ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সোনালী ট্রফি, তুমি কার!

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০১, ৩১ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সোনালী ট্রফি, তুমি কার!

তিনটে ঈষৎ বাঁকানো দণ্ডের ওপর দাঁড় করানো একটা বল।
খুবই সাদামাটা একটা ট্রফি। চাইলে যে কেউ এমন একটা ট্রফি বানিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এই ট্রফি তো বানানো যায় না, এই ট্রফি কেনা যায় না। কারণ, এটা বিশ্বকাপ; ওয়ানডে বিশ্বকাপ!
এই একটা ট্রফির জন্য কতো হাহাকার, কতো চেষ্টা, কতো জল্পনা, কতো কল্পনা। চার বছর ধরে অপেক্ষা চলে এই ট্রফির লড়াই দেখার জন্য। সময় ঘুরে আবার চলে এসেছে সেই লড়াইয়ের সময়। ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডে আবার বসেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর। এবার বিশ্বের সেরা দশটি দল লড়াই করবে এই ট্রফির জন্য।
এবার শেষ অবধি ট্রফিটা কার হাতে উঠবে?
বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলছেন, এবার যেহেতু সেরা দলগুলোকে নিয়েই লড়াইটা হচ্ছে, তাই ফেবারিটের তালিকা থেকে কাউকে ছেটে ফেলার উপায় নেই। সবচেয়ে বেশি ফেবারিট ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে নবীন দল আফগানিস্তান; সবাইকেই লড়াইতে রাখতে চাইছেন বিশেষজ্ঞরা। বলা হচ্ছে, এবার কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।
তারপরও ফেবারিটদের একটা তালিকা হচ্ছে বই কী! তবে এই তালিকাও এলোমেলো করে দিতে পারে অন্য দলগুলো। বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানের মতো যারা ‘আউট সাইডার’ আছে, তারা বড় দুই চারটে ম্যাচ জিতে ফেললে এলেমেলো হয়ে যাবে সব হিসেব নিকেশ।
এতো কিছুর পরও আমরা চেষ্টা করছি, এবারের বিশ্বকাপের সম্ভাব্য সেরা দলটাকে খুঁজে বের করতে। বিশ্বকাপের আগে আগে কয়েক বছরের পারফরম্যান্স, ইংলিশ কন্ডিশনে দক্ষতা এবং চাপ নেওয়ার ক্ষমতা বিচার করে অন্তত সেরা চারটি দল বেছে নেওয়া যাক। বিশেষ কোনো বিপাক না ঘটলে এদের মধ্যেই কারো হাতে থাকার কথা বিশ্বকাপের সেই ট্রফিটা!
 

ইংল্যান্ড

এবার বিশ্বকাপটাকে বলা হচ্ছে ইংল্যান্ডের সেরা সুযোগ।
ইংল্যান্ড এই ক্রিকেট খেলাটি আবিষ্কার করেছে, সেটাকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। একটা সময় এই খেলাটিতে রাজত্বও করেছে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার, এই খেলাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ট্রফি কখনো স্পর্শ করতে পারেনি তারা। অবশেষে তাদের সামনে সেরা সুযোগটা নিজেদের মাটিতে এসেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বেশীরভাগ বিশেষজ্ঞের কাছে এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ফেবারিট তাই ইংলিশরাই।
ইংল্যান্ডকে এবার সবচেয়ে বেশি ফেবারিট মনে করার কারণ, খেলাটা তাদের মাটিতে। ইংল্যান্ডে এখন গ্রীষ্মের শুরু। এই সময় ইংল্যান্ডের উইকেট কেমন আচরণ করবে, তা ইংলিশদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বলা হচ্ছে, এবার ইংলিশ গ্রীষ্মে রানবন্যা হবে। তার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়াও গেছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-পাকিস্তান সিরিজে প্রায় সবগুলো ইনিংসে ৩৫০ পার করা স্কোর হয়েছে। আর ইংল্যান্ড সেখানে শেষ হাসিটা হেসেছে। 
নিজেদের মাটিতে এর আগেও বিশ্বকাপ খেলেছে ইংল্যান্ড। বলা ভালো, সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ তাদের মাটিতেই হয়েছে। কিন্তু তার কোনোবারই এমন ফেবারিট ছিলো না ইংল্যান্ড। ফলে শুধু ঘরের মাটি বলেই ইংল্যান্ড ফেবারিট, এমন মনে করার কারণ নেই।
ফেবারিট হওয়ার অন্যতম কারণ, তাদের ভয়ানক ব্যাটিং লাইন আপ এবং দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ বোলিং। সেই সাথে দারুণ ক্ষিপ্র ফিল্ডিং আছে দলটির। অধিনায়ক এউইন মরগ্যান, জো রুট, ওপেনার জনি বেয়ারস্টো, জস বাটলার, জেসন রয় আছেন ভয়ানক ফর্মে। সেই সাথে যোগ করুন মার্ক উড, ক্রিস ওকস, বেন স্টোকসদের বোলিং। ইংলিশ বোলিংকে আরও ভয়ানক করেছেন সম্প্রতি দলে যোগ দেওয়া বারবাডোজের খেলোয়াড় জোফরা আর্চার। দলটিতে আছেন মঈন আলী, আদিল রশীদের মতো স্পিনাররা। সবচেয়ে বড় সম্পদ তাদের এক ঝাক অলরাউন্ডার। স্টোকস, কুরান, ওকস, মঈন; সবার ব্যাটে প্রচুর রান আছে। আর এর ফলেই আদিল রশীদ গর্ব করে বলতে পারেন, ‘কোনো দল আমাদের বিপক্ষে ৩৭০ করে ফেলতে পারে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস আছে, আমরা সেটাকে পার করে ফেলতে পারবো।’

 

অস্ট্রেলিয়া

বিশ্বকাপ এলেই এই দলটা কোত্থেকে যেনো উড়ে এসে দাবিদার হয়ে যায়!
নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে ২০০৭ সাল অবধি অস্ট্রেলিয়া সব ধরনের ক্রিকেটের অবিসংবাদিত সেরা ছিলো। তাদের সেই সময়ের ট্রফি জয়গুলো তাই খুব একটা বিস্ময় তৈরি করে না। কিন্তু দেখুন, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল অবধি সেরকম কোনো সাড়া শব্দ ছিলো না অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু ২০১৫ সালে শেষ হাসিটা তারাই হাসলো। আবার ২০১৫ সালের পর থেকে দুর্দশায় পেয়ে বসলো এই দলটা। শেষ বছর দুই তো খুব খারাপ সময় গেছে। বল টেম্পারিংয়ে নিষিদ্ধ ছিলেন দলের সেরা দুই তারকা স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার। একটা সময় মনে হচ্ছিলো, ২০১৯ বিশ্বকাপে অন্তত ফেবারিটের তালিকায় থাকবে না অস্ট্রেলিয়া।
কিন্তু হায়! সেই অস্ট্রেলিয়া প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছে! স্মিথ-ওয়ার্নারকে ছাড়াই ফর্মে ফিরেছে অস্ট্রেলিয়া। ভারত সফরে খোদ ভারতকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়ে গেছে তারা ৩-২ ব্যবধানে। এরপর আরব আমিরাতে পাকিস্তানকে করেছে হোয়াইট ওয়াশ। এই প্রবল দাপট দিয়ে তারা জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকাপের জন্য তারা তৈরি। দারুণ ফর্মে ফিরেছেন অ্যারন ফিঞ্চ, উসমান খাজা, শন মার্শ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলরা। এর সঙ্গে অ্যাডাম জাম্পা, মিশেল স্টার্ক, নাথান লিওন, প্যাট কমিন্সরা মিলে তৈরি করেছেন ভয়ানক এক স্কোয়াড। কিন্তু আসল মধুর সমস্যাটা তৈরি হলো এরপর। দলে ফিরলেন ওয়ার্নার ও স্মিথ।
ওয়ার্নার আইপিএল-এ রেকর্ড পরিমানে রান করে বুঝিয়ে দিলেন, নিষেধাজ্ঞা তার ফর্ম কেড়ে নিতে পারেনি। অন্য দিকে স্মিথ দলে এসে সবগুলো প্রস্তুতি ম্যাচে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। এখন সমস্যা হলো, অস্ট্রেলিয়া কাকে রেখে কাকে খেলাবে। যেমন ওপেনার হিসেবে নামার কথা দুই জনের। কিন্তু ভয়ানক ফর্মে আছেন ওয়ার্নার, ফিঞ্চ ও খাজা। অস্ট্রেলিয়া স্কোয়াড নিয়ে যতোই সমস্যাই থাকুক, এটা প্রমাণ করে যে, তারা আসলে আরেকটা ট্রফি উঁচু করে ধরতে তৈরি।

 

ভারত

গত কয়েক বছর ধরেই ভারত সব ধরনের ক্রিকেটে, বিশেষ করে ওয়ানডেতে সর্বজয়ী একটা দলে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে তারা বিশ্বকাপও জিতেছে। এরপর ধোনি দলে থাকতেও দলের অধিনায়ক হয়েছেন বিরাট কোহলি। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দলটা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তাদের সিরিজ হারিয়ে এসেছে। আর এই দলটায় গুণগত একটা পরিবর্তন হয়েছে-ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভরসা করার মতো একটা পেস আক্রমণ পেয়েছে ভারত। আর এটাই ইংল্যান্ডের মাটিতে ফেবারিট করে ফেলেছে এই দলটিকে।
ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা নিশ্চয়ই তাদের ব্যাটিং। এই সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি স্বয়ং আছেন এই ব্যাটিংয়ের নেতৃত্বে। ওপেনিংয়ে রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান এই সময়ের সেরা দুই ওপেনার। মিডল অর্ডারে মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটে এখনও মরিচা পড়েনি। সাথে তরুণ হার্দিক পান্ডিয়া, বিজয় শঙ্কররা যোগ হয়েছেন। দলটির ব্যাটিংয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিলো চার নম্বরে কে ব্যাট করবেন? সেই চিন্তাও দূর করেছেন লোকেশ রাহুল। আইপিএল-এ দারুণ ফর্ম টেনে এনেছেন জাতীয় দলেও। ফলে ভারতের ব্যাটিং এখন নিশ্ছিদ্র বলে দাবি করা যায়। 
তবে ভারতকে এখনকার ভারত করেছে তাদের বোলিং। দলটির অন্যতম দুই সম্পদ হলো দুই স্পিনার কুলদীপ যাদব ও যুজুবেন্দ্র চাহাল। তবে স্পিনারের সংকট তো তাদের কোনোকালেই ছিলো না। আসল ব্যাপারটা হলো পেস বোলিং। কোহলির এই দলটা ভারতীয় ইতিহাসের যে কোনো দলের চেয়ে আলাদা, কারণ এই দলে অন্তত তিন জন ম্যাচজয়ী ফাস্ট বোলার আছেন। জসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি ও ভুবনেশ্বর কুমারই আসলে ভারতীয় দলকে এবার বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট করে তুলেছে।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা

এই চতুর্থ দলটি নিয়ে অনেকেই সংশয়ে আছেন। কেউ বলছেন, নিউজিল্যান্ড। কেউ বলছেন, দুরবস্থা কাটিয়ে চতুর্থ দল হয়ে উঠতে পারে পাকিস্তান। কেউ বলছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবাইকে চমকে দিয়ে সেরা চারে চলে যেতে পারে। কিন্তু অবস্থা গতিকে মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপের চতুর্থ ফেবারিট হওয়া উচিত আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার।
এই দক্ষিণ আফ্রিকা দলটি বিশ্বকাপ খেলা শুরু করেছে ১৯৯২ সালে। সেই থেকে প্রতি আসরেই তারা ছিলো সেরা ফেবারিট। আর প্রতি আসরেই ভুতুড়ে কোনো একটা ভঙ্গিতে তারা নক আউট পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে। ফেবারিটের চাপটা তারা কখনো নিতে পারেনি। আর এটাই এবার দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে কাজ করতে পারে। এই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা ফেবারিটের তকমা ছাড়া বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে। ফলে এবার চাপে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই তাদের। আর এটাই তাদের সেরা ফলটা বের করে আনতে পারে। ফাফ ডু প্লেসির দলের প্রতিভা নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। কেবল সেটা কাজে লাগাতে পারলেই প্রথমবারের মতো সোনালী ট্রফিটা জয় হয়ে যেতে পারে।

 

এবং বাংলাদেশ

বাংলাদেশের আলোচনা কী ফেবারিটদের সাথে করা চলে?
হিসেবটা খুব কঠিন। সাধারণ হিসেব বলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয়ের জন্য ফেবারিট নয়। এমনকি সেরা চারেও থাকার কথা নয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশ হয়তো চারটে ম্যাচ জিতবে। সেরা ফল করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হারানোর কথা বাংলাদেশের। আচ্ছা? এটুকুই?
এখানেই থামবেন না। একটু দৃষ্টিটা প্রসারিত করুন। দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ড বা ভারত বা অস্ট্রেলিয়াকে কী আমরা হারাইনি। আরেকবার সেটা হয়ে যেতে পারে না এই বিশ্বকাপে। এর থেকে দুটি দলকে হারাতে পারলেই তো সেমিফাইনাল। আর সেমিফাইনাল বা ফাইনালে কী হয়, সেটা কী আগে থেকে বলা যায়!
তাই আসুন, ফেবারিটের ছোট্ট তালিকাটায় আপাতত আমরা বাংলাদেশের নামটাও লিখে রাখি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়