ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন ও আমাদের আগামী

সেলিনা সিমি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন ও আমাদের আগামী

সেলিনা সিমি : বিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সূতিকাগার। সন্তানের অভিভাবক উচ্চশিক্ষিত হলেও বিদ্যালয়ই সেই জায়গা যেখানে এসে একজন শিক্ষার্থী জীবনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করে। কথাটি বলছি এ জন্য যে, শুধু পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়াই শিক্ষার্থীর জীবনের মূল লক্ষ্য নয়। শিক্ষার্থী দেশের ভবিষ্যত নীতি নির্ধারক হবে, সেবক হবে, আদর্শ লালন করবে, সর্বোপরি ন্যায়-নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজ গড়ার কারিগর হবে, হবে যোগ্যতম নাগরিক।

একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে সরকারিভাবে ‘স্টুডেন্ট কেবিনেট’ নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ছাত্র ভর্তি বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট করার লক্ষ্যে সারাদেশে ২০১৬ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একযোগে ‘স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে প্রতি বছরই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যালয় আঙিনা ও শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার, খাবার পানি সংগ্রহ, আসন বিন্যাস, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ বিদ্যালয়ে বাগান তৈরি করা ও পরিবেশ উন্নয়নসহ বিতর্ক আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্টুডেন্ট কেবিনেট বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উন্নয়নের গতিধারা সচল রাখতে সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতৃত্বের হাতে আগামীর বাংলাদেশকে তুলে ধরতে এই প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার বিকল্প নেই। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ এর নির্বাচনের লক্ষণীয় বিষয় ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু  এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী যেহেতু ভোটার এবং জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে পেরেছে বলে তাঁরা উচ্ছ্বসিত। অথচ এই নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনেই ভ্রান্ত কিছু ধারণা বিদ্যমান এবং এসব ভুল ধারণার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভোটের দিন বিদ্যালয়ে আসতে দেন না। অনেকেই ভাবছেন হয়তো শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার সরকারের এক অপপ্রয়াস। কিন্তু প্রতিটি বিদ্যালয়ে এই কেবিনেটের সফল কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সম্ভব। স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচনকে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণে না ফেলে এর নৈতিক এবং প্রায়োগিক ভালো দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টাও অপ্রতুল।

একজন শিক্ষার্থীর মাঝে গণতন্ত্রের চর্চা ও  গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই শিক্ষাই তাদের ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সহায়তা করে। স্টুডেন্ট কেবিনেটের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে  নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং বিজিত সদস্যরা পারস্পরিক গঠনমূলক সমালোচনার অংশ নিতে সক্ষম। তারা একে অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে দায়বদ্ধ। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠে মনোযোগী করা এক বড় চ্যালেঞ্জ। কেবিনেটের সদস্যরা এ কাজেও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারবে। প্রতিটি শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিয়ে কোন বিষয়ে পাঠে কমতি থাকলে সেই বিষয় শিক্ষকের সাথে কথা বলে তাদের সহপাঠীদের জন্য পাঠটি কীভাবে সহজবোধ্য করা যায় সে ব্যাপারেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

কেবিনেটের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে সহায়তা করবে। বিদ্যালয়ে অধিকতর কর্মদিবসে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে উৎসাহিত করবে। কারো পারিবারিক সমস্যা থাকলে সেসব পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি সাপেক্ষে অভিভাবক সমাবেশ করেও সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিচ্ছন্ন রাখতে শিক্ষার্থীদের সচেতন করবে এবং নিজ উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করবে। বিদ্যালয়ে এসে কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করবে অর্থাৎ তাদের মধ্যে সেবার মনোভাব তৈরি হবে ।

খেলাধূলা, গান, বিতর্ক, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদির আয়োজন এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষ এবং জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের ব্যবস্থা এবং এসব দিবসের তাৎপর্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। এখানেই শেষ নয়, ছেলেদের ইভটিজিং থেকে নিজেদের দূরে থাকতে পরামর্শ দেবে এবং কোন মেয়ে এমন সমস্যার সম্মুখীন হলে সহপাঠী হিসেবে তাদের সহায়তা করবে । আর মেয়েরা কখনো ইভটিজিং-এর শিকার হলে প্রতিরোধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে। এদের সচেতন হতে হবে । কারণ অনেক মেয়ে লজ্জার ভয়ে ইভটিজিং-এর কথা কাউকে জানাতে পারে না, যা ভবিষ্যতে বড় বিপদ ডেকে আনে। আর মাদক আমাদের সমাজে এক বড় অভিশাপ, যা উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের জীবন ধ্বংস করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সম্ভব। মাদকের ক্ষতিকর দিক নিয়েও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে ভূমিকা রাখতে পারে স্টুডেন্ট কেবিনেটের সদস্যরা।

তাই ‘স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন’-এর মাধ্যমে একটি বিদ্যালয় এবং সেখানকার শিক্ষার্থীরা সারাদেশের মধ্যে আদর্শ হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে সক্ষম হবে। আজ জিপিএ ফাইভের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখোমুখি। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সম্ভবনা দেখতে চাই। চাই, তারা নৈতিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সম্পূর্ণ মানুষে পরিণত হবে। যাদের কাছ থেকে ঘুণে ধরা সমাজ টেকসই ভবিষ্যতের আশ্বাস পাবে। আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই, রঙিন আলোয় আলোকিত একটি সুন্দর সমাজ পেতে চাই, চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আদর্শবান নেতৃত্বের হাতে দেশকে সুরক্ষিত দেখতে।

লেখক : শিক্ষক ও যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়