ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মাহফুজুর রহমানের গান ও আমাদের চিন্তার দৈন্য

ইমরান মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ৩ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাহফুজুর রহমানের গান ও আমাদের চিন্তার দৈন্য

|| ইমরান মাহফুজ ||

সমাজের প্রতিটি মানুষ বড় ক্যানভাসের এক গল্পগ্রন্থ। সময়ে-অসময়ে দেখে ঠেকে পড়লে অজানা অনেক কিছু জানা যায়। এর বাইরে আড্ডা ও বিভিন্ন আলাপের মাধ্যমেও তাদের জীবন পড়া যায়। পরিচয় পাওয়া যায় চিন্তা ও রুচিশীলতার। এসব জানার জন্য এক দশকের বেশি সময়ে যোগ হয়েছে ফেসবুক; এর মাধ্যমেও কম জানা যায় না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে মাহফুজুর রহমান আলোচিত নাম। অথচ সাধারণ একজন মানুষ থেকে তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজকে মিডিয়া উদ্যোক্তা হয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আপনার আমার মতো সাধারণ পরিবারের অনেক মানুষ। তার মানে উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সফল। শুনেছি মানুষ হিসেবেও অসাধারণ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

তিনি গান করেন; যা আপনার ভালো লাগে না। পরিষ্কার ভাবনা হতে পারে- আপনার ইচ্ছে হলে তার গানের অনুষ্ঠান  দেখবেন, না হলে দেখবেন না। আপনি যে ফেসবুকে ইচ্ছেমতো পোস্ট করেন, কেউ বাঁধা দেয়? না।

আমাদের মনে রাখা উচিত মানুষ সব জায়গায় সফল হয় না। তবে আপন মনে নিজের আগ্রহ আর ভালো লাগা থেকে যে কেউ ইতিবাচক বিষয় চর্চা করতেই পারে। তাকে বাধা দেয়া কিংবা অহেতুক মন্তব্য করা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। এভাবে আমরা প্রতিদিন রক্তাক্ত হই, হচ্ছি। বলতে পারি- কোথায় কার কাছে বলি- সব জায়গায় খুঁত, নিজের মধ্যেও হয়তো খুঁত। কিন্তু পারি না নিজের খুঁত ধরতে। এটাও একটা রোগ। সময় নিয়ে ভাবুন।

খ.
ধরে নিলাম আপনি প্রতিক্রিয়াশীল। তাহলে একটু ফিরে তাকাই- গতবছর নেপাল ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনার পর ব্যাপক সমালোচনা হয় সারাদেশে। যে জীবনে একবার প্লেনে উঠে নাই, সেও অসাধারণ অভিজ্ঞতা বয়ান করেছে ফেসবুকে। ধুয়ে দিয়েছে পাইলটকে! ভাগ্যিস পাইলট মারা গেছেন। না হলে আমাদের অযৌক্তিক সমালোচনা সহ্য করতে না পেরেই হয়তো মারা যেতেন। কিন্তু গতমাসে মিয়ানমারে ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দরে অবতরণকালে বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে বাইরে চলে যায় একটি বিমান। কিন্তু একজন মানুষও মারা যায়নি। যাত্রীরা জানায় পাইলটের দক্ষতার কারণে বেঁচে গেছেন তারা। এই অসাধারণ কাজের জন্য তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন? পোস্ট দিয়ে মতামত জানিয়েছেন?

কেন জানান নি? শুধু খারাপ বা অপছন্দের কাজ নিয়ে বললেন- ভালো কাজ নিয়ে আপনার অবস্থানটা কী!

কেবল সাগর-রুনি, তনু-নুসরাত, সেপুদা, হিরো আলম, রূপপুর বালিশ আর কৃষিক্ষেতে ধান কাটার ছবি নিয়ে আলাপ ছাড়া দেশে আর কিছু ভাবনার নেই? একটু দেয়াল টপকে ভাবা যায় না? মূল বিষয়টা আর একটু পরিষ্কার করি- এবারের নিবার্চনে বগুড়া থেকে হিরো আলম প্রার্থী হওয়ায় প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কিন্তু সে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মো. ইদ্রিস আলী। তিনি ঢাকা-১৯ আসনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন। শুধু প্রতিবন্ধীই নন, তিনি এই নর্বাচনের কনিষ্ঠ প্রার্থীও ছিলেন। তার বয়স ২৫ বছর ১ মাস ২০ দিন ছিলো। তাকে নিয়ে বলেছেন?

সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনে পরকালে বিশ্বাস করেন না- এমন মন্তব্য করেছেন অভিনেত্রী সাফা কবির। (তোপের মুখে অনুতপ্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।) তাকে নিয়ে ফেসবুকজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা। নানান জ্ঞান বিজ্ঞানে কোরআন হাদিসে তাকে দোজখে পাঠিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছেন। কিন্তু খবর নিয়ে দেখবেন- আপনার বাসার পাশে বা রাস্তার পাশে অনেকে আছে যারা আল্লাহ খোদাকে সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করে, তারা নানা কষ্টে আছে, অভাবে আছে। তাদের কথা তো আপনি একদিনও ভাবলেন না!

গত কয়েক বছর মাহফুজুর রহমান নিজের চ্যানেলে গান করেন। আপন মনে প্রচার করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে জানিয়েছেন নিজের ভালো লাগা থেকেই তিনি গান গাইছেন এবং তিনি গেয়েই যাবেন। অথচ তার সমালোচনায় আমরা মুখর।  নাক পরের যাত্রা ভঙের মতো। একবার ভাবুন তো- আপনি তার সমালোচনা করে অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন না তো?

আবৃত্তিশিল্পী শহিদুল ইসলাম পোস্ট করেছে: ‘আপনারা চাটুকার, তেলবাজ, অযোগ্য, দলকানা, নিপীড়ক সাংস্কৃতিক কর্মী, বোদ্ধা কাউকে নিয়ে কথা বলতে ভয় পান, সৎসাহস নেই। অথচ মাহফুজুর রহমানকে নিয়ে কথা ঠিকই বলেন। এই লোকটা তো চাটুকারিতা, তেলবাজি, দলবাজি করে জায়গা নিয়ে আরেকজনের সুযোগ নষ্ট করছে না। নিজে মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছে গাচ্ছে। আপনার কি? তাঁর জন্য কারো জায়গা নষ্ট হচ্ছে না। আপনারা নীতিহীন। আগে অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলার সৎসাহস অর্জন করেন। তেলবাজি, দলবাজিকে শ্রদ্ধা কিংবা বিনয় বলে যে বাজারে বিকোয় সেটা শিল্পের আঙিনা না। হিরো আলম কিংবা মাহফুজুর রহমান আপনাদের থেকে অনেক ভালো বলে মনে করি। আপনার ভালো না লাগলে এড়িয়ে যান।’

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয় : সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা তারকা বনে যাচ্ছেন তাদের বেলায় একটাই সমস্যা। কোনো একটা ছবি বা কোনো একজনের গল্প সেখানে মুহূর্তেই ভাইরাল হয় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি অতীতে কী করেছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনেই তাকে লোকজন নায়কে পরিণত করছে। অন্যদিকে দেশের জানা ও বোঝার  মতো প্রকৃতগুলো আড়ালে থেকে যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

গ.
একুশ শতকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয়েছে অবকাঠামোর দিক দিয়ে। কিন্ত মনন বা মানসিক ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। সত্য বলতে পারি না। মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। যার ফলে চারপাশে ভয়াবহ সমাস্যা থাকলেও চেপে যাই। হাজারো প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার একটু গড্ডলিকায় গা ভাসানোর মতো বিষয়ে পেলে সমালোচনায় মেতে উঠি। সময় পর্যবেক্ষণে বলা যায়- অবসাদগ্রস্থতা নগরীর মানবিক রোগের নাম। যাপিত জীবনে নৈতিকতা-মূল্যবোধ মানব অস্তিত্বের বড় দিক হলেও প্রকটভাবে সংকটও তৈরি হয়েছে। যোগ করেছে, সৃজনশীল সাহিত্য শিল্পের নগরে মোড়ে মোড়ে জমাট বেঁধে নেড়ি কাকের অহেতুক চিৎকার আর চেঁচামেচিতে অস্তিত্বকর পরিবেশ। প্রকৃত মূল্যবোধের কাঠামো ভেঙে যে বুদ্বুদ তোলার চেষ্টা চলছে, তাতে মনো-রাসায়নিক দুর্গন্ধসহ পরিবেশ দূষণের আশঙ্কাই শুধু বাড়ছে। সৃজনশীল মতামতের নামে কিছু তোষামোদকারী কিংবা সুবিধাবাদী লোকের আখড়ায় সমাজ আজ বেগতিক। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনের দৃশ্য-অদৃশ্য ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক বিচিত্র দহন থেকেই সৃজনশক্তি প্রলুব্ধ হয়ে ভেসে আসুক ভিন্ন স্বর। নির্মিত হোক নতুন পৃথিবী। মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজ্জার একটা গল্প দিয়ে শেষ করি-

হোজ্জার গাঁয়ের যিনি মোড়ল, তিনি একটা কবিতা লিখেছেন। হোজ্জাকে তিনি পড়ে শোনালেন। নিজের লেখা সম্পর্কে বেশ উঁচু ধারণা পোষণ করেন মোড়ল সাহেব। গদগদ কণ্ঠে হোজ্জার কাছে জানতে চান, তা, আমার কবিতাটা কেমন লাগল? বেশ ভালো লেগেছে নিশ্চয়ই।

হোজ্জা গম্ভীর। তিনি সোজাসাপটা জবাব দেন, নাহ, মোটেও ভালো লাগেনি আমার। পচা কবিতা।

এ কথা শুনে মোড়ল বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। রাগের চোটে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। কড়া শাস্তি দিলেন হোজ্জাকে। টানা তিনদিন জেলে বন্দি থাকতে হবে তাকে।

পরের সপ্তাহের ঘটনা। মোড়ল হোজ্জাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তার দপ্তরে। নতুন একটা কবিতা লিখেছেন তিনি। সেটা বেশ ঘটা করে পড়ে শোনালেন। হোজ্জার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, কী, এই কবিতাটা কেমন লিখেছি? এই কবিতা সম্পর্কে এখন আপনি কী বলবেন?

নাসিরুদ্দীন হোজ্জা চুপ। তার মুখে কোনো কথা নেই। মোড়লের কথা শোনার কয়েক সেকেন্ড পর তিনি হাঁটা ধরলেন। মোড়ল অবাক। জানতে চাইলেন, আরে, আরে! কী ব্যাপার? হোজ্জা, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

জেলে। হোজ্জার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

গল্পটা সময়ের সঙ্গে মেলাতে পারেন। আপনি চাইলে জেলেও যেতে পারেন, অথবা স্বাধীনভাবে অন্যকাজে মনোযোগী হতে পারেন। দিন শেষে আমরা তো সবাই ভালো থাকতে চাই, সুন্দর থাকতে চাই- তাহলে সমাজে সুন্দর মানসিকতার প্রমাণ রেখে যেতে সমস্যা কোথায়? আপনার সুন্দর কাজের মাধ্যমে সুন্দর ভাবনা ছড়িয়ে দিন। অহেতুক, অযৌক্তিক সমালোচনা শুধু সমাজ নষ্ট করে না, এতে আপনার সময়েরও অপচয় ঘটে।

লেখক: কবি, গবেষক ও সম্পাদক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়