ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বন্ধু, খুব কি তাড়া ছিল?

ফারুক মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৩, ৬ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বন্ধু, খুব কি তাড়া ছিল?

ফারুক মাহমুদ : সুবলকুমার বণিক। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ‘শ্রেণীবন্ধু’। আজ সে চলে গেল অনন্ত জীবনের পথে। ঢাবির বাংলা বিভাগে আমাদের ব্যাচে সুবল এবং সিদ্দিকুর রহমান ছিল সেরা ছাত্র। আমরা ঈর্ষা নিয়ে দেখতাম, সুবল ক্যাম্পাসে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমাদেরই সহপাঠিনীদের সঙ্গে ঘুরছে। তখন এই উদ্যান এতোটা গোছানো ছিল না। সুবলের জীবন, ভাবনা, আচরণ ছিল মার্জিত। আমরা ভাবতাম মেয়েরা ওকে এতো পছন্দ করে কেন? পরে জেনেছি সুবলের কাছ থেকে ক্লাস নোটস নেয়াই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। সুবল ছিল ক্যাম্পাসে মেধাবী, রুচিস্নিগ্ধ মানুষ; আমরা তাকে সমঝে চলতাম। পরবর্তী সময়ে সে হয়ে উঠল আমাদের গুরুবন্ধু। শুদ্ধ লেখায় তার ছিল অতল পাণ্ডিত্য। সে ছিল নিষ্ঠাবান সম্পাদক, সুলেখক।

সুবল বণিকের মৃত্যুতে দেশ হারাল এক বিদগ্ধ পণ্ডিত, আমি হারালাম অকৃত্রিম বন্ধুকে। নিজের কবিতার এক ছত্রও আমার মাথায় থাকে না। দেখা হলে, সুবল শোনাত আমার অনেক কবিতাংশ। অবাক হতাম- কতো  আগের কবিতা! আমি হয়ত ভুলে গেছি, সুবলের ঠিক মনে আছে! কতো শব্দের শুদ্ধ বানান যে তার কাছ থেকে জেনেছি!  সুবলের সম্পাদনার হাত ছিল স্বচ্ছ। এই তো কদিন আগে, সকালবেলা সুবলের ফোন। বলল, তোমার কবিতাটা ভালো। তবে দুটো বাক্য ছেটে ফলতে হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন হচ্ছে, সুবল সেই সংকলনের অন্যতম সম্পাদক। ফোন পেয়ে আমার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার দশা- বলে কী! এই বয়সে এসে সম্পাদকের ইচ্ছায় কবিতার অঙ্গচ্ছেদ ঘটাতে হবে! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওর সংকলনে কবিতা ছাপতে বারণ করে দেব।

বিষয়টি নিয়ে সারাদিন ভাবলাম। সন্ধ্যায় আবার সুবলের ফোন- কিছু তো জানালে না? ততক্ষণে আমার রাগ পড়ে গেছে। বললাম, যা ভালো মনে করো, করে দাও। দুদিনের মধ্যেই হাতে এলো ঢাউস আকৃতির একটি চমৎকার সংকলন। আমার কবিতাটি ছাপা হয়েছে সুবলের প্রস্তাবিত দুটি ছত্র ছাটাই করে। কয়েকবার পড়লাম। মানতেই হলো, ওই দুটি লাইন ছিল মেদবহুল। সুতরাং সুবল ঠিক কাজটিই করেছে। একেই বলে খাঁটি সম্পাদকের চোখ! অথচ এই দেশে একুশে গ্রন্থমেলায় যত বই ছাপা হয় তার সিংহভাগ অসম্পাদিত বই। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক নেই। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে সুবলকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। সম্পাদনা যে কত বড় ব্যাপার সুবল আমাদের সেটি দেখিয়েছে। ওর কাছ থেকে আমাদের আরো অনেক নেয়ার ছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের এরকম দেরি প্রায়ই হয়। আমাদের তখন অনুশোচনা করা ছাড়া উপায় থাকে না। 

সুবল এক সময় ব্র্যাকের ‘সাত রং’ সম্পাদনা করেছে। চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকেও ওর সম্পাদনায় শিশু সাহিত্যের চমৎকার সব কাজ হয়েছে। এই কাজগুলোই সাক্ষ্য দেবে সেখানে তার কতটা ভালোবাসা ছিল। বাংলা ভাষা, সাহিত্যের প্রতি মমতা না থাকলে এভাবে এতো একাগ্রতা নিয়ে কাজ করা যায় না। আমি যে কয়েকটি ‘কিশোর কবিতা’ লিখেছি, এর পেছনে ছিলো সুবলের নাছোড় তাগিদ। দেখা হলেই বলত, এ লেখাগুলো চালিয়ে যাও- বলা যায় না, কিশোর কবিতায়ও টিকে যেতে পারো। আমি হাসতাম। দেখতাম, ওর চোখ বলছে- হ্যাঁ, আমি বুঝেই বলছি। তাগাদা দিতো একটা কিশোর কবিতার বই করার। আমি ওর কথা কানে তুলিনি। কী অবাক কাণ্ড! আজ, মনস্থির করে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমার কিশোর পদ্যগুলো যখন গোছগাছ করছি, টেলিফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো কান্নাভেজা কণ্ঠ- সুবল আর নেই।

সুবলকুমার বণিক। প্রিয় সুবল, বাংলার বাতাসে, মাটিতে মিশে যাওয়ার আগেই, তোমাকে কথা দিচ্ছি- তোমার কথা রাখব, কিশোর পদ্য লেখা আমি ছাড়ব না। বইও হবে। ভালো থেকো- ও বন্ধু আমার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়