ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঈদের গতিশীল বাজার- অর্থনীতি জালনোট মুক্ত হোক

রিয়াজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৪ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদের গতিশীল বাজার- অর্থনীতি জালনোট মুক্ত হোক

রিয়াজুল হক : দুটো ঘটনা দিয়েই শুরু করি। ঘটনা এক- ইফতারির পরপর দুজন ভদ্র মহিলা ছোট একটা জামা-কাপড়ের দোকানে ঢুকল। দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। পরের দিন ঈদ। প্রায় পঁচিশ হাজার টাকার জামা কাপড় কিনল। ঈদের দুদিন পর দোকানদার বাকীতে কিনে আনা কাপড়ের দাম পরিশোধের জন্য যখন ব্যাংকে টিটি করতে গেল, পঁচিশ হাজার টাকা জাল ধরা পড়ল।

ঘটনা দুই- গত বছর ঈদের বাজারে রফিক (ছদ্ম নাম) একটা প্যান্ট কেনার পর দুই হাজার টাকা দোকানদারকে দিল। যথারীতি দোকানে প্রচণ্ড ভীড় ছিল। প্যান্টের দাম ছিল ১৩৫০ টাকা। দোকানদার একটা ৫০০ টাকা, একটা ১০০ টাকা এবং একটা ৫০ টাকা ফেরত দিল। দোকানের ভেতর অনেক ভিড় থাকার কারণে মানিব্যাগে টাকা না রেখে রফিক বুক পকেটে ৬৫০ টাকা রাখল। কেনাকাটা এখনো বাকি আছে। অন্য একটি দোকানে টি-শার্ট কেনার পর যখন বুক পকেটের ৫০০ টাকা মূল্য দিতে গেলেন, দোকানদার সেটাকে জাল টাকা বলে ফেরত দিলেন। রফিক বুঝতে পারল, আগের দোকানদার এই ৫০০ টাকা দিয়েছে। সেই দোকানে গেল। দোকানদারও জাল টাকার কথা অস্বীকার করল। দোকানদার ইচ্ছা করে জাল নোট দিয়েছিল কি না, সেটা বোঝা গেল না। কিন্তু ক্ষতিটা রফিকেরই হয়েছিল।

সামনেই ঈদুল ফিতর। ঈদ মূলত মুসলমানের উৎসব হলেও আমাদের দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার মাঝে এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই উৎসবে যোগ দেয়। ঈদ এখন সবার আনন্দ হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই বড় হচ্ছে দেশের ঈদের বাজার অর্থনীতি। ঈদের বাজার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পূর্বে পোশাক, কসমেটিকস কিংবা জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন মানুষ ঘরের আসবাবপত্র, ফার্ণিচার সামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য, গাড়ি পর্যন্ত কিনছে। সবখানেই প্রচন্ড ভিড়। ভালোভাবে দেখেশুনে কেনার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। পাইকারি কিংবা খুচরা সবখানেই ভিড়। আর এই ভিড়ের মধ্যেই জালনোট কারবারীরা তাদের অসাধু কারবার করে নেয়। অনেক সাধারণ মানুষ ঈদ উপলক্ষে ছোট খাটো ব্যবসা করে থাকে। কিন্তু জাল কারবারীদের কারণে মূল পুঁজিটুকুও ফেরত পান না।

সাধারণ মানুষের কিছুটা সচেতনতার অভাব এবং জাল নোট কারবারিদের নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এই সমস্যা সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যেকেরই জানা উচিত আসল নোটের বৈশিষ্ট্যসমূহ। আনন্দের পূর্ব মুহূর্তে জাল নোট কারবারিদের দৌরাত্ম দূর করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বড় নোটের ক্ষেত্রে জাল করার ঘটনাগুলো বেশি ঘটে থাকে। এজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্বলিত আসল ব্যাংক নোটের কিছু সহজ বৈশিষ্ট্য, যা খালি চোখে দ্রুত বোঝা যায়, আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজনঃ

১. কাগজ : নোটটি সিনথেটিক ফাইবার মিশ্রিত অধিক টেকসই কাগজে মুদ্রিত।

২. ইন্টাগ্লিও লাইন : নোটের ডানদিকে আড়াআড়িভাবে ইন্টাগ্লিও কালিতে ৭টি সমান্তরাল লাইন আছে।

৩. অসমতল ছাপা : নোটের সামনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুদ্রিত।

৪. অন্ধদের জন্য বিন্দু : ১০০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৫টি ছোট বিন্দু;  ৫০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৪টি ছোট বিন্দু এবং ১০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৩টি ছোট বিন্দু রয়েছে যা হাতের স্পর্শে উচু নিচু অনুভূত হবে।

৫. রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা : নোটের বাম পাশে ৪ মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা; যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা লেখা আছে; সরাসরি দেখলে লোগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা সাদা দেখাবে; কিন্তু পাশ থেকে দেখলে বা ৯০ ডিগ্রিতে নোটটি ঘোরালে তা কালো দেখাবে।

৬. জলছাপ : কাগজে জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি; প্রতিকৃতির নিচে অতি উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে ১০০/৫০০/১০০০ লেখা আছে এবং জলছাপের বামপাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উজ্জ্বলতর ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপ রয়েছে।

৭. ব্যাকগ্রাউন্ড মুদ্রণ : ১০০/৫০০/১০০০ টাকার নোটের সামনের দিকে পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা অফসেটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ রয়েছে।

৮. নোটের পেছনের অংশ : ১০০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতীয় সংসদ ভবন মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ৫০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে বাংলাদেশের কৃষি কাজের দৃশ্য মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে ঢাকার তারা মসজিদ মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে।

৯. রং পরিবর্তনশীল কালি : ১০০০/১০০ টাকার ডানদিকের কোণায় ১০০০/১০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে। ৫০০ টাকার ডানদিকের কোণায় সরাসরি তাকালে ৫০০ লেখাটি লালচে এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ফেসবুক পেজে ‘সহজেই জাল টাকা শনাক্ত করবেন যেভাবে’ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে কিছু সহজ উপায় উল্লেখ করা হয়েছিল :

১. জাল টাকার টাকার নোটগুলো নতুন হবে। কারণ জাল টাকার নোটগুলো সাধারণ কাগজের তৈরি; তাই পুরাতন হয়ে গেলে সেই নোট নাজেহাল হয়ে যায় বা তা অতি সহজেই বোঝা যায় ।

২. জাল টাকার নোট ঝাপসা দেখায় । আসল নোটের মত ঝকঝকে থাকে না । সেটা নতুন হোক আর পুরাতন হোক এবং কিছুটা পাতলা বা হালকা ধরনের যা একজন আরেকজনের কাছ থেকে টাকা লেন দেন করার সময় একটু মনযোগ সহকারে দেখলেই বোঝা যায় ।

৩. জাল নোট হাতের মধ্যে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলে তা সাধারণ কাগজের মতো ভাঁজ হয়ে যাবে। আর আসল নোট ভাঁজ হবে না। যদিও সামান্য ভাঁজ হবে তবুও তা জাল নোটের ক্ষেত্রে তুলনামূলক অনেক বেশি।

৪. আসল নোট সবসময় খসখসে হবে ।

৫. টাকা সবসময় দুটি অংশ দিয়ে তৈরি হয়। টাকার দুই পার্শ্বে দুটো নোট জোড়া লাগানো থাকে এবং এটা হরিনের চামড়া দিয়ে তৈরি বলে পানিতে ভেজালেও খুব তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যাবে না । আর জাল নোট পানিতে ভেজানোর সাথে সাথেই তা ভেঙ্গে যাবে।

নোট জাল করা ও জাল নোট লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে জালনোট কারবারির যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধন করে জাল নোটের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদন্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়। জাল নোটের সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।

মানি মার্কেট বলতে যা বুঝায় তার বাস্তবিক উদাহরণ হচ্ছে ঈদের সময় আমাদের ছোট দোকানগুলো। ছোট ছোট দোকান হলেও এগুলোই এই সময়ে বিশাল পরিমাণের অর্থনীতিতে রূপ নেয়। ঈদ আমাদের অর্থনীতিতে বাড়তি গতিশীলতা আনায়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের পূনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে যে বিদ্যমান সম্পদ বৈষম্য রয়েছে তা কিছুটা কমিয়ে সমাজকে বসবাসযোগ্য রাখতে প্রতিটি উৎসবের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। ঈদকে কেন্দ্র করেই শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত চাঙ্গা হয়ে উঠে আমাদের বাজার অর্থনীতি । কিন্তু জালনোট যেন সেখানে কোন প্রভাব ফেলতে না পারে, সেদিকে কঠোর আইন প্রয়োগের সাথে সচেতনতাও প্রয়োজন।

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জুন ২০১৯/রিয়াজ/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়