাঘাট নেই। দুর্যোগের কারণে, এমনকি স্বাভাবিক জোয়ারেও অনেক এলাকায় স্কুল বন্ধ রাখা হয়। আবার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও আসবাবপত্র নেই। এরসঙ্গে যোগ হয় অভিভাবকদের অসচেতনতা ও দারিদ্র্য। অল্প বয়সে ছেলেশিশুরা কাজে যোগ দেয়, আর মেয়েশিশুদের বিয়ে হয়ে যায়। উপকূলের শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ।

৪) স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন: চিকিৎসা কিংবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র কল্পনায় এলে উপকূলের এক বিপন্নতার চিত্র ভেসে ওঠে। অনেক বার দেখেছি, মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকতে। পাশে স্বজনেরা আহাজারি করছে। আসলে তাদের কিছু করার নেই। নদী পেরিয়ে কখন ওপারে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে- সেই আশায় বসে থাকতে হয়। ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা বলা হলেও উপকূলের ২২ হাজার মানুষের জন্য একটা কমিউনিটি ক্লিনিক দেখেছি- যেখানে ডাক্তার ও ওষুধ নেই। নারীদের স্বাস্থ্য, নারীদের মাতৃত্বকালীন পরিচর্যা, নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত শিশুদের স্বাস্থ্য। কিন্তু পর্যাপ্ত সেবা ব্যবস্থা না থাকায় শিশুরা নানান রোগবালাই নিয়ে বেড়ে উঠছে।

৫) পরিবেশ সুরক্ষা: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে গাছপালা মরছে। কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাড়ছে নদীর ভাঙন। ভাঙাগড়ায় দ্বীপ চরগুলোতে এক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষ সৃষ্ট কারণ। নদী ভরাট হচ্ছে, দখল হচ্ছে, গাছপালা কেটে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পরিবেশ বিধ্বংসী শিল্প। এসব কারণে উপকূলের পরিবেশের ওপর ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। সে কারণে উপকূলের পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে।

৬) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ: কৃষিসহ উপকূলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। উপকূলের চরাঞ্চলের ঊর্বর মাটি বিভিন্ন ধরণের ফসল উৎপাদনের উপযোগী। কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ঘটতে পারে কৃষি বিপ্লব। তা সত্বেও সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ প্রান্তিক পর্যন্ত এখনও পৌঁছেনি। মহিষের দুধের রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। অন্যদিকে পূর্ব উপকূলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কিছু অংশে লবণ উৎপাদন হলেও চাষিরা পান না ন্যায্যমূল্য। মৎস্যখাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের বিরাট সুযোগ রয়েছে। শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, শৈবালসহ আরও অনেক কৃষিজ পণ্য উৎপাদন এবং তা থেকে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশ হতে পারে।

৭) পর্যটন সম্ভাবনার বিকাশ: কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবনসহ কয়েকটি বহুল পরিচিত স্থান ছাড়াও উপকূলের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন সম্ভাবনা বিকাশের বিরাট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ঘন বনে আবৃত দ্বীপচর। দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে অসংখ্য মনোরম সমুদ্র সৈকত। এসব দ্বীপচর এবং সমুদ্র সৈকত ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারে। বর্ষা মৌসুমের কয়েকমাস বাদে শুকনো মৌসুমে নদীপথে পর্যটকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারলে এবং থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে একমাত্র উপকূলই পর্যটন শিল্পের বিরাট দ্বার খুলে দিতে পারে।

৮) নদী ভাঙন প্রতিরোধ: নদী ভাঙন উপকূলজুড়ে এক স্বাভাবিক চিত্র। ক্রমাগত ভাঙনে বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের নদনদীর গতিপ্রকৃতি। বহু মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই কান পাতলে ভেসে আসে ভাঙনের শব্দ। মধ্য-উপকূলে ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, মনপুরা, চাঁদপুর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া, ঢালচর, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা অনেকে বেশি বলে সরেজমিন পাওয়া তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়। মেঘনা নদীর দু’পাড়েই ভয়াবহ ভাঙনের চিত্র চোখে পড়ে। কূল ভেঙে নদীর মাঝখানে চর জাগে, আবার ভাঙনের প্রলয়ে জেগে ওঠা সেই চরও নিঃশেষ হয়ে যায়। উপকূলজুড়ে এই ভাঙনের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রভাবিত। ভাঙন রোধে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় বরাদ্দ কাজে লাগছে না। অন্যদিকে ভাঙন কবলিত মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা যথাযথ সুফল বয়ে আনছে না।

৯) মাছধরা নৌযানের নিরাপত্তা: উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম নদী-সমুদ্রে মাছধরা। আর এই মাছধরায় তাদের বাহন ট্রলার-নৌকা। প্রতিদিন হাজার হাজার জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যায় জেলেরা। ট্রলার-নৌকার নোঙর ওঠানোর পর জেলেরা ভর করে নিয়তির ওপর। প্রথমত, এইসব মাছধরার নৌযানগুলোতে নির্মাণ কৌশলে রয়েছে ত্রুটি। কারণ এগুলো নির্মাণে বৈজ্ঞানিক কোন কলাকৌশল প্রয়োগ হয় না। এগুলো দেখার জন্য নেই কোন কর্তৃপক্ষ। ফলে যে যার মত, কম খরচে নির্মাণ করে মাছধরার নৌযান। মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলার নৌকাগুলোতে নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো লাইফ জ্যাকেট কিংবা বয়া। এমনকি বহু নৌযানে নেই আবহাওয়া বার্তা শোনার যন্ত্র। ফলে প্রতিবছর ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান কিংবা নিখোঁজ হন বহু জেলে। মাছধরায় নিয়োজিত মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

১০) সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনা: উপকূল অঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক ও উন্মুক্ত চরাঞ্চল। প্রতিনিয়তই জাগছে নতুন নতুন চর। অধিকাংশ স্থানে এগুলোর অপব্যবহার লক্ষ্যণীয়। প্রভাবশালীরা গায়ের জোরে এগুলো ব্যবহার করে। বাড়ির বা জমির সামনে দিয়ে বেড়িবাঁধের বাইরের জমির মালিকানা নিয়ে নেন তারা। জমি চাষাবাদ, জলাধারে মাছধরা সবই থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট চর এলাকা এবং নদীর সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় এগুলো যে যার মত ব্যবহার করছে। এ নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে, খুন জখমের মত ঘটনাও ঘটে। মামলা মোকদ্দমা চলতে থাকে যুগের পর যুগ। জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল অঞ্চলের মানুষদের রক্ষার তাগিদে ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই বাঁধ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাঁধের ভেতরের খালগুলো এবং বাঁধের সঙ্গে নির্মিত স্লুইজগেটগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে থাকে।

১১) নৌপরিবহনের সংকট উত্তরণ: জলরাশি বেষ্টিত উপকূলে জালের মত ছড়িয়ে আছে নদী। অধিকাংশ স্থানের মানুষ এখনও নৌপথের ওপরই নির্ভরশীল। পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের এলাকাগুলোর মানুষ সড়কপথের ওপর ভর করে যাতায়াত করতে পারলেও মধ্য উপকূলের বহু বিচ্ছিন্ন জনপদ এখনও পুরোপুরি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে কিছু এলাকা থেকে নৌ পরিবহন ব্যবস্থা উঠে গেলেও কিছু নৌপথ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সময় কিংবা জোয়ারভাটা মেপেই চলাচল করতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এইসব নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। নৌযানগুলোতে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে। একইসঙ্গে বহন করা হয় যাত্রী ও মালামাল। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বাড়িয়ে ফেলা হয় ঝুঁকি। অন্যদিকে উপকূলজুড়ে নাব্যতা সংকট বিদ্যমান। ফলে নৌচলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে আবার পণ্য পরিবহনেও বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়া কোথাও ইতিবাচক সম্ভাবনার ইঙ্গিতও দিচ্ছে। নাব্যতার ক্ষেত্রে সংকট উত্তরণ এবং সম্ভাবনা বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

১২) বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন: উপকূলের বহু মানুষ প্রাকৃতিক কারণে বাড়িঘর হারাচ্ছে। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে উপকূলের মানুষজন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বাধ্য হয়। অনেকে আবার মাটি আঁকড়ে নিজের এলাকায় থাকার চেষ্টা করে। এমন বহু পরিবার রয়েছে, যারা ১০-১৫ বার বাড়ি বদল করে অবশেষে ঠাঁই নিয়েছে শহরের কোন বস্তিতে। তিনবেলা ঠিকভাবে খাওয়া, কাজের সংস্থান, মাথা গোঁজার ঠাঁই, এমনকি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে প্রচণ্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করছে নদীভাঙন। সম্পদ হারিয়ে পথে বসে বহু পরিবার। এমন অনেক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তাদের দুর্দশার চিত্র। বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রায়ণ প্রকল্প করা হলেও তা কতটা টেকসই, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সেসব আশ্রায়ণে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নেই।

১৩) সুন্দরবন সুরক্ষা: প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গিয়ে লবণ পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের মিষ্টিপানি নির্ভর গাছপালার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি জমা হচ্ছে সুন্দরবনের ভেতরে। অন্যদিকে বনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না জোয়ারের পানি। বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের ভেতরে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন বহুবার। অন্যদিকে রামপাল সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, আবার তেল, কয়লা, সারের বার্জ ডুবে সুন্দরবনের পানি দূষিত করে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করছে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

১৪) সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি: জমি নিয়ে বিরোধের পাশাপাশি এক এলাকার সঙ্গে আরেক এলাকার সীমানা বিরোধ উপকূলে অতি পরিচিত ঘটনা। সীমানা বিরোধের কারণে বিভিন্ন এলাকায় ঘটে সহিংস ঘটনা। একই কারণে বছরের পর বছর বন্ধ থাকছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। আর নির্বাচন না হওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত থাকছে সংশ্লিষ্ট এলাকা। নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে উপকূলে যেসব সংকট বিরাজমান; সীমানা বিরোধ সেসব সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়। বিরোধপূর্ণ এলাকার দখলে থাকে প্রভাবশালীরা। বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। বিরোধ নিষ্পত্তি অত্যন্ত জরুরি।

১৫) উপকূল মন্ত্রণালয় গঠন: উপকূলের উন্নয়নের জন্যে পৃথকভাবে এদেশে এখন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এক সময় অফসর আইল্যান্ড বোর্ড গঠিত হলেও এখন আর তার কোনো অস্তিত্ব নেই। উপকূলের নাগরিকেরা কার কাছে কথা বলবে? উপকূলের মানুষের সমস্যার কে সমাধান কবে? উপকূলের অভিভাবক হিসাবে উপকূল মন্ত্রণালয় গঠন এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে উপকূলের বিভিন্ন স্থান থেকে নাগরিক সমাজ এ দাবি তুলেছে। উপকূল মন্ত্রণালয় গঠিত হলে উপকূলের সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান হবে। উপকূলের মানুষের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

১৬) উপকূল দিবস ঘোষণার দাবি: ’৭০-এর ১২ নভেম্বরের প্রলয় স্মরণে ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণার দাবি উঠেছে। ২০১৭ সাল থেকে বেসরকারিভাবে সমগ্র উপকূলজুড়ে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সরকারিভাবে এই দিনটিকে উপকূল দিবস ঘোষণা করা হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের কাছে উপকূলের গুরুত্ব বাড়বে। এরই পথ ধরে উপকূল অঞ্চলের সুরক্ষা এবং সেখানকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অধিকার ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের পথ সুগম হবে।    

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো স্ব স্ব দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে প্রচারে নামবে। যাবে ভোটারের দ্বারে দ্বারে। উপকূলবাসীর কথা এখনই বলার সময়। নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারে থাকুক উপকূল। নজর দেওয়া হোক ১৬ দফায়। আগামী বছরগুলো উপকূলের মানুষেরা আরও একটু ভালো থাকুক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়